হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
মাননীয় আমেরিকা, আমাদের কাছে একটা রহস্য এখনও রয়ে গেল। সেটা হল, আপনাদের তৈরি করা অ্যাভেঞ্জার্স চরিত্রগুলি অথবা অতীতে আর্নল্ড সোয়ের্জনেগার, সিলভেস্টার স্ট্যালোনরা কত অসাধ্য সাধন করতেন, অথচ আপনাদের আসল সেনাবাহিনী এভাবে বারংবার পরাস্ত হয় কেন? ভিয়েতনামের রোগা রোগা বিপ্লবী নারীপুরুষরা আপনাদের হারিয়ে দিয়েছিল। তালিবানদের ভয়েও আপনারা দ্রুত পালাচ্ছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আপনারা অসংখ্য সাহসী সাহসী ছবি তৈরি করেছেন। কিন্তু চার্চিল এবং স্ট্যালিনের প্ল্যান ও সামরিক শক্তি ছাড়া আপনারা তো হিটলারকেও হারাতে পারতেন না! ভাগ্যিস হলিউড, নেটফ্লিক্স আর প্রাইমের যুদ্ধ সংক্রান্ত সিনেমা আর সুপারম্যানদের নানাবিধ অ্যাকশন আছে। না হলে আপনাদের উপর আমাদের সমীহ কমে যেত।
যুদ্ধ আপনাদের প্রিয় হবি সেটা আমরা জানি।
চীন, কোরিয়া, গুয়াতেমালা, ইন্দোনেশিয়া,
কিউবা, বেলজিয়ান কঙ্গো, পেরু, লাওস, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, গ্রেনাডা, লিবিয়া, এল সালভাদর, নিকারাগুয়া, পানামা, ইরাক, বসনিয়া, সুদান, যুগোশ্লাভিয়া, আফগানিস্তান, সিরিয়া। গত ৭৬ বছরে আপনারা অসংখ্য যুদ্ধ করেছেন। ডমিনোজ পিৎজা কিংবা অ্যাপল নয়, আপনাদের
আসল বিজনেস তিনটি। ওয়ার, আর্মস এবং অয়েল ইকনমি। সেটা সর্বজনবিদিত। কিন্তু প্রশ্ন হল, কোনও যুদ্ধশেষে একটা ভদ্রস্থ এক্সিট হল না। আপনাদের মতো মাত্র ৫০০ বছরের শিশুরাষ্ট্র মাঝে মধ্যে হাজার হাজার বছরের সভ্যতাগুলোয় প্রবেশ করেন যুদ্ধ করতে, আর যখন বেরিয়ে আসেন, তখন সেখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত এক নৈরাজ্য!
তালিবান কারা? ১৯৯৪ সালে যারা বড়সড়ভাবে আত্মপ্রকাশ করল। কিন্তু তার আগে তারা কে ছিল? ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তান থেকে তাড়াতে, মাননীয় আমেরিকা আপনারা কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? আপনাদের স্পাই সংস্থা সিআইএ এবং পাকিস্তানের স্পাই সংস্থা আইএসআই বিশ্বের ৪০টি দেশ থেকে জোগাড় করল মুজাহিদিনদের। যাতে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তান থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে। সিআইএ বিপুল অঙ্কের টাকা আর অস্ত্র সাপ্লাই দিল। নাম দেওয়া হল জিহাদ! মুজাহিদিনরা কী করল? আফগানিস্তান জুড়ে তৈরি করে ফেলল হেরোইন প্রসেসিং ল্যাবরেটরি। চাষিদের বলা হল, জিহাদ ট্যাক্স মেটাতে আফিমের চাষ করতে। সেই ড্রাগ বিক্রি হল গোটা দুনিয়ায়। আশি ও নব্বইয়ের দশকে যে প্রফিট ছিল ২ হাজার কোটি ডলার। প্রথমে মুজাহিদিন পরে তালিবানদের ডাবল মজা। আপনাদের টাকাও পায়। ড্রাগ বিজনেস থেকেও টাকা আসে।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়া উল হকের থেকে মদত পাওয়া ৩০ বছরের এক যুবক ইসলামিক স্টাডিজ পড়ানো ছেড়ে দিয়ে সৌদি আরবে গিয়ে মুজাহিদিনদের এককাট্টা করার কাজে নিয়োজিত হয়েছিল। তার
নাম কী ছিল? হাফিজ সইদ। আপনাদের চোখের সামনে সে তৈরি হল। কত ধ্বংসাত্মক কাজ করল ভারতের বিরুদ্ধে গত ২০ বছরে! আজও আপনারা তাকে কিছুই করলেন না। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে হতোদ্যম হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন চলে গেল। ৫ বছরের মধ্যে আফগানিস্তানে দেখা দিল নতুন একটি গোষ্ঠী। তালিবান। সুপ্রিমো কে ছিল? মোল্লা মহম্মদ ওমর। তার জামাইয়ের নাম কী? আব্দুল ঘানি বরাদার। ২০০১ সালে মাননীয় আমেরিকা, আপনারা যখন তালিবান শাসন খতম করতে আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিলেন, তখন এই মানুষটি কোন পজিশনে ছিল? তালিবান সরকারের ডেপুটি ডিফেন্স মিনিস্টার।
২০ বছর পর মাননীয় আমেরিকা, আপনারা যখন আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তখন আগামী তালিবান সরকারের প্রধান পরিচালক কে হবেন?
এই আব্দুল ঘানি বরাদার! সম্ভবত প্রেসিডেন্ট।
২০০৮ সালে কে কাবুলে ক্ষমতাদখলের ‘ইবরাত’ অথবা হুমকি দিয়েছিল? যার অর্থ ‘সতর্কতা’। এই আব্দুল ঘানি বরাদার। ২০১০ সালে আপনাদের সিআইএ এবং পাকিস্তানের আইএসআই হঠাৎ ঘোষণা করেছিল বরাদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কোথা থেকে? কেউ জানে না। কিন্তু ২০১৮ সালে পাকিস্তান জেল থেকে সেই বরাদারকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল কার নির্দেশে? মাননীয় আমেরিকা, আপনার নির্দেশে। কেন? আপনি বলেছিলেন, আফগানিস্তানের প্রশাসন হস্তাস্তরের চুক্তির আলোচনায় তালিবানদের হয়ে বরাদারই কথা বলবে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কার সঙ্গে আমেরিকা সরকার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছিল? এই আব্দুল ঘানি বরাদার। কার সঙ্গে বরাদার একটি বৈঠক করেছিলেন? মাইক পম্পেও। কে তিনি? ট্রাম্প সরকারের আমলে আমেরিকার বিদেশসচিব। এবং প্রাক্তন সিআইএ ডিরেক্টর। সেই আব্দুল ঘানি বরাদার এখন হতে চলেছেন আফগানিস্তানের প্রধান! গত প্রায় দু বছর ধরে তালিবানদের সঙ্গে আপনাদের শান্তিপ্রক্রিয়া ফেরানোর বৈঠক চলছিল। মধ্যস্থতায় ছিল আপনাদের চিরকালীন মিত্র পাকিস্তান। এত মসৃণ আলোচনা হল, অথচ ফেরার সময় এভাবে সাধারণ আফগান মানুষগুলিকে অথৈ জলে ফেলে দিলেন কেন? এরা আপনাদের গত ২০ বছর ধরে বিশ্বাস করেছে, সহায়তা করেছে। তাদের সঙ্গে কী ব্যবহার করলেন?
মাননীয় আমেরিকা, আফগানিস্তানের উপর আপনাদের, রাশিয়ার, চীনের, জাপানের এত আগ্রহ কীসের? আসল লক্ষ্য, অয়েল বিজনেস? ১৯৯৭ সালে তালিবান সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল কোথায় সফর করেছিল? আমেরিকার হিউস্টনে। কাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল? আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং ইউনোকল কর্পোরেশনের কর্তাদের সঙ্গে। ইউনোকল মানে কী? ইউনিয়ন অয়েল কোম্পানি অফ ক্যালিফোর্নিয়া। আমেরিকার সর্ববৃহৎ তেল সংস্থা। যারা আফগানিস্তানের লাগোয়া তেল ও গ্যাস রিজার্ভে পূর্ণ একটি দেশ থেকে গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন তৈরি করতে চায়।
সেই দেশের নাম তুর্কমেনিস্তান। প্রকল্পের নাম তাপি (TAPI)। তুর্কমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ইন্ডিয়া। শুধু এই তেল ও গ্যাসের ভাগ পেতে লাগাতার তালিবানকে আপনারা সমর্থন করে গিয়েছেন নব্বইয়ের দশকে। কিন্তু আপনারা জানেন যে, আপনাদের সংস্থাটি চাইলেই তো হবে না। এই কাস্পিয়ান রিপাবলিক দেশগুলির বিপুল তেল ও গ্যাসের দখল পেতে তৈরি আরও একঝাঁক কোম্পানি ও তাদের দেশ। তাদের ভাগ তারা ছাড়বে কেন? কারা তারা? রাশিয়ার গ্যাজপ্রোম। চীনের ন্যাশনাল পেট্রলিয়াম কর্পোরেশন। সৌদি আরবের ডেল্টা অয়েল। জাপানের ইতোচু অয়েল এক্সপ্লোরেশন। পাকিস্তানের ক্রেসেন্ট। এরা সকলে মিলে নব্বইয়ের দশকে শেষে একটি কনসর্টিয়ামও তৈরি করেছিল। সকলে মিলেমিশে ভাগ করে তেল বিজনেস করবে বলে।
কাবুল দখলের কয়েক মাস আগেই এই গত ফেব্রুয়ারিতে তালিবানদের একটি টিম তুর্কমেনিস্তানে গিয়েছিল। সেখানে তুর্কমেনিস্তান এবং তেল সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর তালিবানদের মুখপাত্র সুহেল শাহিন বলেছিলেন, তুর্কমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান হাইভোল্টেজ পাওয়ার প্রকল্প এবং আমেরিকার তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের ‘তাপি’ প্রকল্প নিয়ে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। এই আশ্বাস পাওয়ার পরই মাননীয় আমেরিকা আপনাদের আফগানিস্তান ছেড়ে ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়া যেন ঝড়ের মতো এগিয়ে গেল।