হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
বঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল সাফল্য ঘরে তোলার পর থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র। দেশজুড়ে বিজেপি বিরোধী ঐক্য গড়ার কারিগর তিনিই। পাশাপাশি জনস্বার্থে নতুন নতুন সামাজিক প্রকল্পের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের জন্য তাঁর খ্যাতি এখন বিশ্বজোড়া। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও বিশ্বের বিশিষ্টজনের পাশে জায়গা করে নেওয়ার বিরল কৃতিত্ব তাঁরই রয়েছে। তবে, খ্যাতি তাঁর আত্মতুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। তাই লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার বদলে লক্ষ্যপূরণের সংকল্পে তিনি হয়েছেন আরও প্রত্যয়ী। রাজ্যে একের পর এক জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করছেন। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালন করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, কথা আর কাজের মধ্যে বিন্দুমাত্র ফারাক থাকাটা তাঁর নাপসন্দ। তাই তাঁর সরকারের ঘোষিত প্রকল্পের সুযোগ নেওয়ার জন্য লাখো মানুষের ভিড়।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যবাসীকে স্বস্তি দেওয়ার পাশাপাশি দলনেত্রী হিসেবে দলের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ের উপর তাঁর রয়েছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। নির্বাচনে এমন পাহাড়প্রমাণ সাফল্যের পর ধরাকে সরা জ্ঞান করাটাই ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু মমতা কাজের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করে দিচ্ছেন, তিনি সে পথের পথিক নন। তাই আত্মতুষ্টিতে না ভুগে করছেন আত্মসমালোচনা। দলের ভুলত্রুটি সংশোধন করে এগতে চাইছেন।
একুশের নির্বাচন তাঁকে শিখিয়েছে, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ শুধু মানুষের জন্যই নয়, দলের জন্যও ক্ষতিকর। একজনের হাতে বেশি ক্ষমতা দিলে
তাঁর মধ্যে তৈরি হয় দলকে ‘ব্ল্যাক মেল’ করার প্রবণতা। যাঁদের তিনি দু’হাত উজাড় করে দিয়েছিলেন, তাঁরাই আরও বেশি পাওয়ার প্রত্যাশায় দল ছেড়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা তাঁকে ছেড়ে যাননি। সেই জন্যই মোদির সম্মোহনী ক্ষমতা আর অমিতজির কৌশলী রাজনীতিকে পরাস্ত
করতে পেরেছেন অতি সহজেই।
মমতা ব্যক্তি অপেক্ষা দলকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাই দল ও প্রশাসনের ক্ষমতা ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। এক ব্যক্তি এক পদ নীতি কার্যকর করতে গিয়ে এমন অনেকে বাদ পড়েছেন যাঁদের গায়ে ব্যর্থতার দাগ নেই। উল্টে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও বিধানসভা ভোটে দলকে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছেন। ‘লালদুর্গ’ পূর্ব বর্ধমানের ১৬টি আসনেই জিতেছে তৃণমূল। তবুও স্বপন দেবনাথ মন্ত্রী হওয়ায় তাঁকে জেলা সভাপতির পদ ছাড়তে হয়েছে। রাজ্যের যে পাঁচজন মন্ত্রীকে জেলা সভাপতির দায়িত্ব ছাড়তে হয়েছে, তাঁদের মধ্যে তিনজনের নেতৃত্বে জেলায় ভালো ফল করেছে তৃণমূল। সেই জয়ের মুখ অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেনাপতি হিসেবে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। তবুও প্রাধান্য পেয়েছে নীতি। অপারেশন বেদনাদায়ক হলেও সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনের জন্য কখনও কখনও তা আবশ্যিক হয়ে ওঠে।
সিপিএম ৩৪ বছরে যা করতে পারেনি, তৃণমূলনেত্রী ক্ষমতা দখলের ১০ বছরের মাথায় সেটাই করে দেখালেন। ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতি কার্যকর করার জন্য তাঁর ‘টাইমিং’ অসাধারণ। একদিকে নির্বাচনে বিপুল সাফল্য, অন্যদিকে বিরোধীদের ছন্নছাড়া অবস্থা। তাছাড়া লোকসভা নির্বাচন এখনও অনেক বাকি। তাই পরীক্ষা নিরীক্ষার এটাই সেরা সময়। এই অবস্থায় পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ক্ষোভ তৈরি হলেও কেউ দল ছাড়বেন না। কারণ যাওয়ার জায়গা দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে। তাই কিল খেলেও মুখ বুজে হজম করতেই হবে। নির্বাচনের আগে ‘বেসুরো’দের করুণ পরিণতি নেতাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত করেছে। তাই ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ তো দূরের কথা, সকলেই ‘সুবোধ বালক’। দলের নির্দেশ হাসিমুখে পালনে প্রস্তুত।
বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চালু করা সামাজিক প্রকল্পের পুরো ডিভিডেন্ট ঘরে তুলেছে রাজ্যের শাসক দল। তা সত্ত্বেও তাৎপর্যপূর্ণ হল, রাজ্যের বহু শহরে তৃণমূল পিছিয়ে। বেশকিছু বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল জয়ী হয়েছে স্রেফ গ্রামের বিপুল সমর্থনে। বিষয়টি তৃণমূল সুপ্রিমোর নজর এড়ায়নি। তিনি বুঝেছেন, রাজ্যের মহিলারা এবং গ্রাম সঙ্গে থাকলেও শহরের একটা বড় অংশ তৃণমূল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কেন?
এই ‘কেন’র উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানতে পেরেছেন, তৃণমূলের মুখ হিসেবে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের আচার, আচরণ মানুষ পছন্দ করছেন না। অনেকেই জনস্বার্থের বদলে ব্যক্তিস্বার্থে দলকে ব্যবহার করছেন। ফলে তাঁর বিপুল কর্মযজ্ঞের সুফলকে ঢেকে দিয়েছে শহুরে নেতাদের কুকর্ম। সেই সব মুখের প্রতি বিরক্ত হয়ে মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। সেই কারণে বহু টাউন কমিটির সঙ্গে পুর প্রশাসনেও পরিবর্তন এনেছেন। পুরসভায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে সুশীল সমাজ। কারণ নেত্রী সাধারণ মানুষের কাছে পুরসভাকে আরও গ্রহণযোগ্য করতে চাইছেন। সেই কারণে নেতাদের পাশাপাশি চিকিৎসক, অধ্যাপক, এমনকী ব্যবসায়ীদেরও যুক্ত করা হয়েছে। যাঁরা কোনও দিনই তৃণমূলের ঝান্ডা ধরেননি, এমন অনেকে দায়িত্ব পেয়েছেন। এসব দেখে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, এটা কি পুরসভাকে দলতন্ত্রের বাইরে বের করার প্রয়াস? এটাই কি ‘উন্নততর তৃণমূলে’র মডেল? উত্তর দেবে সময়।
দুয়ারে সরকার ক্যাম্পগুলিতে হাজার হাজার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভিড় দেখে যাঁরা আক্রমণের অস্ত্রে শান দিচ্ছেন, তাঁদের একটা কথাই বলার, রসো বৎস্য, রসো। সমালোচনা করার আগে একটিবার অন্তত ভাবুন, কেন রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ মমতার সরকারের প্রকল্পের সুবিধা নিতে ক্যাম্পে ভিড় করছেন? এই ভিড় কীসের ঈঙ্গিত? উত্তর, এটা মমতার কথার প্রতি মানুষের বিশ্বাসের প্রতিফলন। কথা দিলে কথা রাখেন। ধাপ্পা দেন না।
‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন।’ সম্ভবত এটাই বিশ্বাস করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাই বাংলার লক্ষ লক্ষ অসহায় মা, বোনের জীবনে ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা’র স্বাদ পৌঁছে দিতে প্রতি মাসে টাকা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। ৬০ বছর পর্যন্ত হাতখরচের এমন নিশ্চিত গ্যারান্টি এর আগে ভূ-ভারতে কেউ দেননি। তাই দুয়ারে সরকারের প্রতিটি ক্যাম্পে মা, বোনের ভিড় উপচে পড়ছে।
লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের গুরুত্ব বুঝতে পারছেন বিজেপির নেতা-কর্মীরাও। তাই কেউ নিজের ছবি ছাপিয়ে লক্ষ্মী ভাণ্ডারের প্রচার করছেন, কেউ আবার ক্যাম্পে গিয়ে ফর্ম পূরণে সাহায্য করছেন। বিজেপির রামপুরহাট শহরের নেতা বিপ্লব নন্দী তাঁদেরই একজন। তাঁর কথায়, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের জন্য বহু মহিলা শিবিরে আসছেন। আমরাও চাই, মানুষ সরকারের সমস্ত পরিষেবা পাক। সেজন্যই আমরা এখানে বসেছি। রাজ্য সরকার যদি জীবনভর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার চালাতে পারে, তাহলে খুব ভালো।
মাটির সোঁদা গন্ধ এখনও যাঁদের নাকে পৌঁছয়, তাঁরা বুঝতে পারছেন, মমতার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের বিরোধিতার অর্থ জনগণের বিরাগভাজন হওয়া। কারণ মমতার লক্ষ্মীর ভাণ্ডার কোনও মামুলি প্রকল্প নয়, এটা লক্ষ লক্ষ মা, বোনের আর্থিক স্বাধীনতার এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।
টিফিনের টোপ আর টাকার লোভ দেখিয়ে জমায়েতে অভ্যস্ত বিজেপি নেতারা মমতার লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পে ভিড় দেখে দিশেহারা। পায়ের তলার মাটি দ্রুত সরে যাচ্ছে। ২০২৪এর পরিণতির কথা ভেবে অনেকে মাথার ঠিক রাখতে পারছেন না। তাই মা-বোনেদের জীবনে যা ‘স্বাধীনতার আনন্দ’ দিলীপ ঘোষের চোখে তা ‘ভিখারি’ বানানোর কৌশল। তিনি অবলীলায় বলতে পারেন, ‘উনি (মমতা) ৫০০টাকার জন্য বাঙালি সমাজকে ভিখারি বানিয়ে দিলেন।’
না দিলীপবাবু, আপনি ভুল বলছেন। মমতার ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ বাংলার মা, বোনেদের ভিখারি বানায়নি, বরং ভালো করে দেখলে বুঝতে পারবেন, বাটিটা এখন আপনাদের হাতে!