হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
সভ্য দুনিয়া ভুলবে না ২০০১-এ বামিয়ানে বৌদ্ধমূর্তির ধ্বংসসাধনের বর্বর ঘটনাটি। খ্রিস্টীয় তৃতীয়-দশম শতকে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে প্রসারিত গান্ধার শিল্পকলার নিদর্শন ছিল এগুলি। ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ’—স্বীকৃতি দিয়েছিল ইউনেস্কো। তালিবান নেতা মোল্লা মহম্মদ ওমরের নির্দেশে ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেগুলি ধ্বংস করা হয়। একদা ভারত এবং আফগানিস্তানের মধ্যে সভ্যতার বন্ধন কতটা দৃঢ় ছিল বামিয়ান তার সাক্ষ্য বহন করে। সম্রাট অশোক এবং কুশান রাজারা এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের বিস্তার ঘটান। মানবসভ্যতার এই আশ্চর্য নিদর্শনের পুনরুদ্ধারে আফগান সরকারের আহ্বানে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (এএসআই) হাত মিলিয়েছিল ১৯৬৯ সালে। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভে ভারতের ভূমিকাটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
১৯১৯ সালে স্বাধীন হয় আফগানিস্তান। কিন্তু স্বাধীন দেশটি কখনও শান্তির মুখ দেখেনি। গত শতকের সাতের দশকে সামরিক অভ্যুত্থানে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। অতঃপর কাহিল হয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধে। ১৯৭৯ সালে হস্তক্ষেপ করে সোভিয়েত রাশিয়া। ১৯৮৬-তে প্রেসিডেন্ট হন বামপন্থী নেতা ডাঃ নাজিবুল্লা। কিন্তু তাতে গৃহযুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে যায়। ডাঃ নাজিব বাধ্য হন মৌলবাদী মুজাহিদিনদের সঙ্গে আপস করার নীতি গ্রহণে এবং ১৯৮৯-৯২ পর্বে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহৃত হয়। ১৯৯১-তে সোভিয়েত রাশিয়ার বিলুপ্তি নাজিবকে চূড়ান্ত অসহায় করে তোলে। অন্যদিকে, মুজাহিদিনদের সমানে মদত করে গিয়েছে পাকিস্তান (জিয়াউল হক-গুলাম ইশাক খান জমানা) এবং আমেরিকা (জর্জ ডব্লু বুশ প্রশাসন)। ১৯৯২-এ নাজিব ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এবং দখল নেয় মুজাহিদিনরা। দেশত্যাগে ব্যর্থ নাজিবকে ১৯৯৬ সালে ফাঁসিতে লটকে দেয় তালিবান। সোভিয়েতের পতনের পর আমেরিকার ইন্টারেস্টও ফিকে হতে থাকে। লাদেন খতম হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আফগানভূমির গুরুত্ব তলানিতে। দুর্বল গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটানোকেই পাখির চোখ করে তালিবানকে তোল্লা দিয়ে গিয়েছে পাকিস্তান। সফলও হল চীনের সাহায্য নিয়ে। নাজিবুল্লার সঙ্গে আশরাফ ঘানির তফাত হল, ঘানি প্রাণ ও ব্যক্তিগত কিছু সম্পত্তি নিয়ে দেশান্তরি হতে পেরেছেন।
ইমরান খান সবার আগে ঘোষণা করেন, তালিবান জঙ্গি নয়, সাধারণ মানুষ। আর তাঁর বিদেশমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি বলেছেন, আফগানিস্তানে সরকার গঠনে ইতিবাচক পদক্ষেপ করবে ইসলামাবাদ। তাঁদের আন্তরিকতার প্রমাণ, গত সপ্তাহে তালিবান প্রতিনিধি দল ইসলামাবাদে গিয়ে বুদ্ধিসুদ্ধি নিয়ে এসেছে। এরপর কান্দাহারে তালিবান শীর্ষনেতা আব্দুল ঘানি বরাদরের সঙ্গে দেখা করেন আইএসআই চিফ লেঃ জেনারেল ফৈয়াজ হামিদ। তাঁরা একসঙ্গে নামাজও পড়েন। আইএসআই-তালিবান গাঁটছড়ার সেই চাঞ্চল্যকর ছবি ফাঁস হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ায়। সরকার গঠন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে বরাদর-ফৈয়াজের। অতঃপর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে শনিবার বরাদর যান কাবুলে।
কোন কাবুলে? যেখানে নিত্য বর্বরতা আর নৃশংসতার ছবিই শান্তিকামী মানুষের হাড় হিম করে দিচ্ছে। রবিবার চোখের জলে কাবুলকে বিদায় জানালেন দুই শিখ সেনেটর। দিল্লি পৌঁছে তাঁরা পুনর্জীবন লাভ করেছেন বলে মনে করছেন। কাবুল থেকে ওইদিন এসেছেন কিছু আফগান নাগরিকসহ আরও ৪০০ জন। সদ্যোজাত শিশু, মহিলা থেকে নানা বয়সি বিপন্ন মানুষ। তালিবানের খপ্পর থেকে বেরতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বহু শান্তিকামী নাগরিক। বেশিরভাগেরই লক্ষ্য ভারতে আশ্রয়লাভ। তাই কাবুল এয়ারপোর্টে প্রবেশের জন্য হুড়োহুড়ি লেগেই আছে। রবিবার পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে সাতজন। আগেও কয়েকজনের প্রাণ গিয়েছে। এদিকে, ভারতে নানাভাবে রয়ে যাওয়া আফগান নাগরিকরা আর সেদেশে ফিরতে চান না। ভারতে আশ্রিত আছেন আরও প্রায় এক লক্ষ পাখতুন। দেশে ফিরতে চান না তাঁরাও।
১৯৯৬-পূর্ব তালিবান জমানায় শরিয়তি আইনকে সামনে রেখে মহিলাদের উপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছে আফগানিস্তানে। সেই স্মৃতিকে পিছনে রেখে কিছু সাহসী মহিলা এই প্রজন্মের মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। কিন্তু নয়া তালিবানও ফতোয়া জারি করেছে, কো-এড স্কুলে মেয়েদের যাওয়া চলবে না। ‘ভারত ও আমেরিকার দালাল’ সাংবাদিকদের উপরেও খড়্গহস্ত তারা। একই খাঁড়া ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে পূর্বতন সরকারের সমর্থকদের সামনে। ‘শরিয়ত মেনে’ মৃত্যুদণ্ডদানও অব্যাহত। সবচেয়ে কোপে নারীসমাজ। নিজের অফিসে ঢুকতে বাধা পাচ্ছেন মহিলা টিভি অ্যাঙ্কর। আটক করা হয়েছে এক প্রাদেশিক মহিলা গভর্নরকে। মোছা হচ্ছে বিউটি পার্লারের সামনে থেকে মেয়েদের ছবি। ময়দান শহর-এর মেয়র জারিফা গাফারিকে বারবার হত্যার চেষ্টা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল উওম্যান অফ কারেজ সম্মানে ভূষিত জারিফার মতে, ৪০ বছর ধরে আফগান পুরুষরাই সীমাহীন অশান্তির মূলে। এখন মহিলাদের সোচ্চার হওয়ার সময়। প্রেসিডেন্ট দেশত্যাগের পর সেই জারিফা খুন হয়ে যাওয়ারই আশঙ্কা করছেন। বহুদিন যাবৎ দেশের বাইরে রয়েছেন আফগান মহিলা ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক খালিদা পোপাল। সতীর্থদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত তিনি। ফুটবল প্রসারের মাধ্যমে মেয়েদের স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা করতে তালিবানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু দেশ ফের তালিবানের কব্জায়, হতাশ তিনি। সোশ্যাল মিডিয়া মারফত খালিদার বার্তা, ‘তোমরা পালাও অথবা লুকিয়ে পড়ো।’ ভীষণ ভয় পেয়েছে মেয়েদের শিক্ষাঙ্গন। একটি গার্লস স্কুলের প্রধান তাঁর ছাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে সমস্ত নথি পুড়িয়ে ফেলেছেন।
তালিবান স্পর্ধা দেখাচ্ছে যে তারা মেয়েদের অধিকার দেবে! তারা দয়া করার কে? মেয়েরা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়ার অধিকার পাবেন না কেন? তালিবানের চোখে চোখ রেখে এখনও রাস্তায় নেমে লড়াই করার হিম্মত দেখাচ্ছেন কিছু মহিলা। তাঁদের হাতে দেশের জাতীয় পতাকা। নারী সুরক্ষা ও স্বাধীনতার দাবিতে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনেও অবস্থান বিক্ষোভ করেছেন কিছু নারী। পাক প্রধানমন্ত্রীর হিম্মত নেই এঁদের পাশে দাঁড়ানোর। থুড়ি, তিনি নিজেও যে তালিবানি ধ্যানধারণায় স্নাত, তার প্রমাণ তিনি ইতিমধ্যেই রেখেছেন ধর্ষণের জন্য মেয়েদের ছোট পোশাককে দায়ী করে।
মানুষ সাধারণভাবে মৌলবাদী। ব্যক্তিগত সুখের ভিতর মোক্ষ দেখার মধ্যেই নিহিত এই সত্য। ধর্মনিরপেক্ষতা তার মাস্ক। সুযোগ পেলেই খুলে ফেলে— বুকভরা শ্বাস নিতে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ এবং উপমহাদেশ জুড়ে অগুনতিবার ধর্মের নামে হানাহানি হয়েছে, হচ্ছে। তার মধ্যে মানুষকে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে ঐক্যবদ্ধ রাখার থেকে বড় চ্যালেঞ্জ কিছু হয় না। এই অঞ্চলে সেই কাজটাই করে যাচ্ছে একমাত্র ভারতীয় গণতন্ত্র। আজকের পরিস্থিতিতে এটা কতটা স্থায়ী হবে? ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে না তো? খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে এ প্রশ্ন। সিএএ-র বিরুদ্ধে যে জনমত তৈরি হয়েছিল, সেটা এবার ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যেতে পারে। জনমনে জোরদার হতে পারে সিএএ-র পক্ষে সহানুভূতি। হয়তো অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হতে চলেছে সিএএ। সুযোগ বুঝে সিএএ কার্যকর করার প্রশ্নে জোর সওয়াল করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী।
পাকিস্তান স্বখাতসলিলে ডুববেই। বিরাট ক্ষতি হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশের। ওপার বাংলায় উল্লসিত মৌলবাদীরা শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছে। তারা বাংলাদেশে তালিবানের শাসন চাইছে, এমনকী ভারতেও! চীন এবং পাকিস্তান নামক দুই ‘বেরাদার’ এবার নেপাল, মায়ানমার, ভুটানকে পুরো বগলদাবা করার চেষ্টা নেবে। এই নষ্টামি কোনওক্রমে সফল হলে দেশগুলি যেন ভুলে না যায়, তার মাশুল গুনতে হবে আগামী অনেক দশক। এখানকার কিছু প্রাজ্ঞ রাজনীতিক সওয়াল করছেন, অন্য কয়েকটি দেশের মতো তালিবানের সঙ্গে ভারতেরও সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্যে। তারা নাকি দয়ালু খুনি! তালিবান আশ্বস্ত করেছে: প্রাক-মুসলিম-যুগের নিদর্শন ঐতিহ্য তারা আর ধ্বংস করবে না। মেয়েদেরও কিছু অধিকার দেবে। যাকে তাকে হত্যা করবে না। হায়, নারীর অধিকার, মানুষের জীবন-মৃত্যু, বিশ্ব-ঐতিহ্য—সবই এখন তালিবান ওরফে পাকিস্তানের করুণা ভরসা। স্বাধীনতা দিবস পালনের অপরাধে যে-দেশে খুন (তাঁদের মুখে স্লোগান ছিল: আমার পতাকাই আমার পরিচয়) হতে হয়, সেই দেশের মানুষ কতটা স্বাধীনতা ভোগ করবে, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ কোথায়? এ রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’র দেশ নয়। ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’ তালিবান জল্লাদ বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়ে (৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩) প্রমাণ করে গিয়েছেন সভ্যতাপূর্ব-যুগে ফিরে যাওয়ারই সাধনায় মগ্ন এই দেশ। শোকের কালিতে লেখা থাকবে ইতিহাসের এই অধ্যায়ের রূপকারটির নাম ইমরান খান, যাঁকে পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্ম শিক্ষিত এবং উত্তর-আধুনিক ভেবে বসেছিল!