পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এক সুমহান সাহিত্যিক। কিন্তু তাঁর এই সাহিত্য ভাবনার বাইরেও তিনি বিভিন্ন দিক থেকে এক সমুজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। জীবনের নানা ক্ষেত্রে তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। ১৮৭৪ সালের কথা।
ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন বারাসত মহকুমার ভারপ্রাপ্ত জেলাশাসক। এক বর্ষাকালের ঘটনা। রহিমগঞ্জের এক ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক হঠাৎ ছেলের অসুস্থতার খবর পেয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কলকাতার কলেজে তাঁর ছেলে পড়াশোনা করে। ভদ্রলোক কী করবেন স্থির করতে না পেরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে বসিরহাট থেকে কলকাতায় রওনা দিলেন। কিন্তু বিপদের উপর বিপদ। বারাসত পৌঁছনো মাত্রই সন্ধে ঘনিয়ে এল। তখনকার দিনে এখনকার মতো এত ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। ভদ্রলোক নিরুপায় হয়ে রাতটুকু কাটানোর জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করতে লাগলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক ব্রাহ্মণ বাড়িতে ঢুকে তিনি রাতটুকুর জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে পাশের চণ্ডীমণ্ডপে সেই অতিথি ভদ্রলোকের রাতে শোওয়ার ব্যবস্থা হল। শোওয়ার পরও নানা দুশ্চিন্তায় কিছুতেই তাঁর ঘুম আসছিল না। ছেলের শারীরিক অসুস্থতার কথা চিন্তা করছিলেন তিনি। এরপর কী হবে, কবে আবার সুস্থ হয়ে উঠবে ছেলে— এইসব আর কী! এমন সময়ে তাঁর নজরে পড়ল পথচলতি একজন লোক খুব সন্তর্পণে সেই গৃহকর্তার বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর তিনি লক্ষ করলেন গৃহকর্তার বাড়িতে গোপনে যে লোকটা প্রবেশ করেছিলেন, তিনি মাথায় একটা বাক্স নিয়ে চণ্ডীমণ্ডপের পাশ দিয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে পালিয়ে যাচ্ছেন। কালবিলম্ব না করে অতিথি ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক পলায়নরত সেই ব্যক্তির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তাঁকে জড়িয়ে ধরে ‘চোর , চোর’ বলে চিৎকার করতে লাগলেন। সেই চিৎকার শুনে গৃহকর্তা আলো নিয়ে ছুটে এলেন। আরও বেশ কয়েকজন লোক হাজির হয়ে গেলেন সেখানে। এত লোক জমায়েত হওয়ার পর পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সেই চোরও ধরা পড়ার ভয়ে সেই ব্রাহ্মণ ভদ্রলোককে জাপটে ধরে তারস্বরে ‘চোর , চোর’ বলে চিৎকার জুড়ে দিলেন। উপস্থিত সকলে হতভম্ব। তাহলে প্রকৃত চোর কে?
বাধ্য হয়ে তাঁদের দু’জনকেই পুলিসের হাতে তুলে দেওয়া হল। পুলিসের হেফাজতে আসার পরও আসল ও নকল চোরকে শনাক্ত করা গেল না। উল্টে দেখা গেল, ব্রাহ্মণ ভদ্রলোকের সঙ্গে যিনি অভিযুক্ত সেই ব্যক্তি পুলিস কনস্টেবল। তাঁদের আদালতে চালান করে দেওয়া হল। বিচারের ভার পড়ল সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপর। দু’জনের জবানবন্দি শুনে বঙ্কিমচন্দ্র পড়লেন মহাফাঁপরে। কিছুতেই তিনি নির্ধারণ করতে পারছিলেন না কে আসল চোর? বঙ্কিমচন্দ্র বাধ্য হয়েই সেদিনের মতো বিচার মুলতবি করলেন।
এইভাবে সপ্তাহ দুই চলে গেল। চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন বঙ্কিমচন্দ্র। সাহিত্য সাধনায় কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারছেন না। এদিকে আগামী কাল তাঁকে এতদিন ধরে স্থগিত হয়ে থাকা মামলার রায় ঘোষণা করতেই হবে। হঠাৎ তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। গৃহভৃত্যের মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র ডেকে পাঠালেন তাঁরই বিশ্বস্ত এক আমলাকে। সাহিত্যানুরাগী হওয়ায় তিনি সাহিত্যসম্রাটের বেশ পছন্দের তালিকায় ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মনে পড়ে গেল যে, কোনও এক নাটকে তিনি সফলভাবে মৃতের ভূমিকায় অনেকক্ষণ ধরে অভিনয় করেছিলেন। আর সেই কৌশলকেই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজে লাগালেন বঙ্কিমচন্দ্র। সেই আমলা উপস্থিত হওয়ার পর তাঁকে সকালবেলায় আরও একবার আসার জন্য অনুরোধ করলেন তিনি। কথামতো সেই আমলা পরদিন সকালে হাজির হলে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে কিছু নির্দেশ দিয়ে নিজের এজলাসে চলে গেলেন। সেদিন আদালত কক্ষ ভিড় উপচে পড়ছে। এমনকী অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে আলিপুর সদর আদালত থেকে কিছু উকিল ও আমলাও সেই মোকদ্দমা শোনার জন্য হাজির।
বিচার শুরু হল। এমন সময় এক পেয়াদা বঙ্কিমচন্দ্রকে এসে শশব্যস্ত হয়ে খবর দিলেন যে, বঙ্কিমের পরিচিত সেই আমলা খুন হয়েছেন বারাসত থেকে বসিরহাট যাওয়ার রাস্তায়। বঙ্কিম বিস্মিত হয়ে বললেন যে, তিনি তো সকালেই তাঁর সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন। সেই মৃতদেহ মর্গে পাঠানোর আগে তিনি নিজে একবার সেই মরদেহ পরখ করে দেখবেন বলে মনস্থির করলেন। পেয়াদাকে হুকুম দিলেন এই দুই অপরাধীকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে সেই লাশ তুলে আনার জন্য। কারণ ডোমদের পাঠালে অনেকটা সময় অপব্যয় হবে। বাধ্য হয়ে তাঁরা সেই মৃতদেহ আনতে পেয়াদার সঙ্গে রওনা হলেন। রোদের প্রখর তাপ। মৃতদেহ কাঁধে করে ফেরার সময় তাঁদের গলদঘর্ম অবস্থা। ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক দুঃখ করে কেঁদে কেঁদে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগলেন। আর কেউ কোথাও নেই দেখে সেই কনস্টেবল তাঁকে বললেন যে, বারবার বলা সত্ত্বেও তিনি যেহেতু তাঁকে ছাড়েননি, তাই তিনি নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও এখন উচিত শাস্তি ভোগ করছেন। আদালতকক্ষে মৃতদেহ পৌঁছে দিয়ে দু’জনেই মুক্তি পেতে চাইলেন ।
মৃতদেহ হঠাৎ নড়েচড়ে উঠল। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত সকলের চক্ষুস্থির। টানটান উত্তেজনার মধ্যে সেই মৃতদেহ সকলকে অবাক করে দিয়ে জানাল যে, বঙ্কিমচন্দ্রের নির্দেশ মতো এতক্ষণ তিনি মৃতদেহ সেজে রাস্তায় পড়েছিলেন। পথে আসার সময় দু’জনের বক্তব্যই তিনি শুনেছেন। আসল অপরাধী হলেন পুলিস কনস্টেবল। বঙ্কিমচন্দ্রর বিচারে নিরপরাধ ব্রাহ্মণ বেকসুর খালাস পেলেন, আর প্রকৃত দোষী পুলিশ কনস্টেবলের তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হল।
আত্মীয়রা একবার বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। তিনি তখন মোমের আলোতে কাজ করছিলেন। তাঁরা এসেছেন দেখে সঙ্গে সঙ্গে তিনি মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে অন্য আর একটা মোমবাতি ধরালেন। এরপর আগত অভ্যাগতদের সঙ্গে কুশল বিনিময় শুরু করলেন। এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে অবাক দৃষ্টিতে সাহিত্য সম্রাটের দিকে তাকিয়ে থাকেন তাঁরা। উপস্থিত একজন কৌতূহল নিরসনের জন্য বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে জানতে চান যে, কেন তিনি আগের মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলেন? এই প্রশ্ন শুনে বঙ্কিমচন্দ্র নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন যে , আগেরটি ছিল রাষ্ট্রের সম্পত্তি থেকে কেনা। যেহেতু তিনি এখন অতিথি-অভ্যাগতদের সঙ্গে গল্প করবেন, তাই সেই ব্যক্তিগত কাজের জন্য জনগণের দেওয়া করের টাকা থেকে একটা অংশও খরচ করতে রাজি নন। সেক্ষেত্রে কেউ দেখতে না পেলেও বঙ্কিমের বিশ্বাস এই অনৈতিক কাজের জন্য ঈশ্বরের কাছে তাঁকে জবাবদিহি করতে হতে পারে। তাই তিনি নিজের টাকায় কেনা মোমবাতি জ্বালিয়েছেন।
এই কথা শুনে তাঁরা স্তম্ভিত। আসলে তাঁরা এসেছিলেন আত্মীয়তার সূত্রে বিশেষ কোনও সুযোগ-সুবিধা আদায় করা যায় কি না, সেই বিষয়ে অনুরোধ করতে। কিন্তু সামান্য মোমবাতি নিয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্রের এই সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধি ও বিবেচনা দেখে নিজেরাই তাঁরা সতর্ক হয়ে গিয়ে তাঁকে সেই অনৈতিক প্রস্তাব জানানোর সাহসই পেলেন না।