হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
চমকে যাওয়ারই তো কথা। ৩ লক্ষ আফগান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মাত্র ১০০ দিনের লড়াইয়ে প্রায় বিনা বাধায় তালিবানের কাবুল দখল— এও কি সম্ভব? এই প্রশ্নই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে গোটা বিশ্বকে। চার কোটি মানুষকে ভয়ঙ্কর তালিবানের মুখে ফেলে রেখে পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। অভিযোগ, তালিবান বাহিনীর কাবুল দখল নিশ্চিত হতেই চারটি গাড়ি আর একটি হেলিকপ্টার-ভর্তি প্রচুর নগদ অর্থ নিয়ে দেশ ছেড়েছেন ঘানি। আফগান আমজনতার কাছে আশরাফ ঘানির পরিচয় এখন ভিতু, মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক...।
তবে তালিবানের এই উত্থান আদৌ বিনা মেঘে বজ্রপাত নয়। গ্রামীণ আফগানিস্তান তালিবানের উত্থান টের পেয়েছিল বহু আগেই। নিখুঁত পরিকল্পনা, সাহসী নেতৃত্ব আর প্রতিপক্ষ শিবিরে ক্রমাগত ভাঙন। এই তিন ‘অস্ত্রে’ ভর করেই মাত্র তিন মাসের মধ্যে রাজধানী কাবুল-সহ প্রায় গোটা দেশ দখল করে নিয়েছে হিবাতুল্লা আখুন্দজাদার তালিবান বাহিনী। চল্লিশের দশকে চীনের গৃহযুদ্ধের সময় যেমন কৌশলে নিয়েছিল চেয়ারম্যান মাওয়ের বাহিনী।
চলতি বছরের মে মাসের গোড়া থেকে আমেরিকার সেনা আফগানিস্তান ছাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু প্রথমেই বড় শহর বা প্রাদেশিক রাজধানীগুলি দখলের পথে হাঁটেনি হিবাতুল্লা আখুন্দজাদার বাহিনী। বরং ধীরে ধীরে পাকিস্তান ও ইরান সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলিতে আধিপত্য বাড়াতে শুরু করে তারা। এমনকী, যোগাযোগ তৈরি করে আফগান সেনা অফিসারদের একাংশের সঙ্গেও। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া পুরোদস্তুর যুদ্ধে একের পর এক শহর ও সেনাঘাঁটি বিনাযুদ্ধে দখল করেছে তারা। সংখ্যা এবং সমরাস্ত্রের নিরিখে আফগান সেনা এগিয়ে থাকলেও যুদ্ধে তার কোনও প্রতিফলন দেখা যায়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে আফগান সেনার পাশতুন জওয়ানরা সরাসরি হাত মিলিয়েছে তালিবানের সঙ্গে। নেতৃত্বে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মহম্মদ ওমরের ছেলে মহম্মদ ইয়াকুব।
অথচ, আমেরিকা এই আফগানিস্তানে তিন লাখ সেনাকে অত্যাধুনিক সামরিক শিক্ষা দিয়েছিল। প্রায় ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার খরচ করেছিল। ন্যাটোর দেওয়া আরও অতিরিক্ত ৭০ মিলিয়ন ডলার ব্যবহৃত হয়েছিল তাদের আরও চোস্ত-চৌকস করার জন্য। অস্ত্রশস্ত্রেরও কমতি ছিল না। লক্ষ্য ছিল, এমন এক সেনাবাহিনী তৈরি করা, যারা তালিবানের আক্রমণে গর্জে উঠবে। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’।
আর লড়াইয়ের ময়দানে সেই সামরিক বাহিনীই কোথাও কোনও প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। আসলে, তালিবানের বিরুদ্ধে তারা লড়াই চায়নি। নামেওনি। কিন্তু কেন সামরিক বাহিনী কোথাও কোনও প্রতিরোধ গড়েনি? সেটাও তো প্রশ্ন। আসলে, দীর্ঘ দু’দশক ধরে আফগানিস্তানে বিদেশি সেনার উপস্থিতি মেনে নিতে পারেনি দেশের সংখ্যাগুরু পাশতুন জনগোষ্ঠী। উনবিংশ শতকে ব্রিটিশ এবং আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধেও অগ্রণী ভুমিকায় ছিল এই পাশতুনরাই। এ বার আমেরিকার সেনা প্রত্যাহার শুরু হতেই বিশেষত গ্রামাঞ্চলের পাশতুন গোষ্ঠী সক্রিয় ভাবে তালিবানের পাশে দাঁড়ায়। তাই মূল লড়াইয়ে প্রায় ৭০ হাজার তালিবান অংশ নিলেও দেড় লক্ষেরও বেশি সহযোগী মিলিশিয়া বাহিনীর সক্রিয় সমর্থন পেয়ে যায় তালিবান। যুদ্ধক্ষেত্রে যা নির্ণায়ক হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফগান মাটি চেনেনই না, আমেরিকা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা আশরাফ ঘানি নিজেই এই পরাজয়ের অন্যতম কারণ। কারণ, আমেরিকার হাতের পুতুল ঘানি সরকার ‘লেজিটিম্যাসি’ বা বৈধতা হারিয়েছিল। নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে দ্বিতীয় দফায় ঘানি সরকারের আসা সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়া বিশেষজ্ঞ আহমেদ রশিদের কথায়, ‘‘কখনও কাউকে কাছে আসতেই দেননি গনি। সবসময় একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন, সে আফগান নাগরিক হোন বা অত্যন্ত পরিচিত কেউ। অল্পেতে রেগেও যেতেন। অহঙ্কারী হিসেবেই আফগানিস্তানে তাঁর ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে।’’ শুধু তাই নয়, ঘানি সরকারের নির্ভরযোগ্য নীতিনির্ধারকদের সঙ্গেও জনগণের কোনও যোগ ছিল না। তাঁরা ছিলেন এলিট ঘরানার। তাঁরা দারি ও পশতু ভাষায় তেমন দক্ষ ছিলেন না, যতটা দক্ষ ইংরেজিতে। তাঁদের প্রত্যেকের আছে বিদেশি পাসপোর্ট। জনগণ জানত, বিপদে পড়লে নীতিনির্ধারকরা দেশ ছেড়ে পালাবেন। এই বাস্তব পরিস্থিতি সেনাবাহিনী এবং জনগণ উভয় পক্ষেরই অজানা ছিল না। তাই ভয়ঙ্কর আগ্রাসী তালিবানকেই আমজনতার বড় অংশ স্বাগত জানিয়েছে। যুদ্ধে নেমে সেনারা দেখেছে, রাস্তায় আমজনতা তালিবানের সঙ্গে কোলাকুলি করছে। সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে— আমরা কেন জনগণের বিপক্ষে দাঁড়াব? আমরা তো শাসকের পেটোয়া বাহিনী নই। দেশের সেবক। আমাদের দেশেই থাকতে হবে। বিবিসি আবার মারাত্মক তথ্য জানিয়েছে। তাদের নিজস্ব রিপোর্ট বলছে, রণক্ষেত্রে ৩ লাখ নয়, আফগান সেনা ছিল মেরেকেটে ৫০ হাজার। আফগান বাহিনীর সদস্যসংখ্যা নিয়ে একই কথা বলেছেন মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনও।
যে সামাজিক বৈষম্যের কারণে একসময় তালিবানের উত্থান হয়েছিল, ২০ বছরের মার্কিন অধিগ্রহণে তা বিলুপ্ত হয়নি, বরং আরও জেঁকে বসেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি আগের চেয়ে ব্যাপকতর আকার নিয়েছে। মার্কিন সেনা আসার পর শহরে কিছু পরিবর্তন হলেও যে গ্রাম সেই গ্রামই রয়ে গিয়েছে। এসব গ্রাম থেকে তালিবান কখনওই সরে যায়নি। এই গোটা সময়েই তালিবান গ্রামাঞ্চলে একটি বিকল্প প্রশাসন চালিয়ে গিয়েছে। শহরের বাইরে অধিকাংশ আফগানির কাছে কাবুলের মার্কিনসমর্থিত সরকার কখনওই পুরোপুরি বৈধতা পায়নি। দেশের সর্বত্র মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি এই বৈধতা–হীনতাকে আরও জোরদার করেছে। যাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে দেশ শাসন করা হয়েছে, তারাই যখন পালাচ্ছে, তখন তালিবানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অর্থহীন— এমনই একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, বাঁচতে হলে তালিবানের সঙ্গে হাত মেলানোই শ্রেয়।
শুনলে অবাক হবেন, ঘানি সরকার সেনাবাহিনী নিয়েও দুর্নীতি চালিয়ে গিয়েছে। স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকন্সট্রাকশন (সিজার) ২০১৯ সালে এক প্রতিবেদনে জানায়, আফগান সেনাবাহিনী ভূতুড়ে যোদ্ধায় ভর্তি। এই সেনারা কাগজে-কলমে রয়েছে। এদের নামে মাসে মাসে বেতন-ভাতা তোলা হয়। কিন্তু বাস্তবে এদের কোনও অস্তিত্ব নেই। আফগান সরকারি কর্তারা বিভিন্ন ভুয়ো নাম ব্যবহার করে দিনের পর দিন নিজেরাই বেতন-ভাতা পকেটে পুরেছে। সিজারের তথ্য, ২০১৯ সালে ৫৮ হাজার ৪৭৮ জন সেনার কোনও হিসেবই পাওয়া যায়নি। আর ঘানি সরকারের এসব দুর্নীতির প্রচার করে জনসাধারণকে খেপিয়ে তুলেছিল তালিবান।
কে না জানে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির সূচকে আফগানিস্তানের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৫। ২০১৪ সাল নাগাদ আফগানিস্তানের ইউএসএইডে শুল্ক-করবিষয়ক দোভাষীর (ইন্টারপ্রেটর) কাজ করতেন সাইদুর রহমান নামে একজন আফগান। মার্কিন কর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় কর্তাদের কথোপকথনে সাহায্য করতেন তিনি। তিন বছর পর আফগানিস্তানের নীতিনির্ধারকরা সেই সাইদুর রহমানকেই রাজস্ব বিভাগের শীর্ষকর্তা বানিয়ে দিয়েছিল। তারপর রাজস্ব বিভাগের শীর্ষকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এক চিকিৎসককে। চারজন পরিচালকের মধ্যে তিনজনের রাজস্ব বিষয়ক কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না। ছিল না কোনও নিয়োগনীতি।
আফগানিস্তান পুরোপুরি আমদানি নির্ভর দেশ। শুল্ক-কর আদায় বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু নিয়মনীতির কোনও বালাই নেই। শুল্ক বিভাগ দুর্নীতিতে ডুবে। পণ্যবাহী ট্রাকচালকরা যদি মন্ত্রী অথবা প্রভাবশালীদের পরিচয় দিতেন, তাহলে শুল্ক-কর দিতে হতো না। আফগানিস্তানের শুল্ক-কর অফিসারদের সিংহভাগই দুর্নীতিগ্রস্ত। তাঁদের অনেকেই দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। এমন অফিসারও রয়েছেন, সকালের ফ্লাইটে দুবাই যেতেন, বিকেলের ফ্লাইটে চলে আসতেন। রাজস্ব বিভাগে নিয়মকানুনের বালাই ছিল না। সব জায়গায় স্বজনপ্রীতি। ২০২০ সালে মার্কিন কংগ্রেস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, পরিকাঠামো পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে ২০০৯ থেকে ২০১৯-র মধ্যে প্রায় ২ হাজার কোটি ডলার নষ্ট হয়েছে। সেই অর্থ গোটাটাই ঢুকেছে ধাপ্পাবাজদের ঘরে।
ইউনিসেফ-এর ফিল্ড অপারেশনের দায়িত্বে থাকা মুস্তাফা বেন মেসাউদের কথায়, ‘‘আফগানিস্তানে এমনিতেই পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রতি দু’জন শিশুর মধ্যে এক জন অপুষ্টিতে ভোগে। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে এক বেলাও মুখে অন্ন উঠছে না কারও। কোভিডে প্রতিদিন ১০০-র বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু ওই শিবিরগুলির দশা বেশ খারাপ। কোভিড বিধির কোনও বালাই নেই।’’
আফগানিস্তানের দুর্নীতিতে বড় অবদান রয়েছে খনিজ ক্ষেত্রের। প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির বিরুদ্ধেও এসওএস ইন্টারন্যাশনাল নামে আমেরিকার একটা কোম্পানিকে দুর্নীতির মাধ্যমে কুনার প্রদেশে খনিজ সম্পদে নিয়ন্ত্রণ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কাবুলের ২৫ মাইল দক্ষিণে লগার প্রদেশে মেস এয়াংক খনিতে রয়েছে বিপুল কপার। ২০১৭ সালে চীনের রাষ্ট্রীয় সংস্থা এমসিসি (মেটালুরজিক্যাল কর্পোরেশন অব চায়না) ৩ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে সেই খনি লিজ নিয়েছিল। সেই সময় খবর বেরিয়েছিল, খনিজবিষয়ক মন্ত্রী মহম্মদ ইব্রাহিম আদেলকে এই চুক্তি করতে এমসিসি ৩০ মিলিয়ন ডলার কাটমানি দিয়েছিল। যার জন্য ইব্রাহিম আদেল পদচ্যুত হন। আফগানিস্তান জুড়ে এসব খবর ভূরি ভূরি।
ঘানি সরকারের স্বরাষ্ট্র ও বিদেশ বিভাগও অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতিতে ডুবে গিয়েছিল। স্বরাষ্ট্র বিভাগের অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে সেনা ও পুলিস বাহিনীর কর্মীদের কয়েক মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যায়নি। ফলে রণক্ষেত্রে সেনারা সরকারের পক্ষে দাঁড়ালে ক্ষুব্ধ পুলিস বাহিনীই বিদ্রোহ করত। নিশ্চিত।
বাইডেন ঠিকই বলেছেন, আফগানরাই নিজেদের রক্ষার জন্য লড়েনি...