ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
সিস্টার-দিদিমণির কথা মনে ধরেছিল আকোয়োর। আকোয়ো ডেমোক্রাটিক রিপাবলিক অব কন্গো’র বাবাগুলু নামে এক প্রত্যন্ত গ্রামের জেলে। সুজলা-সুফলা এই গ্রামে প্রকৃতির অকৃপণ দানে রয়েছে সবুজের সমারোহ। খরস্রোতা নদী ওনানে বয়ে চলেছে এই গ্রামের মাঝ বরাবর। নদীর মাছ শিকার করে ভালই আয় হয় আকোয়োর। এছাড়া আছে ঊর্বর কৃষিক্ষেত্র,
জঙ্গলের ফলমূল, কাঠ। কোনও কিছুরই যেন অভাব নেই এই গ্রামের মানুষের। অথচ এরই মাঝে নেমে এসেছে প্রকৃতির এক অভিশাপ। এক অদ্ভুত অন্ধত্ব রোগ।
নার্স-দিদি বলছিলেন খরস্রোতা নদীতে ডিম পেড়ে বংশ বৃদ্ধি করে সাইমুলিয়াম মাছি (চলতি নাম ব্ল্যাক ফ্লাই) ।
এই মাছির কামড়েই মানুষের শরীরে প্রবেশ করার আশঙ্কা থাকে অনকোসারকা ভলভুলাস নামে ফাইলেরিয়া জাতীয় এক পরজীবী প্রাণীর লার্ভার। মানবদেহের ত্বকের নীচে বড় হয় এই লার্ভা। পূর্ণাঙ্গ অনকোসারকায় পরিণত হয়ে ছোট ছোট গুটি তৈরি করে জীবনচক্র চালিয়ে যায় বছরের পর বছর। স্ত্রী অনকোসারকা থেকেই উৎপন্ন শিশু পরজীবী ( মাইক্রোফাইলেরিয়া) রক্ত জালিকার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে। মানুষের চক্ষু গোলকে পৌঁছে প্রদাহের সৃষ্টি করলে আংশিক বা সম্পূর্ণ অন্ধত্বের (রিভার ব্লাইন্ডনেস) শিকার হয় মানুষ। নদীর কাছাকাছি গড়ে ওঠা গ্রামগুলোর বাসিন্দাদেরই হয় এই রোগ। এই সব গ্রামগঞ্জের আবালবৃদ্ধবণিতাদের বছরে একবার বা দু’বার আইভারমেক্টিন নামে একটা ওষুধ প্রয়োগ করে প্রতিরোধ করা যায় ‘রিভার ব্লাইন্ডনেস’। সরকার গ্রামগুলোতে পৌঁছে দেয় এই ওষুধ। মুশকিল হল, ওষুধ বিতরণের লোক নিয়োগ হয় না অর্থাভাবে বা সদিচ্ছার অভাবে। বিভিন্ন গ্রামগুলোয় আইভারমেক্টিন বিতরণ তাই স্বেচ্ছাসেবক নির্ভর। নার্স দিদির কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের অবসর সময়ে স্বেচ্ছাসেবকের কাজে যোগ দেয় আকোয়ো। নিজের ও আশপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামে ওষুধ বিতরণ আর সচেতনতা বাড়ানোর কাজটা বেশ মনোযোগ দিয়েই করতে থাকে সে। এই কাজে বেড়িয়ে মাঝে মধ্যে ব্ল্যাক ফ্লাই- এর কামড়ও খেয়েছে সে। কিন্তু ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসে সরকারের ওষুধ সরবরাহ। এদিকে অদৃষ্টের পরিহাসে আকোয়োর শরীরে দেখা দেয় অনকোসারকার গুটি। দুশো মাইল দূরে শহরে গিয়ে চিকিৎসা করার সামর্থ্যও এখন নেই আকোয়োর। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সম্পূর্ণ অন্ধ ও কর্মহীন হয়ে পড়ে সে। তার স্কুলছুট ছেলে আইতো বাবার দেখাশোনার জন্য চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়। সমস্ত সংসার চলে আকোয়োর স্ত্রী’র সামান্য রোজগারের ওপর। এদিকে আইতোর শরীরেও দেখা দিয়েছে অনকোসারকার গুটি। আকোয়ো জানে ছেলের জন্যও অপেক্ষা করে আছে তারই মতো এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ। অথচ, নিজের অভিজ্ঞতায় সে জানে, আইভারমেক্টিনের বাৎসরিক কয়েকটা ডোজ বদলে দিতে পারত এই সংসারের হাল।
এই ঘটনা এই শতাব্দীরই প্রথম দশকের। এমনকী ২০১৫ সালের আগে পর্যন্ত মধ্য আফ্রিকার বিরাট অংশ ও ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটা দেশে এই ঘটনা ছিল অতি পরিচিত। সেই সময় সারা বিশ্বে অনকোসারকা রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি, যার মধ্যে আট লক্ষ মানুষ ছিলেন রিভার ব্লাইন্ডনেস- এর শিকার। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আইভারমেক্টিন চিকিৎসায় চিত্রটা এখন অবশ্য অনেকটাই বদলে গিয়েছে।
১৮৭৪ সালে জন ও’নীল নামে এক আইরিশ সার্জেন প্রথম অনকোসারকা ভলভুলাস নামে পরজীবীর উল্লেখ করেন।১৮৭৪ সালে বর্ণিত অনকোসারকা ঘটিত ত্বকের রোগই যে রিভার ব্লাইন্ডনেস-এর কারণ তা ১৯১৫ সালে প্রথম জানান গুয়েতামালা চিকিৎসক রোডলফো রোবলস্। পরবর্তীকালে ব্ল্যাক ফ্লাই-এর বংশবৃদ্ধি রোধে ডিডিটি প্রয়োগ করে শুরুতে সাফল্য এলেও অচিরেই ডিডিটি রেজিস্টেন্ট হয়ে পড়ে ওই মাছি। অবস্থা হতে থাকে জটিল।
তবে ১৯৭৪ সালে আশার আলো দেখতে পাওয়া যায়। ওই বছর রিভার ব্লাইন্ডনেস-এর ওষুধ হিসেবে ‘আভেরমেকটিন’ যৌগটি প্রস্তুত করা হয় জাপানে জন্মানো এক বিশেষ প্রজাতির ঘাসে লেগে থাকা স্ট্রেপটোমাইসেস জাতীয় ব্যাকটেরিয়ার কালচার থেকে। এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবেই ২০১৫ সালে নোবেল পুরস্কার পান সাতোসি ওমুরা ও উইলিয়াম ক্যাম্পবেল।
পরবর্তীকালে হিসেব করে দেখা যায় বছরে দু’বার ব্ল্যাক ফ্লাই অধ্যুষিত এলাকায় আপামর জনসাধারণের ওপর একটানা ১৫ থেকে ১৬ বছর ওই ওষুধ প্রয়োগ করা হলে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হবে রিভার ব্লাইন্ডনেস রোগ। ১৯৮৭ সালে আইভারমেকটিন প্রস্তুতকারক এক বহুজাতিক সংস্থা ঘোষণা করে রিভার ব্লাইন্ডনেস রুখতে যে কোনও সংস্থাকে যতদিন এবং যত পরিমাণ আইভারমেকটিন দরকার তা বিনামূল্যে সরবরাহ করবে তারা। বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুত সংস্থার দ্বারা মানবকল্যাণে এটাই সম্ভবত মহত্তম অঙ্গীকার। ১৯৮৮ সাল থেকে গত দশক পর্যন্ত, ‘হু’ এবং নানা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার ব্ল্যাক ফ্লাই অধ্যুষিত এলাকা থেকে প্রায় নির্মূল করা গেছে অনকোসারকা ঘটিত রিভার ব্লাইন্ডনেস রোগ। (আধুনিক কালে অবশ্য আইভারমেকটিন ছাড়া, মক্সিডেক্টিন ও ডক্সিসাইক্লিনও ব্যবহৃত হয়ে থাকে এই রোগে)।
তবে সাফল্যের ঊজ্জ্বল অধ্যায়ের নীচেও কিন্তু রয়েছে কালো ছায়া। শুরুতে আইভারমেকটিন ব্যবহার করা হয়েছিল পশুদের কৃমিরোগ ও মানবদেহে স্কেবিস রোগের চিকিৎসায়। অনকোসারকা রোগে সাফল্যের পর বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিভিন্ন ভাইরাস ঘটিত রোগেও এই ওষুধের উপকারিতা পরিলক্ষিত হয়। তাই করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই, কোভিডের চিকিৎসায় আইভারমেকটিন ব্যবহার করা হতে থাকে বিক্ষিপ্তভাবে।
আমেরিকার ড্রাগ কন্ট্রোল সংস্থা ২০২০-এর মে মাসে কেবলমাত্র ল্যাবরেটরিতে কোভিড গবেষণায় আইভারমেকটিন ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। একটি সংস্থা আইভারমেকটিন সংক্রান্ত বিতর্কিত এক গবেষণাপত্রও প্রকাশ করে। এইরকম দুই-একটি প্রমাণের ওপর নির্ভর করেই পেরু সরকার প্রথম আইভারমেকটিন তাদের দেশের কোভিড চিকিৎসায় প্রয়োগ করার কথা ঘোষণা করে গতবছর জুন মাসে। তাদের অনুসরণ করে ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা ও অন্যান্য কয়েকটি দেশ। অতিমারীর প্রকোপে বিভ্রান্ত জনগণ ‘যেন তেন প্রকারেণ’ আইভারমেকটিন খাওয়া শুরু করে। বাজার থেকে নিঃশেষ হয়ে যায় আইভারমেকটিন। কেউ কেউ পশুদের জন্য প্রস্তুত আইভারমেকটিন ট্যাবলেট-ইঞ্জেকশনও (উচ্চ মাত্রার) গ্রহণ করেন। এরপর ইঞ্জেকশনের জায়গায় ফোসকা পড়া ও পাচকতন্ত্রের নানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হন বেশ কিছু মানুষ। দেশে বিদেশে তীব্র সমালোচিত হয় পেরু সরকার। আমেরিকা ঘোষণা করে, আইভারমেকটিন মানুষের চিকিৎসায় প্রয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে অল্প দামি এই ওষুধের নিরীক্ষিত গবেষণা (অবজারভেশনাল স্টাডি) চলতে থাকে। তবে স্টেরয়েড, অক্সিজেন, ব্লাড থিনার ও সর্বোপরি ভ্যাকসিনের প্রভূত সাফল্যের পাশে এখনও সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করা যায়নি আইভারমেকটিনের উপকারিতা।