ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
প্রথমেই একটা কথা বলা দরকার যে পৃথিবীর পৃষ্ঠভাগের ৭০ শতাংশই সমুদ্র। পৃথিবীর জীবপ্রজাতির একটা বড় অংশ বাস করে সমুদ্রেই। ফলে সভ্যতার আদিযুগ থেকেই মানুষ সামুদ্রিক প্রাণীকে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে অভ্যস্ত। ভারতে গোয়া বা কেরালার মানুষ বহুদিন থেকেই সামুদ্রিক খাবারে অভ্যস্ত। বাঙালিরাও যে মাছের দর্শনে আপ্লুত হয়ে ওঠেন, সেই ইলিশ মাছ কিন্তু আদতে সামুদ্রিক মাছ। ডিম পাড়ার সময়ে নদী বেয়ে স্রোতের উল্টো দিকে উঠে আসে এই মাছ। কিন্তু ইলিশ বাদে অন্যান্য সামুদ্রিক জীব, যেমন অয়েস্টার বা অক্টোপাস কিন্তু বাঙালি রান্নাঘরে ছিল না।
বিজ্ঞানীদের মতে, সামুদ্রিক প্রাণীর একটা বড় অংশ এখনও ঠিক মতো চেনাই হয়ে ওঠেনি। ফলে এদের মধ্যে কোনটা বিষাক্ত, সেটা অনেক সময়েই জানা নেই। যেমন ২০১০ সালে তাইপেইতে একটি রেস্তোরাঁ থেকে অক্টোপাস খেয়ে ফুড পয়জনিং হয়েছিল। দেখা গিয়েছিল, সেই অক্টোপাসে রয়েছে টেটরাডটক্সিন নামে এক বিষ। জাপানে, অর্থাৎ যে দেশে অক্টোপাস খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে, সেই দেশেও কিন্তু মাঝে মধ্যে অক্টোপাস ফুড পয়জনিং-এর কেস পাওয়া যায়। ফলে আমাদের দেশে যে অক্টোপাস সমুদ্র থেকে আপনার প্লেটে আসছে, সেই প্রজাতি নিরাপদ কি না দেখার জন্য কোনও মেরিন বায়োলজি জানা বিজ্ঞানী আছে কি? মনে রাখবেন, আমাদের দেশের ডাক্তাররা কিন্তু অক্টোপাসের বিষ চিকিৎসা করে অভ্যস্ত নন। ফলে হঠাৎ আপনার তীব্র বিষক্রিয়া শুরু হলে মুশকিল।
টেটরাডটক্সিন এর কথা বললাম। এই বিষ থাকে অক্টোপাস ছাড়াও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর শরীরে থাকে, যেমন পটকা মাছ। এই মাছের শরীরে থাকে সায়ানাইডের থেকেও ভয়ঙ্কর এই বিষ। চীন বা জাপানের কিছু অভিজ্ঞ রাঁধুনি একমাত্র জানেন এই মাছের বিষাক্ত অংশ বাদ দিয়ে রান্না করতে। না জেনে এই সামুদ্রিক মাছ খেলে শ্বাসতন্ত্রের পক্ষাঘাত হয়ে মৃত্যু অনিবার্য।
এবার আসি স্ক্রমবোটক্সিন-এর কথায়। কিছু কিছু সামুদ্রিক মাছ যদি ঠিকমতো সংরক্ষণ না হয়, তাহলে সেই মাছের শরীরে ব্যাকটেরিয়া বংশবৃদ্ধি করে এবং তার প্রভাবে সেই মাছের দেহে তৈরি হয় হিস্টামিন। এবার সেই মাছ খাওয়ার পর আমাদের শরীরে এই অতিরিক্ত হিস্টামিনের প্রতিক্রিয়া শুরু হয় যেমন— পেট খারাপ, মাথার যন্ত্রণা, শ্বাসকষ্ট। যাঁদের হৃদরোগ আছে তাঁদের হার্টের ছন্দপতন হতে পারে। মনে রাখবেন যে এই হিস্টামিন কিন্তু রান্না করলেও নষ্ট হয় না। ফলে কাঁচা খাবারে তো বটেই (যেমন সুশি), ভালো করে রান্না করা সামুদ্রিক খাবারেও স্ক্রমবোটক্সিন থাকতে পারে।
সামুদ্রিক খাবার থেকে এছাড়াও হয় সিগুয়াটেরা বিষক্রিয়া। কিছু কিছু সামুদ্রিক মাছের শরীরে থাকে সিগুটক্সিন এবং মাইটোটক্সিন। এইসব মাছ খেলে তারপর শুরু হবে ডায়ারিয়া, রক্তচাপের হঠাৎ পতন, মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট। চিকিৎসা করলেও অনেকদিন অবধি এইসব উপসর্গ থাকতেই পারে। ২০১৬ সালে ম্যাঙ্গালোরে প্রায় ১০০ জন এই বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। হয়ত মৃত্যু কারুর হয়নি, কিন্তু অনেকেই নানারকম দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যায় ভুগেছিলেন।
আজকাল আরেকটি সি ফুড খুব জনপ্রিয় হচ্ছে। সেটি হল সি উইড। নানা ‘বিশেষজ্ঞ’ বলে থাকেন যে এইসব সামুদ্রিক উদ্ভিদ খেলে নাকি অদ্ভুত সব উপকার আছে। যেমন সি উইড নাকি ক্যান্সার প্রতিরোধ করে, ছানি পড়তে দেয় না, হাড় শক্ত করে ইত্যাদি। কিন্তু এইসব সামুদ্রিক উদ্ভিদে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন থাকে। যাঁদের থাইরয়েডের সমস্যা আছে, তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে এইসব খাবার খাবেন না। গ্রেভস ডিজিজ যাঁদের আছে, এরকম উচ্চ আয়োডিন যুক্ত খাবার হঠাৎ খেলে বিপদ হতে পারে। আর সি উইড এর মধ্যে যে সব মিনারেল বা ভিটামিন থাকে সেগুলি অন্য অনেক শাকপাতা বা ডিমেও পাওয়া যায়। ম্যাগনেশিয়াম বা কপার জাতীয় মিনারেল খাওয়ার জন্য কষ্ট করে সি উইড খেতে হবে না!
শেষ করি আরেকটি সামুদ্রিক খাবারের বিপদের কথা দিয়ে। এখন আর একটি দামি সামুদ্রিক প্রাণীর নাম খুব ফ্যাশনেবল হয়েছে— অয়েস্টার। ফ্রান্সে বা ইতালিতে এর চল রয়েছে। আমাদের এখানেও এখন এই দুর্মূল্য সামুদ্রিক খাদ্যের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এর সঙ্গেই জনপ্রিয় হয়েছে এই গোত্রেরই আরেকটি প্রাণী, মাসেল। এই ধরনের শেলফিশ থেকে বিরল এক ধরনের বিষক্রিয়া হয়, শেলফিশ প্যারালিসিস। এর জন্য দায়ী এই সব প্রাণীর খোলসের মধ্যে থাকা এক ধরনের অ্যালগি। এরা এই বিষ স্যাক্সিটক্সিন, তৈরি করে এবং শেলফিশ খাওয়ার সময়ে এই বিষ আপনার পেটে চলে যেতেই পারে।
এই প্রবন্ধে যেসব কথা বলা হল, সেগুলি কিন্তু খাদ্যরসিকদের ভয় পাওয়ানোর জন্য নয়। কিন্তু এই ধরনের নতুন খাদ্যসম্ভার যখন আমাদের শহরে এসেছে, তখন অজানা খাদ্যের কী কী বিপদ বা সমস্যা হতে পারে, সেই সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত। তাহলে মেডিক্যাল ইমারজেন্সি হওয়ার আশঙ্কা কমবে।