লক্ষ্য ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন। তাকে পাখির চোখ করে শুক্রবার সলতে পাকানোর কাজ শুরু করে দিল বিজেপি বিরোধী শিবির। মাত্র কয়েকদিন আগে শেষ হওয়া সংসদের অধিবেশনে বিরোধীদের সম্মিলিত ঝাঁঝ দেখেছে গেরুয়া শিবির। সেই রেশ ধরে রেখে এবার সংসদের বাইরে দেশজুড়ে আন্দোলনে নামার কর্মসূচি নিল বিরোধীরা। আগামী ২০ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর রাস্তায় নেমে এক সুরে বিরোধীরা কথা বলবে। কৃষি আইন বাতিল, পেগাসাসের বিচার বিভাগীয় তদন্ত, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ, ১০০ দিনের কাজ বাড়িয়ে ২০০ দিন করা, ভীমা কোরেগাঁও সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় বন্দিদের মুক্তির মতো আপাতত ১১ দফা জ্বলন্ত ইস্যুতে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পথে নামার কথা ঘোষণা করে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে বিরোধী শিবির। দলের সংকীর্ণ গণ্ডি ছাড়িয়ে যে দেশরক্ষা ও গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই বৈঠক—সেই সারসত্যটাই প্রতিফলিত হয়েছে মুখে-মুখে। সন্দেহ নেই লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত আগামী তিন বছর যদি বিজেপি বিরোধী দলগুলি একজোট হয়ে এগিয়ে যেতে পারে তাহলে নিশ্চিতভাবেই নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহের পায়ের নীচের মাটি কেঁপে উঠবে। এমনিতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা কমেছে। বিভিন্ন জনবিরোধী পদক্ষেপের জন্য মোদি ম্যাজিকও আর কাজ করছে না। তাই মানুষের স্বার্থরক্ষায় কেন্দ্রের জনবিরোধী কার্যকলাপের ইস্যুগুলিকে হাতিয়ার করে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী শক্তি এগলে কেন্দ্রের সরকার চাপে পড়তে বাধ্য।
টানা দু’বার বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় মোদি সরকার। মোদি জমানায় দেশে চলছে বিরোধী কণ্ঠরোধের চেষ্টা। সাম্প্রতিক অতীতে কয়েকটি রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলি ভোটে ভালো ফল করলেও গোটা দেশে মোদি বাহিনীকে রুখে দিতে পারবে এককভাবে কোনও দল—এমন রাজনৈতিক শক্তি এখন আর দূরবিন দিয়েও দেখা যায় না। কংগ্রেস দল বিজেপি’র মতো সর্বভারতীয় হলেও নেহরু, ইন্দিরা গান্ধীর উত্তরসূরিদের সেই ‘মিথ’ এখন ভেঙে চুরমার। অগত্যা বাঁচতে গেলে যে একসঙ্গে লড়তে হবে—এই সহজ সত্যটা বুঝেই কোমর বেঁধে জোট গঠনের পথে নেমেছে বিরোধীরা। এই জোট কতটা অস্বস্তিতে ফেলতে পারে পদ্মশিবিরকে তার খানিকটা আঁচ পাওয়া গেছে সংসদের বাদল অধিবেশনে। যেখানে বিরোধীদের সম্মিলিত প্রতিবাদের মুখে সংসদ থেকেছে প্রায় অচল। সংসদের বাইরেও এই লড়াইকে নিয়ে যেতে শুক্রবার সোনিয়া গান্ধীর আহ্বানে বিজেপি বিরোধী ১৯টি দলের নেতানেত্রীরা ভার্চুয়াল বৈঠকে শামিল হয়েছিলেন। বৈঠক সোনিয়া ডাকলেও সন্দেহ নেই সেই চার ঘণ্টার ম্যারাথন আলোচনার কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁর সঙ্গে মাটি ও মানুষের যোগ প্রশ্নাতীত। গেরুয়া শিবিরের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করতে মানুষকে সঙ্গী করে দলীয় স্বার্থকে সরিয়ে রেখেই যে লড়তে হবে—এই বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ঐক্যের সুরটি তিনিই বেঁধে দিলেন। বিজেপি বিরোধী জোটের নেতা কে হবেন তা নিয়ে আসমুদ্র হিমাচলে আগ্রহ তুঙ্গে। জোটের নেতা কে তা এখন কাজের কথা নয়, স্পষ্ট ভাষায় তা বুঝিয়ে মমতা বলেছেন, বিরোধী এই জোটের নেতা কে হবেন ভুলে যান। মানুষই আমাদের নেতা। বলা বাহুল্য, মমতাই এরাজ্যে বিজেপি’কে পর্যুদস্ত করে তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় এসেছেন। এদিনের ভার্চুয়াল বৈঠকে মমতার বক্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়েছে, ক্রমাগত ভাঙতে থাকা কংগ্রেসকে জোটে ছড়ি ঘোরাতে দিতে নারাজ তৃণমূল। শুধু তাই নয়, জোট গড়তে তিনি কোনও ছুঁতমার্গেও বিশ্বাসী নন। তাই বিজেপি বিরোধী সবাইকে এক ছাতার নীচে আনার আহ্বান জানিয়েছেন। দূরদর্শী নেত্রী কেন্দ্রের শাসকবিরোধী জোটের কৌশল নির্ধারণে একটি কোর গ্রুপ গঠনের যে প্রস্তাব দিয়েছেন তাও সমাদৃত হয়েছে বৈঠকে। মোদি মুক্ত ভারত গড়তে দেশরক্ষার স্বার্থটিকে বড় করে দেখার যৌক্তিকতাকে সামনে এনে তিনি যথার্থই মহাজোটের কারিগর হয়ে উঠেছেন।
ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে জোট গঠন এবং জোট সরকার চালানোর ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু কার্যত কোনওক্ষেত্রেই জোট গঠন করে সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা বিশেষ মধুর নয়। বরং বলা যায়, বহু প্রত্যাশা নিয়ে অতীতে যে জোট গঠন হয়েছিল, সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে তা ভেঙেছে তাসের ঘরের মতো। শুক্রবারের বৈঠকেও দেখা গেছে, আম-আদমি, বিএসপি, সিপিআইএম(এল)-র মতো বিজেপি বিরোধী দলগুলিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে গোড়ায় গলদের এই প্রসঙ্গ তুলে মমতা পরিষ্কার বলেছেন, দেশের এই কঠিন সময়ে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। মমতা এসব চাইলেও কাজের কাজ কতটা হবে বা এই জোট আদৌ ২০২৪ সাল পর্যন্ত টিকে থেকে বিজেপি বিরোধী হিসাবে লড়াইয়ে যেতে পারবে কি না তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলির সদিচ্ছার উপর। তার উপরই নির্ভর করবে জোটের ভবিষ্যৎ। যথাসময়ে এর উত্তর মিলবে। তবে মমতা পথ দেখিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এতগুলো দলকে নিয়ে একসঙ্গে চলার কাজটা কঠিন। তবে অসম্ভব নয়।