পিতার স্বাস্থ্যহানী হতে পারে। আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হবে না। পঠন-পাঠনে পরিশ্রমী হলে সফলতা ... বিশদ
আপনি নিখিলেশের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সে অক্সফোর্ড ফেরত এবং আপনি মেদিনীপুরে বড় হয়েছেন। অপর্ণা সেন বলছিলেন, ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে আপনাদের দু’জনেরই নাকি একটা ভয় ছিল। যদিও আপনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করেছেন। কীভাবে পুরো বিষয়টা সামলেছেন?
শুধুমাত্র ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে নয়, নিখিলেশ চরিত্রের অন্যান্য দিক যেমন, তার পরিবার, সংস্কৃতি মনস্কতা, পড়াশোনা, রাজনৈতিক বীক্ষা এই কোনও কিছুর সঙ্গেই আমার কোনও সম্পর্ক নেই। ছোটবেলা থেকে আমি সম্পূর্ণ একটা অন্য জীবনে বড় হয়েছি। সেখান থেকে নিখিলেশ অনেক দূরে। একটা মানুষের বাংলা বলা দিয়েও তো সেই মানুষটা কীরকম বোঝা যায়। পুরোটাই রিনাদির প্রশিক্ষণে করতে পেরেছি। রিনাদি নিজে বাংলা, ইংরেজি এবং হিন্দিও অসাধারণ বলতে পারেন। উনিই আমাকে এবং তুহিনাকে ভাষার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আমি রিনাদির উপর ভরসা করেছিলাম। রিনাদিকে বলেওছিলাম, আমি কি ওটা পারব? আমার বাংলা মাধ্যম স্কুল। নাটক করার ক্ষেত্রে ইংরেজি পড়ার সময় অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্য, খবরের কাগজ পড়ে যে ভাষাটিকে রপ্ত করে নেব, সেরকম তো হয়নি। বাংলা কথার মধ্যে কিছু ইংরেজি বলতে পারি। সিউডো স্মার্টনেসের ক্ষেত্রে যেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইংরেজিতে লেকচার দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই, ডিকশনও দুর্বল। ইংরেজি কথাগুলো রিনাদি আমাকে রাতে হোয়াটসঅ্যাপ রেকর্ড করে পাঠাতেন। শ্যুটিংয়ের অনেক আগে এসব হয়েছে। আমি আবার ওগুলো প্র্যাকটিস করে পাঠাতাম। উনি আবার ঠিক করে দিতেন। সবমিলিয়ে এই প্রক্রিয়াটা প্রায় তিন-চার মাসের ছিল।
গৌরী লঙ্কেশ, সুজাত বুখারির হত্যাকাণ্ড এই ছবি তৈরি করতে গিয়ে অপর্ণা সেনকে অনেকখানি অনুপ্রাণিত করেছে। মব লিঞ্চিং, পপুলিস্ট রাজনীতির আগ্রাসন, ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে এই বিষয়গুলো আপনাকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছে?
(খানিকটা ভেবে) ওরকম হয় না। পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গিকে তো একটা বোঝাপড়ার মধ্যে নিয়ে আসতেই হবে। চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে এই বিষয়টা খুব একটা নির্ভর করে তা ঠিক নয়। আমি একজন ন্যাশনালিস্ট মানুষ হলেই যে, ন্যাশনালিস্ট লোকের চরিত্রে ভালো অভিনয় করব তার কোনও মানে নেই। কিন্তু চরিত্রের নিজস্ব রাজনীতিটাকে বুঝতে হবে। চারটে মব লিঞ্চিং বেশি হলে, আমি যে অন্যরকম একটা অভিনয় করে আসব, এমনটা নয়। ওগুলো পরিচালকের চিন্তা। অভিনেতাকে চরিত্রে মনোযোগ দিতে হয়।
আপনি একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ। অপর্ণা সেনের আগের ছবিতেও অভিনয় করেছেন। ছবি নিয়ে আপনাদের মধ্যে তাত্ত্বিক আলোচনা হয়?
সেটা হয়। কারণ, এই ছবির চিত্রনাট্য আমি অনেক আগে শুনেছি। তখন আমার অভিনয় করার কথা ছিল না। রিনাদি একটা সময় দেখেছেন, এখনও দেখছেন। দু’টো প্রজন্মের কথা হয়। তিনি তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা বলেন। আমি এখনকার কথা বলি। সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়টা তো আমরা নিজেদের মতো বোঝার চেষ্টা করি। সেই আদান-প্রদানটা আমরা খুব উপভোগ করি। এই আলোচনাগুলো প্রত্যক্ষভাবে না করলেও, পরোক্ষভাবে ‘ঘরে বাইরে আজ’-এর মতো একটা ছবি করতে সাহায্য করেছে।
কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা যাচ্ছিল, আপনি আশুতোষ কলেজের অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। আর আপনাকে দেখেই তরুণদের মধ্যে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। মনে রাখতে হবে, আপনি কিন্তু বড়পর্দায় তুমুল নাচ করা অভিনেতা নন। সাধারণত সেইসব অভিনেতাদের এমন ভক্তকুল দেখা যায়। আপনার এই জনপ্রিয়তার এক্স ফ্যাক্টর কী? ভেবেছেন কোনওদিন?
এই জায়গা থেকে এরকম একটা প্রশ্ন আসতেই পারে। আমি ভেবেওছি। সত্যিই কিছু বুঝতে পারিনি। একটা বিষয় বলতে পারি, এখনও আমার মধ্যে ফ্রেশ ব্যাপারটা আছে। আমার ধারণা এটা একটা কারণ হতে পারে। দু’তিন বছরের মধ্যে এসব কেটে যাবে।
তাই? কেটে যাবে?
সে তো আর চিরকাল থাকে না। অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খানের থাকে। আমাদের এখানে বুম্বাদার হতে পারে। আবিরদার দীর্ঘদিনের কেরিয়ার, তার ক্ষেত্রেও বিষয়টা অনেকদিনের। আমি তো মূলত চরিত্রাভিনেতা। ভালো বাংলা বলে, ফর্সা, লম্বা, ঢেউ খেলানো চুল হলে বাঙালির ভালোই লাগে। সেই কারণে কাটতি রয়েছে। মহিলাদের মধ্যেও রয়েছে। মাঝে মধ্যে শুনতে পাই, চিন্তাশীল মানুষদের কাছে আমি খুব পছন্দের। চিন্তাও তো এখন বহুমুখী। এই আপনাকে বাড়ির কাজের লোককে নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে, তারপরেই গরুকে নিয়ে কে কী বলল, তারপরেই গ্যাসের দাম বাড়ল, তারপরেই সিনেমা দেখার চিন্তা চলে এল। এই অসম্ভব বদলাতে থাকা চিন্তায় আমার এই চিন্তাশীল ইমেজ কতদিন থাকে দেখা যাক।
গোটা বিষয়টাকে তো আপনি উপভোগ করেন? খ্যাতি চলে যাওয়ার ভয় হয় না কখনও?
নিশ্চয়ই উপভোগ করি। তবে প্রতিপালন করি না। আর ভয় কেন করবে? আমি তো আর ফেমটাকে এক্সপ্লয়েড করছি না। কখনওই কাজে লাগাই না। ফিল্ম প্রচার করতে গিয়ে আশুতোষ কলেজে গিয়ে চিত্কার শুনলাম। আমি কিন্তু চিত্কার শুনতে যাইনি। দু’বছর পর যদি চিত্কার না হয়, আমি কী করব? ফিল্ম প্রমোট করে চলে আসব। আমি তো আর অভ্যাস বানিয়ে ফেলছি না। যেদিন আমার থিয়েটারের শো ছিল, আমি তো আর বাউন্সার নিয়ে ঘুরে বেরাইনি। সবার সঙ্গে গ্রিন রুমে কাজ করেছি। এই খ্যাতিটাকে কতটা গায়ে মাখছি সেটাই দেখার। আমি একটা ছোট গাড়ি নিয়ে ঘুরি, ব্রহ্মপুরে থাকি। সেখানে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কাছাকাছি কেউ থাকেন না। আমার খুব পছন্দের ছোট একটা ফ্ল্যাট, সবার মতোই ডাল-ভাত-রুটি-চা খাই। আমি জীবনটাকে বেশ সাধারণের মধ্যেই বেঁধে রেখেছি। কাজেই আমার মনে হয় না, খুব একটা অসুবিধা হবে।
আপনার এই জনপ্রিয়তার প্রতিফলন কি থিয়েটারে দেখতে পাচ্ছেন?
ইদানীং তো খুব হচ্ছে। আমার থিয়েটার হলেই বেশ তাড়াতাড়ি টিকিট বিক্রি হচ্ছে।
এটা তো ভালো দিক।
আপাতদৃষ্টিতে ভালো। আমাদের থিয়েটারে তো এখনও সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে সরাসরি কথা বলা হয়। আমি একটু লক্ষ্য করেই বলছি, মুশকিল হল লোকে যেহেতু আমাকে দেখতে আসছে তাই বিষয়বস্তুর দুর্ভাগ্য হচ্ছে। ধরা যাক, একটা ভরা অডিটোরিয়ামে ৪০ শতাংশ মানুষ আমাকে দেখতে এসেছেন। শোয়ের পরে আমি বুঝতে পারছি, তারা খুব একটা বিষয়বস্তু নিয়ে আগ্রহী নয়। তাঁরা শুধু আমাকেই দেখতে এসেছেন। আমি শেষ যে নাটকটা করলাম ‘পন্তু লাহা ২.০’, সেখানে জোরালো রাজনৈতিক বক্তব্য আছে। তরুণরা শোয়ের শেষে এসে সেলফির অনুরোধ করছে। নাটকটাতে কিন্তু খুন, ধর্ষণ, জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিজিম নিয়ে কথা ছিল। ওরা সবটা গিলে ফেলেছে। দু’আড়াই ঘণ্টা শুধু একটা সেলফি তোলার জন্যই অপেক্ষা করল। অন্য নাটকের ক্ষেত্রেও একই। বাণিজ্যিকভাবে বিষয়টা ভালো। কিন্তু বাইরের খোলসটা খুলে ফেললেই কিছু নেই। আমাদের পরের প্রজন্মকে দেখছি থিয়েটারের বিষয়বস্তু নিয়ে বেশ উদাসীন। নেটফ্লিক্স দেখছে, নিজেদের বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
অর্থাৎ না চাইতেও আপনি একটা পপুলিস্ট কালচারের অংশ হয়ে গিয়েছেন?
চাইব না কেন? আমি চাওয়া না চাওয়ার কে! আমি তো একটা পপুলার মিডিয়ামে রয়েছি। সেখান থেকে আমাকে একদম পপুলিস্ট বলবেন না, এসব আমি বলার কে? অঞ্জন চৌধুরীর ছবি তো পপুলার। তার মধ্যে আছে কী? সেই তো কনটেন্ট। তখন বাজেট নেই। উত্তমবাবু মারা যাওয়ার পরে ইন্ডাস্ট্রি ধুঁকছে। আলুর গুদামে পর্দা টাঙিয়ে ছবি দেখানো হচ্ছে। সেই কনটেন্টের জন্যই তো মানুষ দেখেছে। গণনাট্য, নবনাট্য, তাঁদের কাছে কনটেন্ট ছাড়া কী ছিল? সেটা এখন মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি, এর পিছনে সোশ্যাল মিডিয়ার ঘাতক প্রভাব রয়েছে। সেটা যদিও এককথায় বলা যায় না। সোশ্যাল মিডিয়া একা দায়ী নয়। সবটাই ফরম্যাট। তুমি কোথায় বসে আছ সেটা বড় বিষয়, তুমি কী, সেটা প্রশ্ন নয়। এটা খুব সমস্যা। আরও একটা হচ্ছে, ভার্চুয়াল উপস্থিতি। আমি দেখেছি, সেলফি না তুলতে পারলে যেন মরে যাবে। নিজে হয়তো ১৪টা লাইক পায়, আমার সঙ্গে ছবি দিয়ে ২৮টা পেল। ভার্চুয়াল উপস্থিতিটা সেদিনের জন্য ভালো হয়। এটা একটা অসুখের মতো।
আপনি তো বহুদিন সোশ্যাল মিডিয়াতে ছিলেন না।
এখন আমি ফেসবুক দেখি। আমার একটা পেজ আছে। একটা সময় আমি বুঝলাম, এটা না দেখাটা আমাকে বিরাট পিছিয়ে দিচ্ছে। সমাজকে চিনতে পারছি না। আমার অর্ধেক সমাজ তো ওখানে রিঅ্যাক্ট করে। দেখার পর বুঝলাম, এ তো দুরন্ত জায়গা। এর থেকে বড় সার্কাস আর পৃথিবীতে হয় না। যতই আমি রিঅ্যাক্ট না করি, আমিও তো ওটার অংশ। একজন অভিনেতাকে ওটা দেখতেই হবে।
অদ্ভুত মেসেজ পান?
প্রচুর। এই তো কালীপুজো না ভাইফোঁটার দিন একজন বলল, আত্মহত্যা করব। সাত-আটখানা নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপ করছে। ব্লক করে করে পাগল হয়ে যাচ্ছি। তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি বললাম, আমি তো আপনাকে চিনি না, কী কথা বলব? সে উত্তর দিচ্ছে, সেলিব্রিটিরা কি এরকমই হয়? আমি বললাম, আমি এখন ব্যস্ত। শুনেই বলছে, আমি আত্মহত্যা করব।
শেষপর্যন্ত কী হল?
কী আবার হবে! কিছুই হল না। আপনাকে বুঝতে হবে, ওইদিকের মানুষটারও তো টেনাসিটি বলে কিছু নেই। আমার প্রতি যে ভালোবাসা বা ভালোলাগা, সেটা তার নিজস্ব পাগলামো। আমি সেখানে নেই। আমার জায়গায় কাক, এন্টেনা সবাইকে নিয়েই সে এরকম করতে পারে।
আপনার তো নাকি বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে গিয়েছে।
না ঠিক হয়নি। পরের বছর জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি।
অনেকে বলছে, রেজিস্ট্রি পেপারের উপর আপনি যে সই করবেন, ওটা আসলে অনেক মহিলার বুকের উপর ছুরি চালানো হবে।
আমার মনে হয় না। এখনকার মহিলারা এত ওল্ড স্কুল নয়। (হাসতে হাসতে) বাজার ভরা পরকীয়া, সেখানে একজনের বিয়ে হলে কিচ্ছু হবে না। তাহলে শাহরুখ খানের ফ্যান কবে কমে যেত। এসব নিয়ে আরও অনেক থিওরি আছে। সলমন খান নাকি এই কারণে বিয়ে করেননি। যদিও আমি দেখেছি, সলমনের পুরুষ ফ্যানের সংখ্যা অনেক বেশি।
আপনার বিয়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজ যদি ইন্ডাস্ট্রির কাউকে দিতে হয়, কোন কাজটি কাকে দেবেন?
আমার বিয়েতে কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজই নেই। শুধু আসা, খাওয়া আর বাড়ি চলে যাওয়া। কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান নেই। আমার নিজের ইচ্ছা, পাজামা-পাঞ্জাবি পরে সকালবেলা ফ্ল্যাটে চাবি দিয়ে বেরব আবার রাতের বেলা ঢুকে পড়ব। বিয়ে মানে ওসব ঢালাও আয়োজন বিশ্বাসও করি না, ভালোও লাগে না।
অনেকেই বলে, আপনি নাকি সবসময় ‘ক্যারেক্টার’-এ থাকেন। ‘শব্দ চয়ন’ করে কথা বলেন। যা নাকি আরোপিত এবং বাস্তবের থেকে অনেক দূরে।
বাস্তবটা কী? এটার মানে কী? কোনটা আরোপিত? যে বা যাঁরা বলেছেন, তাঁদের একটু পরিস্কারভাবে বলতে বলুন। বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। এটাই আমার স্বকীয়তা। আমি কথায় দ্যোতনা বলি, অন্তর্ঘাত বলি, অভিঘাত বলি। এটাই তো আমার চরিত্র। এটা যদি আরোপিত হয়, তাহলে আরোপ ছাড়া কী?