পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
মুড়ি ঘুগনি আমারও খুব প্রিয়। বিশেষ করে এই ঘুগনিটা মাসি যে কী সুন্দর রাঁধে! শুধু ঘুগনি কেন, কতবেলের আচার, আমসত্ত্ব থেকে তালের ক্ষীর সবই মাসির হাতে অপরূপ। দু-চারদিন স্কুলের ছুটি পেলেই আমতায় দেবলামাসির বাড়ি আমার আসা চাই। এবার অবশ্য বড়দিনের ছুটিতে এসেছি।
আমার আসার খবর পেয়েই মাসি চন্দ্রপুলি, ক্ষীরের ছাঁচ, নারকোলের চিঁড়া তৈরি করেছে। প্রতিবার শীতের ছুটিতে মা আর আমি দু’জনেই আসি। এবার আমি একাই এসেছি।
মাসির রান্নার গুণের কথা তো বললামই। রান্না ছাড়াও মাসির আরও একটা গুণের কথা এখনও বলা হয়নি। এই গুণের কারণেই মাসি সবসময় খুব হাসিখুশি থাকতে পারে না। এই হয়তো আনন্দে গুনগুন করে ঘরের কাজ সারছে, রান্নাঘরের কাজ দ্রুত হাতে সামলাচ্ছে। বেড়ালকে মাছভাত মেখে দিচ্ছে। পোষা পাখিটাকে ঝাঁঝরি দিয়ে স্নান করিয়ে পেয়ারা অথবা ছোলা খেতে দিচ্ছে। মেসো ফিরলে একপ্রস্থ লুচি ভেজে দিয়ে কফির কাপ হাতে গল্প করতে বসছে। আবার বলা নেই কওয়া নেই, ওই যে বললাম, বিশেষ একটা গুণের কারণে হঠাৎ মাসির মুখে অন্ধকার!
সেই গুণটার কথাই বলি। দেবলা মাসি গল্প, উপন্যাস লেখে। আমার মতো দস্যিদের মাসি যেমন খাইয়ে সুখ পায়, তেমনিই গল্প বলেও খুব আনন্দ পায়। একদিন নিজের খেয়ালে একটি পত্রিকায় গল্প পাঠিয়েছিল। সেই গল্পটা মনোনীত হয়ে ছাপার পর থেকেই মাসি লেখে।
গতমাসে মেসো একটা ল্যাপটপও কিনে দিয়েছে। ওতে গল্প লেখা আরও সহজ। মাসি যদিও এখনও কাগজ কলমেই লিখতে ভালোবাসে। নতুন যন্ত্রটায় অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে।
শীতকালের বৃষ্টি মাসির কেন আমারও তেমন ভালো লাগে না। একে বাড়ির ভেতর এমনিই ঠান্ডা তায় বাইরে বৃষ্টি! কাল এখানে তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গে ঝোড়োবাতাস। বাজ পড়ার সে কী কড়কড় শব্দ! আজও সকাল থেকেই আকাশের মুখভার।
মাসির আজ বৃষ্টির জন্য মনখারাপ নয়। কাগজ কলম নিয়ে বসেছে সেই সকাল ন’টায়। এখন প্রায় বারোটা বাজে। যদিও আকাশের দিকে তাকালে সন্ধে ছ’টা মনে হচ্ছে এত ঘন ঘোর কালো!
মাসি এখনও একটা লাইনও লিখে উঠতে পারল না। আমি হাঁ করে বসে আছি। মাসি একপাতা করে লিখবে আর আমি পড়ব। অগত্যা বইয়ের তাক থেকে একটা পত্রিকার ভূতের গল্প সংখ্যাটা পড়ব বলে নিলাম। মাসি আমার হাতে পত্রিকাটা দেখেই বলল, ‘ওটা পড়ে ভালো লাগবে না। ওর মধ্যে একটাও ভূত নেই। ভূতের গল্পের নামে কেউ সুন্দরবন বিষয়ে তাঁর জ্ঞান লিখেছেন। কেউ আবার পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার ভ্রমণকাহিনি! আমি তো একটা গল্পেও ভূত পেলাম না।’
আমি পত্রিকাটা যথাস্থানে রাখতে যাচ্ছি মাসি বলল, ‘হ্যাঁ, আছে অবশ্য! তবে ভূত নয়। ভূতের ওঝা, বাঘের ওঝা এসব আছে। একটাও ভালো ভূতের গল্প পড়তে পেলুম না।’
আমি মাসির কথা মানতে পারলাম না। এমনিতেই আমার বিজ্ঞানমনস্ক মন ভূতের অস্তিত্বই মানতে চায় না। আমি বললাম, ‘ভূত বিষয়টাই তো কাল্পনিক। ভূতের গল্প লিখতে গেলে ভূতের কল্পনা যেমন থাকবে ভূতের ওঝাও তো থাকবেই।’
মাসি কোনও তর্কে গেল না। চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর চেয়ার থেকে উঠে নিজেই বইয়ের তাক ঘেঁটে একটা পুরনো দিনের ভূতের গল্প সংকলন হাতে ধরিয়ে দিলে।
তারপর বলল, ‘নে, এইটা পড়ে দেখ। মনে হয় বার বার পড়ি। তেমন লেখা কোথায়? আমি নিজেও তো তেমন লিখতেই পারছি না। এই এতক্ষণ ধরে বসে বসে চার কাপ চা ধ্বংস করেও কি এক লাইনও লিখতে পারলাম? যে প্লট মাথায় আসছে তাই মনে হচ্ছে হয় লেখা হয়ে গেছে, নাহলে একদমই বাজে ভাবনা।’
ওই যে বললাম মাঝেমাঝে হঠাৎ মাসির মন খারাপ হয়, তা এই লিখতে না পারার জন্যই। লিখতে বসে লেখাটা এগিয়ে নিতে না পারলে অথবা নিজের লেখা নিজেরই খুব অপছন্দ হলে মাসির খুব মনখারাপ হয়।
আজ মাসির আচরণ আরও অদ্ভুত ঠেকল। আমার হাতে যে বইটা মাসি দিল, তা আবার নিজেই ফেরত নিয়ে বলল, ‘তুতুল, তুই যা তো টুটুন-বুবুনদের বাড়ি। ওরা তো বাড়িতেই আছে। ওদের সঙ্গে একটু খেলা করে আয়।’
আমি অবাক হলেও বুঝলাম, একা বাড়িতে কিছুক্ষণ গল্প নিয়ে ভাববে হয়তো।
বৃষ্টির দিনে টুটুন-বুবুনদের বাড়ি গিয়ে গল্প করতে আমার ভালোই লাগবে। অগত্যা আমি চলে এলাম।
ওখান থেকে ফিরে আসার পর যা যা শুনেছি তাই লিখছি এখন।
আমাকে খেলা করতে পাঠিয়ে দিয়ে, মাসি যেই পুরনো ভূতের গল্পের বইটা খুলতে যাবে, অমনি কলিং বেলের শব্দ। মাসি ভাবল, আমি বোধহয় ফিরে এসেছি।
দরজা খুলে কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না। দরজার বাইরে বেঁটে কলাগাছগুলো এমন দুলছে যেন প্রচণ্ড হাওয়ার ঝাপটা। অথচ বাতাসের তেমন জোর আজ নেই! মাসি ভালো করে একবার চারপাশ দেখে দরজা বন্ধ করে লেখার টেবিলে এল। তখুনি ফোনটা বেজে উঠল। আর দপ করে ঘরের আলো নিভে গেল। অন্ধকারেই মাসি ফোন ধরল। ফোন ধরতেই ওপাশে একজন বেশ হেঁড়ে গলায় বললেন, ‘নমস্কার। আমি কি দেবলা মিত্রর সঙ্গে কথা বলছি?’
এপাশ থেকে ‘হ্যাঁ’ বলায় লোকটি বললেন, ‘দেবলা ম্যাডাম, আপনি আপনার বোনপোকে একটি পত্রিকা পড়তে বারণ করলেন। পত্রিকায় একটাও ভূতের গল্প পাননি বললেন। আপনি কিন্তু পুরো পত্রিকাটি নিজেও পড়েননি!’
ফোনের এ প্রান্তে মাসি পুরো হতবাক!
—আপনি কে? কোথা থেকে বলছেন? আমার বাড়ির ভিতর আমি কী বলেছি, কী পড়েছি, তা আপনি জানলেন কীভাবে?
—আজ্ঞে, আমি এমন কেউ নই। তবে আমিও একজন লেখক। লেখকদের অন্তর্দৃষ্টি থাকে, সে তো জানেনই।
—আশ্চর্য! অন্তর্দৃষ্টি লেখকের থাকে তবে এরকম তো হয় না? বন্ধ ঘরের ভিতর আমি কী করলাম তা জানা লেখক কেন কারওর পক্ষেই সম্ভব নয়।
—আহা! আমি কি বলেছি সম্ভব? আমি তো বলছি আন্দাজ। সেটা তো লেখক করতেই পারেন। তাই না?
—আন্দাজ? এরকম আশ্চর্য আন্দাজ কেউ করতে পারেন?
—আরে বাদ দিন না ম্যাডাম। যেটা জরুরি তা হল আপনি ওই পত্রিকার সব ক’টা গল্প পড়েননি। এই অধমেরও একটা লেখা আছে ওই পত্রিকায়। সেই লেখাটাই আপনি পড়েননি। আমার নামটা এমন বিদঘুটে তাই হয়তো পড়ার ইচ্ছে হয়নি! একবার যদি অধমের গল্পটা পড়ে দেখেন!
—আপনি লেখক। আপনি অধম কেন হতে যাবেন? কিন্তু আপনি যেভাবে ফোনে বলছেন, পুরো বিষয়টা এত অদ্ভুত যে আমি...
মাসিকে শেষ করতে না দিয়েই লোকটা বললেন,
—আমার নাম ভূতনাথ। কোনও পদবি নেই পত্রিকার পাতায়। ‘ভূতনাথের ভূতের গপ্পো’ গল্পের নাম। আপনি একবার পড়ে দেখতে পারেন।
বলেই ওপাশে ফোন রেখে দেওয়ার শব্দ। আর তখুনি ঘরের টিউবলাইটটা জ্বলে উঠল। অর্থাৎ কারেন্ট এল।
অথচ ঠিক পাশের বাড়িতেই আমি এতক্ষণ ছিলাম। একবারও আলো নেভেনি। টুটুন-বুবুনদের বাড়িতে কোনও ইনভার্টার বা জেনারেটর নেই।
ফোন রেখে মাসি হতভম্ব! কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। একবার জানলার পর্দা সরিয়ে দেখল। কেউ নেই তো বাইরে? থাকলেও এই দোতলার ঘরে উঁকি দিয়ে কেউ জানবে কী করে মাসি একটু আগে তুতুলকে কী বলেছে? এমন অদ্ভুত অভিজ্ঞতা মাসি কেন কারওর জীবনেই কি হয়েছে?
টেবিলের ওপর রাখা পত্রিকাটায় মাসির চোখ যেতেই কীরকম একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। একবার ভাবল টুটুন-বুবুনদের বাড়িতে গিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে আসবে। মেসোকে ফোন করতে গিয়েও করল না। অফিসের কাজ ফেলে তড়িঘড়ি ছুটে বাড়ি আসবেন। একবার সদর দরজায় গিয়ে দেখে আসল। ছিটকিনি আঁটাই আছে। তাহলে ভূতনাথ লোকটা এসব বললেন কী করে?
নিজের ঘরে ফিরে মাসি পত্রিকার পাতা খুলে সূচিপত্র দেখল। শেষের দুটো গল্পের আগেই ভূতনাথবাবুর নাম ও গল্পের নাম। লোকটি ফোনে যা বলেছেন একেবারেই মিলে গেছে। এই রহস্যের সমাধান হবে কি না মাসির জানা নেই। কিন্তু গল্পটা তো একবার পড়ে দেখতেই হয়।
মাসি গল্পটা পড়ে ফেলল। গল্পের শুরুটা, ঝড়বৃষ্টির সন্ধ্যায় এক স্কুলছাত্রের শিক্ষকের গৃহ থেকে ফেরা দিয়ে। মাস্টারের বাড়ি থেকে ছেলেটির নিজের বাড়ি ফেরার পথে একটা বাঁশবাগান পড়ে। বাঁশবাগান এড়িয়ে বড় রাস্তা দিয়েও যাওয়া যায়। তবে রাস্তাটা বেশ কাঁচা। ঝড় বৃষ্টিতে সেই রাস্তার অবস্থা আরও শোচনীয়। আর ওই পথে বাড়ি ফিরতে বেশ অনেকটাই সময় লাগবে। ছেলেটি বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে বাঁশবাগানের পথই ধরল।
গল্প ক্রমশ এগচ্ছে। একটা গা ছমছমে ভয়ের জাল ধীরে ধীরে পাঠককে ঘিরে ধরছে। আর ঠিক তখুনি গল্পটা এমনভাবে শেষ হল যেন ভূত থাকলেও থাকতে পারে আবার না থাকতেও পারে।
মাসি পুরো গল্পটা পড়ে একদম হতবাক। এরকম গল্প তো বহুদিন পড়েনি। এই যে গা ছমছমে ভয় থেকে শেষে ভূত আছে কি নেই সেই প্রশ্নে শেষ হওয়া অর্থাৎ নিশ্চিত থেকে অনিশ্চিতে পৌঁছনো! এই তো একটা ভূতের গল্পের আসল ম্যাজিক।
মাসি বইটা নিয়ে বসে আছে, আমি ফিরে এলাম। আমাকে এই পর্যন্ত বলে মাসি কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল! আমিও কী বলব ভেবে না পেয়ে চুপ করেই ছিলাম। তারপর মাথায় একটা ভাবনা খেলে গেল। মাসিকে বললাম, যে নম্বর থেকে ফোন এসেছে সেই নম্বরে ফোন কর একবার। মাসি ফোনের কলার আইডি দেখে বলল, সকাল ন’টার সময় তোর মেসো অফিসে পৌঁছে ফোন করেছিল। আর তার ঠিক আধঘণ্টা বাদে তোর মা ফোন করেছিল তোদের বাড়ির ল্যান্ডফোন থেকে। এই চেনা নম্বর দুটো ছাড়া আর কোনও নম্বরই লিস্টে নেই!
মাসিকে কেমন বিমর্ষ দেখাচ্ছে। আমি আরও একটা উপায় বার করে ফেললাম। বললাম, পত্রিকা থেকে নম্বর নিয়ে সম্পাদকীয় দপ্তরে ফোন কর। লেখকের ফোন নম্বর চাও।
মাসি পত্রিকা দপ্তরে ফোন করছে। খুব একটা আশা আমাদের দু’জনেরই নেই। পত্রিকা দপ্তর কি লেখকের নম্বর দেবে মাসিকে? তবে এই পত্রিকায় মাসি নিজে কয়েকবার লিখেছে। তাই একটা ক্ষীণ আশা আছে।
ফোন রেখে দিয়ে মাসি অদ্ভুত গলায় বলল, ‘খবরের কাগজ পড়েছিস আজ? কাল সন্ধেবেলায় ঝড়বৃষ্টির সময় বাজ পড়ে আমতায় পাঁচজন মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে একজন ভূতনাথবাবু।’
আমি এবার আর কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এমনও হয়? মাসি কিছুক্ষণ বাদে কেমন একটা নিস্তেজ গলায় বলল, ‘পত্রিকায় ওঁর আরও একটি গল্প মনোনীত হয়েছে । সেই খবর জানাতেই আজ পত্রিকা থেকে ওঁর বাড়িতে ফোন করেছিল। তখনই ওঁর মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে।’
আমি তখুনি খবরের কাগজ খুলে ‘বজ্রপাতে মৃত পাঁচ’ খবরটা পড়লাম। মৃতদের মধ্যে একজনের নাম ‘ভূতনাথ মজুমদার’। বাড়ি আমতায়!