ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
হৃৎপিণ্ডে অক্সিজেন যুক্ত রক্ত পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে করোনারি আর্টারি। মুশকিল হল, অনেক সময় এই ধমনিগুলির মধ্যেও কোলেস্টেরল, অন্যান্য ফ্যাট, ক্যালশিয়াম সহ বিভিন্ন যৌগ জমে যেতে পারে। একে বলে প্লাক। প্লাক রক্তচলাচলে সমস্যা তৈরি করে। হার্টে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত পৌঁছয় না। বিশেষত, রোগী যখন পরিশ্রম করেন। মানসিক উত্তেজনার সময়ও রক্তের ঘাটতি তৈরি দেখা দেয়। ফলে হৃৎপিণ্ডের কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। দেখা দেয় বুকের চাপ বা ব্যথা, হাঁপ ধরা, শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা।
যদি কোনও প্লাকে জটিলতা দেখা দেয় বা সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে যায়, তখন হার্ট অ্যাটাক হয়। হতে পারে মৃত্যুও। এমন জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতেই এসেছে নানাবিধ ওষুধ, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি ও বাইপাসের মতো চিকিৎসাপদ্ধতি।
একনজরে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি
এক্ষেত্রে কব্জি বা কুঁচকির শিরার মধ্যে একটি নল (ক্যাথিটার) প্রবেশ করিয়ে নলটিকে হার্টের ব্লকেজের কাছে আনা হয়। এরপর ধমনির ওই সরু অংশে নলটির সাহায্যে একটি বেলুন ফোলানো হয়। এভাবে ধমনির ওই সরু হয়ে যাওয়া অংশটি প্রসারিত হয়। এরপর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই অংশে তারের জাল (স্টেন্ট) বসিয়ে দেওয়া হয়। ফলে ধমনিতে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়।
একনজরে বাইপাস
রাস্তার যানজট কাটাতে যেমন বাইপাস রোড ধরতে হয়, ঠিক তেমনটাই হয় বাইপাস সার্জারির ক্ষেত্রেও। এই সার্জারিতে শরীরের অন্য অংশ থেকে ধমনি বা শিরা কেটে এনে হার্টের ধমনির ব্লকের পরে জুড়ে দেওয়া হয়। ফলে ব্লককে বাইপাস করে নতুন বসানো ধমনি বা শিরার মধ্যে দিয়ে রক্ত বয়ে যায়। রক্তচলাচল হয়ে পড়ে স্বাভাবিক।
অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি না বাইপাস?
বহুদিক বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথমেই বলি, করোনারি আর্টারিজনিত সমস্যা মূলত দুই রকম— অ্যাকিউট ও ক্রনিক।
অ্যাকিউট রোগ— রোগীর হার্ট অ্যাটাক হলে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়। এই অবস্থায় সময়ের সদ্ব্যবহার খুবই জরুরি। দ্রুত চিকিৎসা করতে হয়। এই সময়ে সবথেকে বেশি প্রাধান্য পায় উপযুক্ত ওষুধের ব্যবহার। প্রয়োজন হলে এবং সুযোগ থাকলে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি-স্টেন্টিং করা যেতে পারে।
ক্রনিক রোগ— ক্রনিক পর্যায়ে মূলত দুই ধরনের চিকিৎসা হয়— ১. শুধুমাত্র ওষুধে চিকিৎসা ২. ওষুধ ও রিভাস্কুলারাইজেশন (অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টি, বাইপাস)। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসক ঠিক করেন, রোগী কি ওষুধেই ভালো থাকতে পারবেন নাকি রিভাস্কুলারাইজেশন জরুরি? তা রোগীর জীবনযাত্রার কতটা উন্নতি করবে? তাঁকে কি প্রাণ সংশয় থেকে বাঁচানো যেতে পারে? আয়ু বাড়ানো কতটা সম্ভব? রিভাস্কুলারাইজেশন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরই কোনও রোগীর ক্ষেত্রে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি না বাইপাস কোনটি বেশি উপকারী, এই বিষয়টি দেখা হয়। তা সাধারণত ঠিক করেন একজন হার্ট বিশেষজ্ঞ। সিদ্ধান্ত গ্রহণ জটিল হলে কার্ডিওলজিস্ট, হার্ট সার্জেন, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট সহ হার্ট টিম সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সাধারণত চিকিৎসকরা এই বিষয়গুলির খেয়াল রাখেন—
এতে রোগীর হার্ট সহ সার্বিক জীবনযাত্রার কতটা উন্নতি হতে পারে। অসুখের পরিস্থিতি কতটা জটিল ইত্যাদি। কয়েকটি স্কোরিং সিস্টেমের উপরও নির্ভর করা হয়। কখনও এর বাইরেও উত্তর খুঁজতে হয়।
কোনটি করলে বিপদ এড়িয়ে সবথেকে ভালো ফল মিলতে পারে। ভালো ফল বলতে প্রাণ সংশয় কাটানো, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ইত্যাদি বোঝানো হচ্ছে।
রোগ কতটা জটিল, এই বিষয়টিও বিচার্য। সহজে বলতে গেলে, একটি ধমনিতে সমস্যা থাকলে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করা যেতে পারে। অপরদিকে একাধিক শিরায় অনেকগুলি ব্লকেজ থাকলে বাইপাসের কথা ভাবা হয়ে থাকে।
ব্লকটি কেমন, কোন শিরায়, সেখানে ক্যালশিয়াম কতটা জমে রয়েছে— এগুলিও দেখা হয়।
বয়স ও ফিটনেসও বিচার্য বিষয়। বহু রোগী বাইপাস ও অ্যানেস্থেশিয়ার ধকল নাও সইতে পারেন।
করোনারি আর্টারির সমস্যা থেকে হার্টের পাম্প করার ক্ষমতা অনেকটা কমে গেলে বা হার্ট ফেলিওর হলে সার্জারি করলে ভালো ফল মেলে।
রোগীর অন্য কী অসুখ রয়েছে তার উপরও অনেককিছু নির্ভর করে। যেমন— শ্বাসনালী ও ফুসফুসের ক্রনিক সমস্যা থাকলে অ্যানাস্থেশিয়া অনেক রোগীর ক্ষেত্রে ঝুঁকির কারণ হতে পারে। এমন ক্ষেত্রে বাইপাস এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে। আবার কিডনির অসুখ থাকলে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার আগে ভাবতে হয়। এছাড়াও ডায়াবেটিস থাকলে নানান জটিলতা হতে পারে। তাই এই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়। তবে এগুলি কয়েকটি সাধারণ মতামত মাত্র। এভাবে কোনও বিধান দেওয়া যাবে না। পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। পরিশেষে বলি, বাইপাস বা অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি— এই দুই পদ্ধতির মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। দুইয়েরই উদ্দেশ্য রোগীকে সুস্থ করে তোলা। তবে মনে রাখবেন, শুধু এগুলি সম্পূর্ণ রোগমুক্তি দিতে পারবে না। জীবনযাত্রা পরিবর্তন ও নিয়মিত ওষুধ খাওয়াও অত্যন্ত জরুরি।
কখন অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি?
ধরা যাক কারও হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। রোগীকে ঘণ্টা দু’য়েকের মধ্যে হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। এমন ক্ষেত্রে অ্যাঞ্জিওগ্রাম করে দেখা গেল একটি রক্তবাহী ধমনির প্রধান অংশে ব্লক বা বাধা রয়েছে। এক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করে ধমনিতে স্টেন্ট বসিয়ে ব্লক খুলে দেওয়াই দস্তুর। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় প্রাইমারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি। এটি বহু মানুষের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে।
একটিমাত্র ধমনিতে ব্লক থাকলেই অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করাতে হবে এমন নয়। দেখতে হবে ওই ব্যক্তির অন্য কোনও সমস্যা উদ্রেককারী শারীরিক লক্ষণ রয়েছে কি না! শারীরিক কষ্ট না থাকা সত্ত্বেও, বা টিএমটি নেগেটিভ থাকলে, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করা উচিত নয়। শুধু বুকে ব্যথা এবং সঙ্গে একটি মাত্র ধমনিতে আংশিক ব্লক থাকলেও অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করা উচিত নয়। লেফট মেন অথবা তিনটি ধমনিতে ব্লক থাকলে কখনই অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করে স্টেন্ট বসানো উচিত নয়।
বাইপাস সার্জারি
হার্টের পেশিতে রক্তসঞ্চালনের জন্য দায়ী অন্তত তিনটে আর্টারিতে ব্লক হলে তখনই চিকিৎসক বাইপাস সার্জারির কথা ভাবতে পারেন। তাই বলে কি যেখানে সেখানে ব্লক হলেই সার্জারি করা যাবে? তা নয়। আর্টারির প্রধান প্রধান অংশে ব্লক রয়েছে কি না তা দেখা দরকার। উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। হার্টের বাম দিকের পেশিতে রক্তসরবরাহ করে লেফট মেন করোনারি আর্টারি। এই ধমনি কিছু দূর এগনোর পর দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। এই দু’ভাগের নাম— ক. লেফট সারকামফ্লেক্স আর্টারি (এলসিএক্স) খ. লেফট অ্যান্টেরিয়র ডিসেন্ডিং আর্টারি (এলএডি)।
লেফট মেন করোনারি আর্টারিকে গঙ্গা নদীর সঙ্গে তুলনা করা যাক। গঙ্গোত্রী হল গঙ্গার উৎস। এরপর গঙ্গা বয়ে আসে মোহনার দিকে। দীর্ঘ যাত্রাপথে গঙ্গার গতিপথ রুদ্ধ হতে পারে উত্তরপ্রদেশে বা পাটনা অথবা মালদায়। মালদায় নদীপ্রবাহ রুদ্ধ হলে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ জল পাবে না। পাটনায় হলে বিহার আর পশ্চিমবঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নদীর বহমানতা উত্তরপ্রদেশে রুদ্ধ হলে তখন ইউপি, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ একসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর যদি কোনওভাবে গঙ্গোত্রীর কাছে নদীর গতি আটকানো হয়, পরিস্থিতি কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়!
অতএব লেফট মেন আর্টারি ব্লক হয়ে যাওয়ার পর তার যে কোনও প্রধান তিনটি শাখায় ব্লক থাকলে বাইপাস করাতেই হবে। একইরকমভাবে এলএডি আর্টারিও হার্টের বিরাট অংশের পেশির কার্যকারিতা অক্ষুণ্ণ রাখে। এই আর্টারিগুলিও একটু এগিয়ে একাধিক শাখায় ভাগ হয়েছে। সেই শাখাতেও ব্লক হলে রোগীর সমস্যা তৈরি হয়। এলএডিও কিন্তু একটু এগিয়ে কয়েকটি ভাগ হয়ে যায়।
এহেন এলএডি’র সঙ্গে এলসিএক্স এবং ডান দিকের ধমনিতে ( রাইট করোনারি আর্টারি) যদি ব্লক থাকে, এমন ক্ষেত্রে চিকিৎসক বাইপাসের কথা ভাবতে পারেন। আবার এলএডি’তে ব্লক না থাকলে, বাইপাস সার্জারি করা একদম উচিত নয়।
এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল, ল্যানসেট, নিউজিল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ নানা সময়ে একাধিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তা অনুসারে, তিনটি আর্টারিতে ব্লক থাকা সত্ত্বেও অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি বা বাইপাস না করে যদি শুধু ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা করা হয়, মানুষটি আরও বেশি বাঁচেন। অবশ্য দেখতে হবে রোগীর ‘ইজেকশন ফ্র্যাকশন’ বা হার্টের রক্ত পাম্পিংএর ক্ষমতা স্বাভাবিক আছে কি না। তিনটি আর্টারিতে ব্লক, সঙ্গে রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা কমলে অবশ্যই বাইপাস করাতে হবে।
মনে রাখবেন—
• এদেশে যত হয়, তার ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রেই অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি বা বাইপাসের দরকার থাকে না।
• হার্টে রক্তপ্রবাহের জন্য দায়ী প্রধান ধমনির গোড়ার দিকে ব্লক হলে দ্রুত বাইপাস সার্জারি করাতে হবে। নাহলে হার্টের বড় অংশের পেশি অকেজো হয়ে পড়বে। এমন ক্ষেত্রে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করে লাভ হবে না। এই ধরনের ব্লকযুক্ত রোগীর আচমকা প্রাণহানি ঘটে। তাই দ্রুত বাইপাস করা দরকার।
• অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি কিংবা বাইপাস করার বয়সের ঊর্ধ্বসীমা নেই। ডায়াবেটিস, হার্ট ফেলিওর-এর মতো কো-মর্বিডিটি না থাকলে এবং ইজেকশন ফ্র্যাকশন ঠিক থাকলে নবতিপর বৃদ্ধেরও বাইপাস কিংবা অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করা যায়।
সুপ্রিয় নায়েক