উচ্চতর বিদ্যায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় আগ্রহ বাড়বে। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতে আনন্দলাভ হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ... বিশদ
এই কোর্সের একমাত্র লক্ষ্য সাহিত্য তথা সমাজ ও জীবনকে ভালোভাবে বুঝতে শেখা। সাহিত্যের ভালোমন্দের কারণগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করবার পথগুলো চিনে নেওয়া। এবার মুশকিল হল, বাংলা ভাষাটা আমরা মায়ের কোলে বসেই শিখে ফেলি। আবার স্কুলে যাওয়ার আগেই একটু আধটু বাংলা পড়তে শিখে যাই। এমনকী পরীক্ষার পর বা লেখাপড়ার চাপ একটু কম থাকলে বাংলা গল্প-উপন্যাসও হয়তো খুলে বসি। তাহলে ছেলেবেলা থেকে যা সহজাতভাবে পেয়েছি, সেই বিষয়েই স্কুলে একযুগ ধরে রাশি রাশি বানান, ব্যাকরণ, গদ্যপদ্য পড়ে দিব্যি সব লিখতে পড়তে শিখে ফেলার পর উচ্চশিক্ষার বাংলায় আর শেখার কী থাকে?
স্কুলের বাংলা পড়ায় ঝোঁক থাকে মূলত বাংলা ভাষাশিক্ষার উপর আর অবসরের পড়ায় আমরা পেতে চাই সাহিত্য পাঠের আনন্দ। আর উচ্চশিক্ষায় এই দুটোকে শুধু মেলালেই চলবে না। সাহিত্য পাঠ করে আমরা যে আনন্দ পাই তার কারণটাও আমাদের সুনিশ্চিতভাবে জানা চাই। তাই বাংলা ভাষা, তার ব্যাকরণ, শব্দভাণ্ডার ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান থাকাই যথেষ্ট নয়, সাহিত্যের ভালো সমঝদারও হতে হবে। কোনও একটি রচনা কোন কোন উপাদান ও কী উপায়ে সাহিত্য হয়ে-উঠল এই প্রশ্নের মোকাবিলা করে স্নাতক পর্যায়ের পাঠক্রম। পাঠক্রমকে সেইভাবেই ভাগ করা হয়। ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য থেকে প্রতিনিধিস্থানীয় কয়েকটি টেক্সট পাঠ্যতালিকায় নিয়ে আসা হয়, পাশাপাশি পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় সাহিত্যের ইতিহাস ও সাহিত্যবিচারের বিভিন্ন পদ্ধতির সঙ্গেও।
বাংলা পড়ার জন্য
পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সবকটি কলেজ ও বিশ্বভারতী, প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, রবীন্দ্রভারতী ও সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি স্নাতকস্তরে পঠনপাঠন চলে। এছাড়াও নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দূরশিক্ষার মাধ্যমে পঠনপাঠন করা যেতে পারে। একটা বিষয়ে আশ্বস্ত হওয়া চলে যে, বাংলায় উচ্চশিক্ষা লাভের প্রতিষ্ঠানের অভাব বাংলায় নেই এবং তাতে সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রেও খুব বড়সড় বাধা আসে না।
এবারে আমাদের প্রথম কাজ পাঠক্রমটিকে ঠিক ঠিক করে বুঝে নেওয়া। এই সময়ে দাঁড়িয়ে এটা খুব জরুরি, কারণ সাবেক কালের পঠনপাঠনে সম্প্রতি ভালোরকম রদবদল ঘটে গিয়েছে। যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে চোখ বুলিয়েই তা বুঝতে পারি। আগে তিন বছরে দুটো বা তিনটে আলাদা পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীকে সব মিলিয়ে মুখোমুখি হতে হতো মোট ১৫৫০ নম্বরের। তার মধ্যে অনার্স ৮০০। আর এখন সেমেস্টার পদ্ধতিতে তিন বছরে মোট ছয়টি পরীক্ষায় শুধু অনার্সের জন্যই ১৪৫০ নম্বরের মোকাবিলা করতে হবে। এই পদ্ধতিটাকে বলা হচ্ছে চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম (সি.বি.সি.এস)। ১০৫০ নম্বরের নির্ধারিত পাঠ্যসূচির বাইরে ৪০০ নম্বরের পাঠ্যবস্তু আমরা নিজেরাই পছন্দমতো নির্বাচন করে নিতে পারি।
মনে রাখতে হবে আমাদের স্নাতক স্তরের পাঠই পরবর্তী শিক্ষার বুনিয়াদ তৈরি করে দেবে। সেই কারণে প্রথম থেকেই আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি। সবার আগেই আমাদের দরকার একটা ভালো অভিধান, যেখানে বাংলা শব্দের বুৎপত্তি সহ অর্থ দেওয়া থাকবে। দরকার একটা সাহিত্যের ইতিহাস বই। সাহিত্যের বিচার করতে হলে তো তার ইতিহাসটা জানা চাই! এবার পাঠ্য বইগুলো সংগ্রহ করা। হাজার বছরে বাংলা ভাষায় যত সাহিত্য রচিত হয়েছে তার অতি সামান্য অংশই সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সম্ভব। তাই শুধুমাত্র সেই বিশেষ গল্প-উপন্যাসে আটকে থাকলেই চলবে না। ধরা যাক শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্রথম পর্বটি পাঠ্য রয়েছে। তাই বলে কি আমরা কেবল প্রথম পর্বেই আটকে থাকব? আমরা কি শ্রীকান্তর পরবর্তী জীবনকথা জানতে চাইব না? বা শরৎচন্দ্রর অন্য লেখালিখির কোনও খবর রাখব না? একই কথা সবার সম্বন্ধেই বলা চলে।
সিলেবাসে শুধুই প্রতিনিধি স্থানীয় একটি বা দু’টি নমুনামাত্র অন্তর্ভুক্ত থাকে। নমুনা পেরিয়ে সামগ্রিকভাবে সেই রচয়িতা সম্পর্কে জানার জন্য তাঁর অন্য উল্লেখযোগ্য বইগুলির খবর রাখা চাই, রচয়িতার জীবনদর্শন সম্পর্কে যেমন স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার, তেমনই রচনার সমকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আবহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা চাই। এর জন্য ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের ন্যূনতম খবরাখবর রাখা জরুরি। বিগত কয়েক বছরে বাংলা পড়ুয়াদের কাছে এই আন্তর্বিভাগীয় পরিসর ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে। এমনকী অন্য বিষয়ের বিদ্বানরাও বাংলা সাহিত্য বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। এ সব কিছুর পরিচিতির জন্য অবশ্যই যোগাযোগ বাড়াতে হবে বিভিন্ন রকম বইয়ের সঙ্গে। শুধু ব্যক্তিগত সংগ্রহ বা কলেজ লাইব্রেরির উপর ভর করলে চলবে না। এর জন্য অবশ্যই প্রসিদ্ধ কোনও গ্রন্থাগারে যাতায়াত থাকা চাই। মনে রাখতে হবে সাহিত্য-রচনার মতো সাহিত্যপাঠ ও তার সমালোচনাও একটি সৃজনশীল কাজ। শিক্ষার্থী প্রথম থেকেই এই সৃষ্টির আনন্দ পেলে সে নিজেই খুঁজে নেবে তার পথ।
বাংলা পড়ার পর
তিন বছরে তো স্নাতক হয়ে গেলাম। এরপর? পরের ধাপটা আরও সচেতনভাবে বেছে নিতে হবে। এই তিন বছরেই আমরা বুঝে যাব সাহিত্যপাঠ বা সৃজনশীলতার কাজে আমরা আনন্দ পাচ্ছি কি না? বা সাহিত্য নিয়ে চর্চা করেই আমি পরবর্তী জীবন কাটাতে চাই কি না? যদি না চাই তো এই পথের সমাপ্তি এখানেই। বৃহত্তর জীবন সংগ্রামের জন্য অন্য পথ খুঁজে নিতে হবে আমাদের। তা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চাকরি হতে পারে, বা হতে পারে স্বনির্ভর কোনও পন্থা। কারণ স্কুল-কলেজে শিক্ষকতা বা গবেষণা ছাড়া স্নাতকোত্তর শিক্ষার প্রয়োজন প্রত্যক্ষভাবে পড়ে না। কলা বিভাগের যে কোনও শাখার স্নাতক ছাত্রছাত্রীরা সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে যে যে সুযোগ পায়, বাংলার ছাত্রছাত্রীরা তার থেকে বেশি বই কম সুযোগ পায় না। বেশি কারণ সংবাদপত্র, প্রকাশনা সংস্থা ইত্যাদিতে সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদেরই সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি।
আর যারা শিক্ষকতা বা গবেষণায় আসতে চায় তাদের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পঠনপাঠনের প্রস্তুতি নিতে হবে। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বাংলা পড়ার সুযোগ পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন কলেজেও পাওয়া যেতে পারে। এছাড়া রবীন্দ্রভারতী, কল্যাণী, বর্ধমান, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা ও নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত শিক্ষার বন্দোবস্ত রয়েছে।
বাংলায় গ্র্যাজুয়েট হয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষাও যে বাংলাতেই করতে হবে, এরও কোনও মানে নেই। বাংলায় বিএ পাশ করে বাংলা ছাড়াও আরও কয়েকটি বিষয়ে এমএ পড়া যেতে পারে। তাও এই রাজ্যেই। এর মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য, কলকাতা ও সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান এবং কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতি বিদ্যা। এছাড়া পালি, বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ, ফিল্ম স্টাডিজ সহ জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন, লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্সেস-এ স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশোনা এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে, যা আমাদের সামনে খুলে দিতে পারে বিস্তীর্ণ এক পরিসর।
নতুন এই সিবিসিএস পদ্ধতির পাঠ্যসূচিতে এই বিষয়গুলিতে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়, তেমনি প্রায়োগিক শিক্ষার বিষয়, যেমন চিত্রনাট্য রচনা, গ্রাফিক্স ও কম্পিউটারের প্রয়োগ, ডিটিপি-প্রকাশনা ইত্যাদি বিশেষভাবে গুরুত্ব লাভ করেছে, যা এতদিন বাংলা অনার্স পাঠ্যসূচিতে অবহেলিত ছিল। প্রথম থেকে এই সব বিষয়গুলি নজরে রাখলে পরবর্তী কেরিয়ার নিয়ে দুর্ভাবনা থাকবে না।
সোশ্যাল মিডিয়ার বুদ্ধিজীবীরা যতই বাংলা ভাষা ও বাংলা বিদ্যাচর্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হোন না কেন, যে-ভাষায় এখনও পৃথিবীর প্রায় পঁচিশ কোটি মানুষ ভাব বিনিময় করছে, যে ভাষায় প্রায় প্রতিদিন একাধিক বই প্রকাশিত হচ্ছে, সেই ভাষা ও তার সাহিত্যকে ঘিরে গড়ে ওঠা একটা বিদ্যায়তনিক পরিসর অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে না।
(লেখক কাঁথি প্রভাত কুমার কলেজের সহকারী অধ্যাপক)