দেশে করোনা নির্মূল হয়নি। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ভাইরাস সংক্রামিত করেছে ঝড়ের গতিতে। মারণ ব্যাধি আতঙ্কে মানুষের ঘুম ছুটেছে। এমন দমবন্ধ পরিস্থিতেই তো মুখ দেখানোর আদর্শ সময়! তাই আপনি চান বা না চান, প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রীর ছবি আপনাকে দেখতেই হবে। সঙ্গে ‘সদা সত্য কথা বলিবে’-র মতো ভালো ভালো বাণী, গোটা দেশবাসীকে নিশ্চিন্ত করার আশ্বাস। কী সেটা? দেশের প্রতিটি মানুষ টিকা পাবেন ফ্রি-তে। বয়স যাই হোক, সকলের জন্য বিনামূল্যে টিকা দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। নরেন্দ্র মোদির মুখাবয়ব সহ এমন বিজ্ঞাপন দেশের কোণে কোণে পৌঁছে দিতে এই ‘গরিব’ দেশে শুধু এবছরেই খরচ হয়েছে ২০৯ কোটি টাকার বেশি। বিজ্ঞাপনে এত খরচ হচ্ছে অথচ এখন এই দেশের বহু পরিবারে দু’বেলা পেট ভরে অন্নই জুটছে না! আর টিকার অপ্রতুলতা নিয়ে হাহাকার রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে। খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্যই বলছে, ১৩৫ কোটির দেশে এ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজ্যে গড়ে ৪০ শতাংশ টিকা সরবরাহ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে আরও কম, রাজ্যের জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ টিকা পেয়েছে। এই নিয়ে চিঠি-চাপাটি, প্রতিবাদ বিক্ষোভ কম হয়নি। একমাত্র বিজেপি ছাড়া দেশের প্রায় সব বিরোধী দলই প্রতিবাদে সবর হয়েছে। কিন্তু তিনি সব দেখে, বুঝেও প্রতিশ্রুতি দেওয়া বিজ্ঞাপনের আড়ালে হাসছেন!
প্রায় মাস দুই আগের কথা। গত ২১ জুন করোনা টিকাকরণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। তার আগে টিকার দাম নির্ধারণ এবং তা কেন্দ্রের সরবরাহের দাবিতে সোচ্চার ছিল বিভিন্ন রাজ্য। এক্ষেত্রে কেন্দ্রের ভূমিকা, দায়িত্বপালন নিয়ে আদালতেও সমালোচনার মুখে পড়ে মোদি সরকার। তাই বাধ্য হয়ে এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই খোল-করতাল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে কেন্দ্রীয় সরকার। ‘দাওয়াই ভি কড়াই ভি’, ‘সব কো ভ্যাকসিন, মুফত ভ্যাকসিন’, ‘ওয়াল্ডর্স লার্জেস্ট ফ্রি ভ্যাকসিনের ক্যাম্পেন’—প্রধানমন্ত্রীর মুখের ছবিসহ এমন চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপনে ঢেকে দেওয়া হয় খবরের কাগজ, টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া, রেডিও, রাস্তাঘাটের হোর্ডিংয়ের মুখ। কারণ শুরুতে অনেকের মধ্যে টিকা নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধা, ভয় ছিল। সেই ভয় কাটাতেই নাকি এত সাজো সাজো রব! স্বাস্থ্যমন্ত্রকের নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতী প্রবীণ পাওয়ার জানিয়েছেন, কোভিড নিয়ে মানুষকে সচেতন করার বার্তা দিতে ২০২০ সালে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল প্রায় ২০ কোটি টাকার। কিন্তু ২০২১ সালে টিকাকরণ শুরুর পর থেকে জুন পর্যন্ত বিজ্ঞাপনে খরচ হয়েছে ২০৯ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ ফ্রি-তে সকলকে ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রচারকে গুরুত্ব দিতেই মাত্র কয়েক মাসে বিজ্ঞাপনের খরচ দাঁড়িয়েছে ২০০ কোটি টাকারও বেশি! মুখ দেখানো ও ঢাক পেটানোর জন্য খরচের এই রমরমা দেখে চোখ কপালে উঠলেও তা মেনে নেওয়া যেত, যদি তাতে আসল উদ্দেশ্য সাধিত হতো। কিন্তু কোথায় কী? ভ্যাকসিনের অভাবে অনেক রাজ্যকে প্রতিদিন নানা অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। বাংলাসহ বেশকিছু রাজ্য প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরিকাঠামো তৈরি করে রাখলেও টিকার পর্যাপ্ত জোগানের অভাবে প্রায় প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষকে লাইন দিয়েও টিকা না পেয়ে ফিরতে হচ্ছে! টিকার জন্য মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরছে। তথ্য বলছে, বাংলায় ১০ কোটির বেশি জনসংখ্যা হলেও এ পর্যন্ত টিকা মিলেছে ৩ কোটি ৬৫ হাজারের (৩০ শতাংশর) কিছু বেশি। শুধু সরবরাহ কম নয়, নরেন্দ্র মোদির সরকার বেছে বেছে বিজেপি শাসিত রাজ্যকে বেশি টিকা পাঠাচ্ছে বলেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। টিকা নিয়ে চলছে সংকীর্ণ রাজনীতির ধ্যাষ্টামি। কিছুদিন আগেই টিকার জোগান প্রসঙ্গে অভিযোগ করে মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়ের সরকার জানিয়েছে, জনঘনত্বের বিচারে গুজরাতের থেকে কম টিকা পেয়েছে বাংলা। টিকার জোগানের অভাবে কলকাতা শহরেও ভ্যাকসিন প্রদান কেন্দ্র বারবার বন্ধ রাখতে হচ্ছে পুরসভাকে। অথচ ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আতঙ্ক। চিকিৎসকদের মতে, ভ্যাকসিন মৃত্যু হার ও সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে। ঘটনা হল, এ পর্যন্ত দেশে জনসংখ্যার খুব সামান্য অংশই দুটি ডোজ টিকা পেয়েছেন। তাই প্রশ্ন, টিকা প্রদানে ভারত সত্যি কতটা সফল? আসল সত্যটি যতই বিজ্ঞাপনে ঢেকে যাক, টিকাকরণের লজ্জাজনক এই বাস্তব ছবিটা কোনওভাবেই মানা সম্ভব নয়।
তাই এই ব্যর্থতা ঢাকতে কার্যকরী পদক্ষেপ করতে হবে ভারত সরকারকে। মনে রাখা দরকার, ফ্রিতে টিকা কোনও ব্যক্তি বিশেষের দয়ার দান নয়। প্রতিটি ভারতবাসীর টিকার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে দেশের সরকারকে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রেই ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞাপনের বহর অবশ্য তাতে থামছে না। এ যেন অনেকটা গামছা দিয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা! বরং বলা ভালো, লজ্জা ঢাকছে বিজ্ঞাপনে!