পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
জোড়াতালি দিয়ে তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার পর এখনও একমাসও কাটেনি। নবনির্বাচিত এমপিরা সংসদে শপথ পর্যন্ত নেননি। গম্ভীর প্রধানমন্ত্রীকে দেখে আক্ষরিক অর্থেই মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে তিনি যথেষ্ট চাপে। চতুর্দিক থেকে একের পর এক অনর্থ তাড়া করছে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারকে। বাহানাগার স্মৃতি ফিকে হওয়ার আগেই বাংলায় আবার মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনা। স্রেফ বেলাইন হলে একটা কথা ছিল। কিন্তু একই লাইনে দু’টি ট্রেনের চলে আসা, সকাল থেকে অটো সিগন্যাল বিকল সত্ত্বেও পেপার মেমোয় চলা মালগাড়ির অত্যধিক গতি নিয়ে রেলবোর্ড কর্তারা সদুত্তর দিতে ব্যর্থ। স্বয়ং রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান গোজামিল দিতে জখম সহকারী চালককে মৃত বলে ঘোষণা করছেন কোন আক্কেলে? তাহলেই বুঝুন দেশের পরিবহণ ব্যবস্থার লাইফ লাইন রেলের অবস্থা কতটা সঙ্গীন! গরিবকে ‘মালগাড়ি’তে তুলে শুধু বড়লোকের জন্য ঝাঁ চকচকে বন্দে ভারত আর বুলেট ট্রেন ছুটিয়ে বৃহৎ পুঁজির জয়গান। সঙ্গে রেলের ঢালাও বেসরকারিকরণের ছক। আগে থেকেই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে বেছে বেছে খতম করার ব্লুপ্রিন্ট প্রস্তুত। এখানেই শেষ নয়, অগ্নিপথ প্রকল্প রদের শরিকি দাবি থেকে দীর্ঘ নিস্তব্ধতার পর মণিপুর নিয়ে আরএসএস প্রধানের হঠাৎ চোয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ‘কুম্ভীরাশ্রু’ই বা কীসের ইঙ্গিত? বিদ্রোহের না দর কষাকষির! চারশো আস্ফালনের দামাল হাতি কাদায় পড়লে যা অনিবার্য পরিণতি!
এসবের মধ্যেই গোদের উপর বিষফোঁড়া নিট ও নেট কেলেঙ্কারি। গত ৪ জুন ভোটের ফল বেরনোর দিন থেকে উচ্চশিক্ষায় এত বড় দুর্নীতির ধাক্কায় জোট সরকারের ভিতটাই টালমাটাল। শপথ, মন্ত্রিসভা গঠন, দায়িত্ববণ্টন হলেও লোকসভার স্পিকার কে, তা চূড়ান্ত হবে আগামী সপ্তাহে। তারপর জুলাই মাসে বাজেট পেশ। কিন্তু সংসদ পুরোদমে শুরু হওয়ার আগেই সর্বভারতীয় ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষার দুর্নীতি এবং সর্বভারতীয় কলেজ শিক্ষক নিয়োগের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা নেট বাতিল নিয়ে সরকার চূড়ান্ত কোণঠাসা। একে তো একক গরিষ্ঠতা হারিয়ে বিজেপি অনেকটা ডিফেন্সিভ, দোসর এই ‘পেপার লিক’ কেলেঙ্কারির অভিঘাত। উজ্জীবিত বিরোধী জোট ইন্ডিয়া সোমবার থেকেই সংসদ অচল করার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছে। সংসদকে এলেবেলে চোখে দেখার দিন কি তবে এবার শেষ হতে চলেছে? সরকার ও যুযুধান বিরোধীদের প্রতিনিয়ত টানাপোড়েনে জমে যাবে অধিবেশন।
বিগত দশ বছরে বড় কোনও কেলেঙ্কারির চিহ্ন নেই, এই প্রচারে ভর করেই এবারও ভোটে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করার কৌশল নিয়েছিল বিজেপি। নেহরু-গান্ধীর অতীত ইতিহাস মুছে অমৃতকালে একমাত্র বিশ্বগুরুই বাস্তব, প্রমাণ করাই ছিল গোপন প্ল্যান। চারশো জেতার স্বপ্নের জন্মও সেই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই। অদৃষ্টের এমনই পরিহাস, ভোট মিটতেই শিক্ষা কেলেঙ্কারির বিষ নিঃশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে দিল্লি থেকে দেশের সর্বত্র। নিট ও নেট, এদেশে উচ্চশিক্ষার দুই গুরুত্বপূর্ণ সোপান। ভাবী প্রজন্মের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর দিশা। একদলের হাতে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য, অন্যরা শিক্ষিত করবে আগামী প্রজন্মকে। দু’ক্ষেত্রেই ভয়ঙ্কর দুর্নীতির ছায়া। তাহলে কী করে বাঁচবে দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। কোন বিচারে ১,৫৬৩ জন গ্রেস নম্বর পেয়ে নিটের মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন তার কোনও সদুত্তর মেলেনি। সুপ্রিম কোর্টের কড়া ধমক খেয়ে গ্রেস মার্কই প্রত্যাহার হয়ে গিয়েছে। ওই ১,৫৬৩ জন পরীক্ষার্থী চাইলে আবার পরীক্ষায় বসতে পারেন। সেই রিটেস্ট অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ, রবিবারই। রহস্যজনকভাবে এবার নিটে প্রথম হয়েছে ৬৭ জন! এত পরীক্ষার্থী একসঙ্গে ৭২০-তে ৭২০ নম্বর পেলেন কীভাবে? সদুত্তর মেলেনি। তার মধ্যে আবার একই সেন্টারের আটজন ‘কৃতী’! কেন বিহারের একজন পরীক্ষার্থী গুজরাতে গিয়ে পরীক্ষা দিলেন? মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম কেলেঙ্কারি ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। সেই একই পরিণতি অপেক্ষা করছে নিট ও নেট কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রেও। এই অনাচার যুবসমাজ সহজে মেনে নেবে কি? দুর্নীতির শিকড় সন্ধানে কেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর কৈফিয়ত চাওয়া হবে না? তাঁর মন্ত্রকের কর্তাদের তদন্তের বাইরে রাখলে তির্যক প্রশ্ন ওঠা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক নয়।
সর্বভারতীয় স্তরে কলেজ শিক্ষক নিয়োগের নেট পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে মাত্র গত মঙ্গলবার। কিন্তু কী এমন হল যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পুরো পরীক্ষা বাতিল করতে হল? সরকার গঠনের পরপরই যেভাবে কেন্দ্রের সরকার প্যাঁচে পড়ে গিয়েছে, সেই আবহেই তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক ডেকে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এর দায় আমি নিচ্ছি। দায় ঝেড়ে ফেলার কোনও অভিপ্রায় নেই।’ সিবিআইকে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। মন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন, পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র ডার্কনেটে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু কারা করাল, তা নিয়ে আশ্চর্য নীরবতা। মন্ত্রী মুখে যাই বলুন, উচ্চতম মহলের যোগ ছাড়া এভাবে প্রশ্ন ফাঁস কখনও সম্ভব হতে পারে না। তাই শুধু স্বীকার করলেই চলবে না, দায় নিয়ে ইস্তফা দিতে হবে ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানকে। যদি প্রশ্নফাঁসের দরুন নেট বাতিল হয়, তাহলে এত বড় কেলেঙ্কারির পরও নিট বাতিল হবে না কেন? কত যোগ্য প্রার্থী বঞ্চিত হয়েছেন দুর্নীতিবাজদের পরাক্রমে, তাঁদের সুবিচার পাইয়ে দেবে কে? স্বভাবতই, সবার দৃষ্টি এখন আগামী ৮ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের শুনানির দিকে। নেতা, মন্ত্রী, আদালত সবার কাছে একটাই আবেদন, এই টানাপোড়েনের জেরে লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীর ভবিষ্যৎ যাতে নষ্ট না-হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকেই। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছে, দেশে আদৌ কোনও সরকার আছে তো? নতুন জোট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান ওড়িশার নেতা। কলিঙ্গবিজয়ের পর তাঁকে দায়ী করে কোনও কড়া পদক্ষেপ কি করতে পারবেন মোদিজি? টানা তিনবছর বাংলায় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগকে সামনে রেখেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারকে নাস্তানাবুদ করার ছক কষেছিল কেন্দ্রের সরকার। ধরপাকড়, তল্লাশি, গ্রেপ্তার কম হয়নি। বাংলার মানুষ তাতে আমল না দিয়ে উপর্যুপরি একুশ ও চব্বিশ সালের নির্বাচনে মোদিকে হারিয়েছে। সেই গেরুয়া ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। উল্টে এবার সেই ভয়াবহ দুর্নীতিই ব্যুমেরাং হয়ে বিঁধছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বুকে। বেশ বোঝা যাচ্ছে, নিট ও নেট দুর্নীতির অভিঘাত রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত অভিযোগের চেয়ে আরও ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। তাহলে দুর্নীতির প্রসঙ্গ উঠলেই বিজেপি ধোয়া তুলসীপাতা বলে ভেকধারী প্রচার কেন? আগামী ছাব্বিশের বিধানসভা ভোটে দুর্নীতির প্রশ্নে বাংলার মানুষ কী করবেন? দেওয়াল লিখন স্পষ্ট। নিট ও নেট কেলেঙ্কারিতে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা বিভেদকামী গেরুয়া শক্তিকে ভোট দেওয়ার আগে বাংলার মানুষ পাঁচশোবার ভাববেন। কারণ, যাঁরা এতদিন গোটা শিক্ষাদপ্তরটাই জেলে বলে বাংলাকে কটাক্ষ করতেন, তাঁদের জন্যও একই ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। সেই কারণেই রাজ্যগুলির দাবি মেনে আবার নিটের দায়িত্ব রাজ্যের হাতেই ফিরিয়ে দেওয়াই উচিত। তাতে অন্তত এই ভয়াবহ পরিণতির পুনরাবৃত্তি দেখতে হবে না।