‘ইন জা কাবুল’। রেডিও স্টেশনে প্রোগ্রাম শুরু মাত্র এই কয়েকটা শব্দ ভেসে আসত... মানেটা হল, ‘হেথায় কাবুল’। লিখেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলি। ঠিক যেন প্যারিসের রেডিও স্টেশনের মতো। দিনের শুরুতে বলে উঠবে, ‘ইসি পারি’... প্যারিস আছে এখানেই। রবিবার একদিকে নরেন্দ্র মোদি লালকেল্লা থেকে সূচনা করছেন ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস কর্মসূচির... বলছেন, আমাদের দেশ শক্তি ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হবে... আর তখনই পতন হচ্ছে কাবুলের। মাত্র ১০ দিনের মধ্যে একটা রাজপাট, একটা গণতন্ত্র মিশে যাচ্ছে ধুলোয়। সেইসঙ্গে বড়সড় একটা প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিচ্ছে ভারতের ৩০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগের উপর। ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তান পুনর্গঠনের জন্য প্রায় এই পরিমাণ টাকা ভারত খরচ করে ফেলেছে। কিন্তু... ফিরল তালিবান শাসন। ঠিক ২০ বছর পর। যেন একপাল নেকড়ে যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করছিল। অসীম তাদের ধৈর্য। পাহারা ওঠার অপেক্ষা। একে একে দখল হল কান্দাহার, হেরাত, জালালাবাদ...। তারপর কাবুল। নিঃশব্দে। হিংসা চতুর্দিকে? না, বিশ বছর আগের ভুল তালিবান করছে না। আনন্দের বহিঃপ্রকাশে যারা গুলি ছুড়ছে, কেড়ে নেওয়া হচ্ছে সেই তালিব সন্ত্রাসীদের বন্দুক। ঘোষণা চলছে, নারী অধিকারে আমরা হস্তক্ষেপ করব না (সবই লোক দেখানো)। কিন্তু আতঙ্ক? তাকে যে পোষ মানা দায়! বিমানবন্দরে তিল ধারণের জায়গা নেই, তোলপাড় চলছে মনের ভিতরে ও বাইরে। পালাচ্ছে মানুষ। কেউ বিমানে, কেউ সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তান বা ইরানে। ১২৯ জনকে নিয়ে রবিবার বিকেলে কাবুল ছেড়েছে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান। ব্যস... ওখানেই শেষ। বন্ধ হয়ে গেল ভারতে আসার বিমান পরিষেবা। রানওয়েতে পিলপিল করছে মানুষ। বেয়ে বেয়ে উঠে পড়ছে তারা বিমানে। গুলি চলছে। মৃত্যু এখন ওখানে জলভাত... কেউ নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মারা যাচ্ছে, কেউ উড়ন্ত বিমান থেকে মাটিতে পড়ে। পালাতে হবে...। কিন্তু কত হতে পারে সংখ্যাটা? দেশের ৩ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের ২-৩ শতাংশও কি? মনে হয় না। তার মানে বাকি আফগানদের একটা বড় অংশের কি এই দখলে সমর্থন আছে?  ক্ষমতার অলিন্দে আজ প্রশ্ন উঠেছে... অনেক প্রশ্ন। এবং সর্বত্র কোথাও না কোথাও একের সঙ্গে অপরের যোগসূত্র। 
প্রক্রিয়াটা শুরু করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর উত্তরসূরি বাইডেন শুধু শেষ করেছেন পথ চলা। ৩১ আগস্ট ছিল সময়সীমা। তার মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সরে যাবে ন্যাটো বাহিনী। সেটাই করেছে আমেরিকা। কিন্তু বাহিনী সরে যাওয়ার পর আদৌ আফগানিস্তানের সরকার দেশটা চালাতে পারবে কি? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু বাইডেন সরকার খোঁজেনি। তার ফল, ১০ দিনের মধ্যে কাবুলের পতন। বছরের পর বছর আফগানিস্তানে নিযুক্ত আমেরিকার পদাধিকারীরা রিপোর্ট দিয়ে গিয়েছেন... স্বনির্ভর বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠার এদের ইচ্ছেই নেই। তার উপর দুর্নীতি চলছে। আফগান সেনা অফিসাররা হাতে পাওয়া মার্কিন অস্ত্র বিক্রি করে দিচ্ছে ব্ল্যাক মার্কেটে। সেই অস্ত্র যাচ্ছে জঙ্গিদের হাতে... তালিবানের হাতে। কিছু বুড়ো হাবড়া সেনা অফিসার বসে রয়েছে মাথার উপর... যুদ্ধে বা বাহিনী তৈরিতে তাদের কোনও উৎসাহই নেই! বরং তারা ব্যস্ত খুচরো রাজনীতিতে। এই ‘পরিকাঠামো’য় কি স্বাধীন বাহিনী গঠন সম্ভব? উত্তরটা এক কথায়, না। তিন লক্ষ আফগান সেনার মান সিভিক পুলিসের বেশি নয়। তারা হয় পালিয়েছে, না হলে সমর্থন জুগিয়েছে তালিবানকে। মন্দের ভালো বলতে মার্কিন তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত কমান্ডোরা। তাদের সংখ্যা নেহাতই সীমিত। আর সাধারণ মানুষ? আফগান নাগরিকদের একটা বড় অংশের সমর্থন না থাকলে প্রায় ‘রক্তপাতহীন’ ক্ষমতা দখল সম্ভব হতো না। আর তাই কাবুলের থেকে বাকি আফগানিস্তানের চিত্রটা অনেকটা আলাদা। সাংবাদিক-লেখক ম্যাথু আইকিনস ট্যুইট করছেন, ‘কাবুলের পশ্চিম শহরতলি থেকে বেরচ্ছে তালিবান... একের পর এক পুলিস ট্রাকে চড়ে। আর রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে তাদের নামে জয়ধ্বনি করছে শিশুরাও।’
মার্কিন বা ন্যাটো বাহিনীর অত্যাচারের অভিযোগ বারবার উঠে এসেছে আফগানিস্তানের রুক্ষ মাটি থেকে। সেটা কিন্তু তালিবানের ফিরে আসার একটা বড় কারণ। বাইরের দেশের সমর্থন কি ছিল না? শোনা যায়, সম্প্রতি তালিবানের সঙ্গে গোপন বৈঠক হয়েছিল চীন, পাকিস্তান ও রাশিয়ার প্রতিনিধিদের। তারপরই এই আগ্রাসন। এবং সফল আগ্রাসন। চীন ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, তালিবান সরকারের সঙ্গে তারা সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। খুব ছোট্ট সীমান্ত চীনের সঙ্গে আফগানিস্তানের। কিন্তু সেই অংশেই জিনঝিয়াং। অর্থাৎ উইঘুর মুসলিমদের বাস। চীনের দু’চোখের বিষ। আর তালিবানের দুর্বলতা। উইঘুর মুসলিম এবং ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টকে যদি তারা সমর্থন জোগায়, তার জ্বালা ভুগতে হবে চীনকে। সেটা জি জিনপিং কখনও হতে দেবেন না। পাকিস্তানের ইমরান খান সরকার সবসময়ই খানিকটা তালিবানপন্থী। প্রচ্ছন্ন মদত তাদের বারবার দিয়ে এসেছে আইএসআই এবং পাক সেনাবাহিনী। এমনকী পাক অধিকৃত কাশ্মীরে তালিবানকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজও চালিয়ে এসেছে তারা। কাজেই ভারতের সমর্থনে বেড়ে ওঠা এই ‘কাবুলের’ পতনে তারা যে সায় দেবে, সে ব্যাপারেও সন্দেহ নেই। এর নেপথ্যে খানিক সিঁদুরে মেঘও কিন্তু  আছে। বিশ বছর আগে... ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শাসনকালে তালিবান হাত বাড়িয়েছিল বালুচিস্তান এবং খাইবার পাখতুনওয়া প্রদেশের দিকে। রুক্ষ প্রদেশ... কিন্তু স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে তালিবানের জন্য অত্যন্ত লাভজনক। খাইবার যে মারাত্মক এক যোগসূত্র! তাই এই ‘পাস’ ঘিরে টানাপোড়েন চিরকালের। আজ থেকে কত বছর আগে মুজতবা আলি লিখেছিলেন, ‘খাইবারপাসের আশেপাশে কখন যে দাঙ্গাহাঙ্গামা লেগে যায় তার স্থিরতা নেই।’ কাজেই অস্থিরতা ফেরাতে চাইবে না পাকিস্তান। সমর্থন দেবে রাশিয়াও। অর্থাৎ, সঙ্কট ভারতের।
এপ্রিল, ২০২০। সেই থেকেই একে একে ভারতীয় কনস্যুলেট বন্ধ হচ্ছে। আফগানিস্তান থেকে মুছে যাচ্ছে ভারতের প্রতিনিধিত্ব। পড়ে আছে এখনও কাবুল। কিন্তু কতদিন? এর উত্তর এখনও ভারত সরকার জানে না। আর থাকবে কোটি কোটি ডলারের পরিকাঠামো... যা আমাদের করের টাকায় তৈরি হয়েছিল ওদেশে। ভারতের সবচেয়ে বড় ঘাটতি কোথায়? এত বছরেও সরকারিভাবে তালিবানের সঙ্গে মধ্যস্থতার কোনও রাস্তা আমরা তৈরি করতে পারেনি। শোনা যাচ্ছে, কথাবার্তা নাকি শুরু হয়েছে। সেটা কোন স্তরে? তা জানা নেই। আলাপেও অবশ্য সঙ্কটের আবহ কাটছে না। কারণ, সীমান্ত। তালিবান ঘুরে দাঁড়ানো মানে ‘জঙ্গি রাজনীতিতে’ ইন্ধনের পরিমাণ বাড়বে। আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে ঠিকই, তারপরও কিন্তু পাকিস্তান সন্ত্রাসের লালন-পালন চালিয়ে যাচ্ছে। এখনও। আর আমাদের দেশের মাথায় রয়েছে এমন এক সরকার, যাদের বিদেশনীতি মানে নম্বর কুড়োনো। কখনও অন্যদেশের রাষ্ট্রনেতাকে তেল দিয়ে, কখনও ভ্যাকসিন পাঠিয়ে। এটা বিদেশনীতি নয়। 
নন অ্যালাইনড মুভমেন্ট বলে যে একটি বস্তু হয়, তা অধুনা ভারত সরকার জানে কি? জওহরলাল নেহরু শুরু করেছিলেন এই সমঝোতা। তিনি জানতেন, স্বাধীনতা পেলেই হল না। তাকে রক্ষা করতে হবে। যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ ব্রজ টিটো এবং ইজিপ্টের প্রেসিডেন্ট আব্দুল নাসেরের সঙ্গে তাঁর জোট ছিল এই স্বাধীনতা রক্ষার। অলিখিত এক সমঝোতা, যা আমেরিকা, চীন বা রাশিয়া পর্যন্ত সমঝে চলত। নেহরুর দূরদর্শিতা ছিল এমনই। সেই দূরের চোখ এখন নেই। থমকে গিয়েছে বিদেশনীতিও। আফগানিস্তানে তালিবান ঘুরে দাঁড়ানোর পর এখন শুধু সন্ত্রাসের আঁচ লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যৎ আর কী কী সঙ্কট ভারতের জন্য নিয়ে আসবে, তা আন্দাজের বাইরে। ভারত ঘোষিত সন্ত্রাসবাদী বিরোধী। উত্তর এবং পশ্চিমে আমাদের ঘিরে থাকছে এমন তিন শত্রু দেশ, যারা হয় সন্ত্রাসবাদী, না হলে সন্ত্রাসে মদতদাতা। সীমান্ত বাণিজ্যের পরিস্থিতি কোথায় যাবে? চীন যে এর পুরোদস্তুর সুযোগ নেবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এখন এসব ভেবে লাভও নেই। কারণ, পুরোটাই যে শূন্য থেকে শুরু! এরপরও রাজনীতির আঙিনায় চর্চা চলবে আফগানিস্তানে নারীর অধিকার, শরিয়া আইন, বা তালিবান কতটা ভদ্রসভ্য হয়ে ক্ষমতায় ফিরল সে সব নিয়ে। ভারতকে সুরক্ষিত করার জন্য কূটনীতির প্রয়োগ কতটা এবং কীভাবে হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর কি মহামান্য ভারত সরকারের জানা আছে? প্রায় ২০০ ভারতীয় কূটনীতিককে এখনও কিন্তু মোদি সরকার দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। আসলে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, কপালে না থাকলে ঘি, ঠকঠকালে হবে কী?
আবদুর রহমানের সঙ্গে আফগানিস্তানে পরিচয় হয়েছিল মুজতবা আলির। বিদায়বেলাতেও শেষ শুনেছিলেন তাঁরই শেষ কথাটি—‘সপূর্দমৎ’। বিদায়... বিদায় কাবুল। বিদায় ভারতের তেল চুপচুপে বিদেশনীতিকেও।