হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
কোভিডের চোখরাঙানি কমতেই পথেঘাটে বেসামাল, বেলাগাম ভিড়। ট্রেন-বাস অপ্রতুল। পেটের জ্বালায় বে-রোজগেরে মানুষ দুমুঠো অন্নের সংস্থানে মাথা খুঁড়ছেন। ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে সামান্য কিছু ট্রেন-বাসের ঠাসাঠাসি ভিড়ে শারীরিক দূরত্ববিধি চুলোয়। ১৩৯ কোটির দেশে কোভিড রুখতে গাড়ি-ঘোড়ার সংখ্যা বাড়ানোই ছিল সমীচীন। পাঁজি-পুঁথি মেনে দোকানবাজার খোলা বা রাতের অযৌক্তিক কারফিউ সংক্রমণে দাঁড়ি টানতে পেরেছে এমন গবেষণার হদিশ মেলেনি আজও। মহামারীবিদ্যার ফলিত বিজ্ঞানকে কাঁচকলা দেখিয়ে উদ্ভট খামখেয়ালি নিদানে বিড়ম্বনাই বাড়ছে, কোভিড থেকে যাচ্ছে যথাপূর্বং।
নয়া বিধানে শপিংমল-রেস্তরাঁ খোলা, বন্ধ স্কুল। কিশলয় ছাত্রছাত্রীর শরীর-স্বাস্থ্য-মন-পড়াশোনা লাটে। শপিংমল, রেস্তরাঁ, অনুষ্ঠানবাড়ির বদ্ধ পরিবেশে, বহু মানুষের কলরোলে ছড়াচ্ছে কোভিড; স্কুল থেকে কোভিড ছড়ানোর খবর আজও অমিল। স্কুলে মাসে একদিন জুটছে মিড ডে মিলের শুকনো খাবার। পরিবারের অভুক্ত সদস্যদের মিড ডে মিলের সামান্য আহার্যে হচ্ছে ক্ষুন্নিবৃত্তি। শিশুর পুষ্টি শিকেয়। শিশুমৃত্যুর হার কোভিডে ০.২৬ শতাংশ আর অপুষ্টিতে ৬৩ শতাংশ। স্কুল খুললে পরিস্থিতির উন্নতি হতো। ‘হাঙ্গার ওয়াচে’র সর্বশেষ রিপোর্টে স্পষ্ট গ্রাম-শহর মিলিয়ে ২৭% মানুষ রাতের খাবার না খেয়েই ঘুমোতে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। সবথেকে খারাপ অবস্থা শহরের ৫৭ শতাংশ রুটিরুজি হারানো মানুষের। শহুরে নিরন্ন মানুষের অধিকাংশের নেই রেশনকার্ড। লকডাউনের জাঁতাকলে খাবার পাতে একটা ডিমও তাদের জুটছে না।
ভ্যাকসিন নিয়ে হাজারো অব্যবস্থায় বিপর্যস্ত মানুষ তিতিবিরক্ত। বিবিসি-র বয়ানে অদ্যাবধি ৫% মানুষের টিকাকরণ সুসম্পন্ন। টিকাকরণে অগ্রণী দেশগুলোর তালিকায় সবার আগে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, তারপর একে একে উরুগুয়ে, বাহরিন, চিলি, কাতার, কানাডা, ইজরায়েল, ইউকে, মঙ্গোলিয়া, সিঙ্গাপুর। করোনা লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে উপরোক্ত দেশগুলো থেকে। ইংল্যান্ড স্বাধীনতা দিবসের উৎসবে মেতেছে। কোভিডের রেখাচিত্র ইংল্যান্ডে যথেষ্টই নিম্নগামী স্রেফ সার্বিক টিকাকরণের সাফল্যে। বড়দের টিকা সুরক্ষা জোগাচ্ছে ১৮ বছর অবধি শিশু-কিশোর, কিশোরীদের। শিশুদের শরীর বা শ্বাসতন্ত্রে এসিই-টু রিসেপ্টরের সংখ্যা বড়দের তুলনায় নগণ্য। নভেলকরোনা, সেকারণে শিশু-শরীরে খাপ খুলতেই পারছে না। ০.১৪ শতাংশ মাত্র শিশু-কিশোর গোটা বিশ্বে গুরুতর কোভিডের শিকার। সঙ্গতকারণেই ‘হু’ শিশু বা কমবয়সিদের এইমুহূর্তে টিকাকরণের পক্ষপাতী নয়। ভারতে ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত আকালের মধ্যেই অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে শুরু হয়েছে কমবয়সিদের টিকাকরণ।
কোভিডে আক্রান্ত বা মৃতের ভারতে নেই কোনও প্রকৃত তথ্য-পরিসংখ্যান। কোভিডে মৃতের সংখ্যা ভারতে নাকি ৪.২৪ লাখ, সারা বিশ্বের প্রামাণ্য গবেষণা বলছে মৃতের ন্যূনতম সংখ্যা হওয়া উচিত ৩৫ থেকে ৪২ লাখ। যাবতীয় তথ্য পরিসংখ্যান, টিকাকরণ চুক্তি, রাজ্যওয়াড়ি টিকার বিলি-বন্দোবস্ত, ওষুধ বা সেরোসার্ভে—সবেতেই জল মেশানো থাকলে কোভিড-যুদ্ধ জয় দুরাশা। ফাইজারের টিকা বিনাশর্তে অনুমোদন করার পরেও কেন টিকা মিলছে না বা স্পুটনিক-ভি এবং জাইকোভ-ডি’র প্রথা-মাফিক ট্রায়াল সমাপনের পরেও কেন বাজারে টিকা অমিল, সে প্রশ্নেরও নেই কোনও উত্তর।
আইসিএমআর-এর সদ্য প্রকাশিত সেরোসার্ভে (রক্তে কোভিড প্রতিরোধী অ্যান্টিবডির তত্ত্বতালাশ) বলছে ৬৭.৬ শতাংশ ভারতীয় নাকি ‘সেরোপজিটিভ’ অর্থাৎ প্রতি ৩ জনের ২ দুজনের শরীরে নাকি মিলেছে কোভিড ঠেকানোর দাপুটে অ্যান্টিবডি। ৬—৯ বছর এবং ১০—১৭ বছরের শিশুদের শরীরে মিলেছে যথাক্রমে ৫৭.২ ও ৬১.৬ শতাংশ অ্যান্টিবডি। দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ হয় কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন নতুবা তাদের টিকাকরণ সুসম্পন্ন! তা না হলে ৬৭.৬ শতাংশ ভারতীয়ের শরীরে কোন জাদুবলে, কোভিড অ্যান্টিবডি, কোথা থেকে উদিত হল? ভ্যাকসিনের ঘাটতি ঢাকতে ঠারেঠোরে বোঝানোর চেষ্টা চলছে ভারত তো ‘হার্ড ইমিউনিটির’ দোরগোড়ায়! ব্রাজিলের, মানাউশে ২০২০-র অক্টোবরে, সেরোসার্ভেতে, ৮০ শতাংশ মানুষের শরীরে মিলেছিল কোভিড প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি। ‘হার্ড ইমিউনিটির’ খোয়াবে আনন্দে আত্মহারা জনতা কোভিড স্বাস্থ্যবিধিকে শিকেয় তুলে রাস্তায় নেমে পড়েছিল। ডিসেম্বরে, ব্রাজিলের মানাউশ, একদিনে, সারা বিশ্বে কোভিডে মৃত্যুতে রেকর্ড গড়ল।
রক্তে ভাসমান ক্ষীণজীবী ক্ষণস্থায়ী ‘আইজিজি’ অ্যান্টিবডির সংখ্যা-বিচারে কোভিডের দুর্নিবার উড়ানের দিশা বাতলানোর চেষ্টা অবিমৃশ্যকর। ফুসফুসে ম্যাক্রোফেজ, যকৃৎ, প্লীহা বা অস্থিমজ্জায় ‘বি সেল’ এবং ‘টি সেল’ অ্যান্টিবডির যথোপযুক্ত সমন্বয়ের হদিশ না মিললে কোভিড নিবৃত্তি-করণে গনতকারের মতো কোনওরকম ভবিষ্যদ্বাণী বাতুলতা। ভারতের জনসংখ্যা ১৩৯ কোটি, ২৮টি রাজ্যে জেলার সংখ্যা ৭৪২; সেরোসার্ভে ২১টি রাজ্যের ৭০টি জেলার ২৮৯৭৫ জন মানুষের উপর সম্পন্ন। ১ শতাংশেরও কম মানুষের উপর করা সেরোসার্ভের অবৈজ্ঞানিক ফলাফলকে সামনে রেখে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের শরীরে কোভিডের পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডির চড়ুইভাতির গল্প শোনানোর আড়ালের উদ্দেশ্য কী? কোন কায়েমি স্বার্থে, কেন কেবল ২১টি রাজ্যের ৭০টি জেলাতেই পরপর চারবার সেরোসার্ভে চালানো হল?
মে ১৩, ২০২০; সিয়াটল থেকে ১২২ জন জেলেকে নিয়ে একটি জাহাজ পাড়ি জমিয়েছিল সমুদ্রে। যাত্রার সময় ১২২ জনের সকলেই ছিলেন কোভিড নেগেটিভ। তিনজনের শরীরে মিলেছিল কোভিড প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি (পূর্ববর্তী সংক্রমণের কারণেই)। ১৮ দিন পর জাহাজটি যখন ফিরে এল দেখা গেল ১০৩ জন কোভিড পজিটিভ। যে তিনজনের শরীরে অ্যান্টিবডির হদিশ মিলেছিল তারা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হননি। ১৯১৮-র স্প্যানিশ ফ্লু-র ৯০ বছর পরেও জীবিতদের শরীরে মিলেছিল অ্যান্টিবডি। ফাইজার/বায়োএনটেকের ভ্যাকসিনটির দুটো ডোজ সমাপনের ১০ সপ্তাহ পরে প্রতি মিলি রক্তে অ্যান্টিবডি মিলেছে ৩৩২০টি, আর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা/কোভিশিল্ডের অ্যান্টিবডির সংখ্যা ১০ সপ্তাহ পরে দাঁড়িয়েছে ১৯০টিতে। অ্যান্টিবডির সংখ্যা কমলেও আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই। ‘বি সেল’ বা ‘টি সেল’ অ্যান্টিবডি ঘাপটি মেরে অপেক্ষমাণ সমরাঙ্গনে নেমে অতর্কিতে নভেলকরোনাকে (যে কোনও ভ্যারিয়েন্ট) কচুকাটা করবে বলে। দ্রুত টিকাকরণ, মাস্ক আর শারীরিক দূরত্ববিধিতেই সুতরাং জব্দ কোভিডের যে কোনও ভীম-পালোয়ান ভ্যারিয়েন্ট। তিন কেন, তিরিশটা ঢেউ এলেও তখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমনো যেতে পারে।
তথ্য: নেচার, সায়েন্স, দি ল্যানসেট, জামা, এনইজেএম, দি গার্ডিয়ান ও দি নিউইয়র্কর।
লেখক অতিমারী বিশেষজ্ঞ, গিলিং স্কুল অফ পাবলিক হেলথ, ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনা, চ্যাপেল হিল। মতামত ব্যক্তিগত