পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
৪ জুনের পর বিজেপি, সিপিএম সহ সমস্ত বিরোধী দল লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে লেটার মার্কস দিচ্ছে। কিন্তু তাতে কি বিন্দুমাত্র কমে ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের গুরুত্ব? মমতার এই প্রকল্প বাংলার চাষিদের জুগিয়েছে ভরসা। প্রান্তিক কৃষকদের বাঁচিয়েছে মহাজনী ঋণের খপ্পর থেকে। যাঁরা এই সুযোগ পান তাঁরা প্রত্যেকে না হোক, একটা বড় অংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘কৃষকদরদি’ বলেই মনে করে। তাই চাষিদের মধ্যে মমতার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।
লক্ষ্মীর ভাণ্ডার অবশ্যই একটা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু তারজন্য বাংলার প্রতি মোদি সরকারের বঞ্চনাকে খাটো করে দেখা ঠিক হবে না। ১০০ দিনের কাজ বন্ধ করে বিজেপি সরকার গরিবের পেটে লাথি মেরেছে। দফায় দফায় অনুরোধ সত্ত্বেও চিড়ে ভেজেনি। আবাস যোজনার টাকা আটকে কেড়ে নিয়েছে গরিবের মাথার উপর ছাদ। বাংলা যত বেশি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হয়েছে বঙ্গ বিজেপির উল্লাস চড়েছে ততই। এবারের নির্বাচনে সেই অবিচারের জবাব দিয়েছে বাংলা। একেবারে কড়ায়গন্ডায় হিসেব চুকিয়ে দিয়েছে। এরপরেও যদি মোদির সরকার বাংলার প্রাপ্য না মেটায়, তাহলে ছাব্বিশে বঙ্গ বিজেপির জন্য অপেক্ষা করছে আরও বড় থাপ্পড়।
নির্বাচনের আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সৌজন্যে তৃণমূল এবার প্রচুর মহিলা ভোট পেতে চলেছে। বহু বামপন্থী এবং বিজেপি সমর্থকও জানিয়ে ছিলেন, তাঁরা কট্টর মমতা বিরোধী। এতদিন গোটা পরিবার এক সুরে কথা বলেছে। কিন্তু এবার স্ত্রী ও মায়ের ভোট যাবে তৃণমূলে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকায় সংসারের জরুরি প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি পূরণ করতে পারছে ছোটখাটো শখ।
ফলে এবার পরিবারের সব ভোট আর এক জায়গায় যাবে না। উত্তরবঙ্গের এক বিজেপি নেতা একান্ত আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘এটা দেশের ভোট। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে নরেন্দ্র মোদির ধারেকাছে কেউ নেই। বাংলার ৪২টি আসন জিতলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। ফলে পরিস্থিতি খুবই অনুকূল। তা সত্ত্বেও আমরা জিতবই, এমন জোর দিতে পারছি না। কারণ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার।’
বাংলার বাস্তব পরিস্থিতি বুঝেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রচারকরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার কিছুই নয়, এমন একটা প্রচারের কৌশল নিয়েছিলেন। তাঁরা বুঝিয়ে ছিলেন, হাজার টাকায় সংসার চলে না। চাই কাজ। তাঁদের সেই শেখানো বুলি শোনা গিয়েছিল বিজেপির ছোট, বড় সব নেতার মুখে। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব ভুলে গিয়েছিল, বিন্দু বিন্দুতেই হয় সিন্ধু। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকাই হয়ে উঠেছে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যাদের পুঁজি। তাতেই ফিরছে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির আর্থিক স্বাস্থ্য।
একথা ঠিক, চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার তৃণমূল কংগ্রেসকে বিপুল সাফল্য এনে দিয়েছে। তবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে শুধুই ভোটব্যাঙ্ক ভাবাটা হবে মস্ত বড় ভুল। বরং লক্ষ্মীর ভাণ্ডার হল দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর নারী সশক্তিকরণের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। যুগান্তকারীও বলা চলে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের জন্য অনেক প্রকল্প এনেছেন। তবে, বাংলার মা, বোনেদের জন্য চালু করা প্রতিটি প্রকল্পই বিপুল সাড়া ফেলেছে। তাঁর কন্যাশ্রী পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই প্রকল্পের জন্য স্কুলছুট তো কমেছেই, বাড়ছে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার হার। এখন আর প্রাথমিকের পর থেমে যায় না মেয়েদের পড়াশোনা।
রূপশ্রী প্রকল্পের জন্য কন্যাসন্তান আর দুঃস্থ পরিবারের ‘বোঝা’ নয়, বরং ‘সম্পদ’। মেয়ে জন্মালেই ৫০ হাজার টাকার সরকারি সাহায্য নিশ্চিত। কন্যাশ্রী দিয়ে শুরু হয়েছিল মমতার নারী সশক্তিকরণের পথ চলা। সেই বৃত্তকে সম্পূর্ণ করেছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। সেটা বাংলার মা, বোনেরা উপলব্ধি করেছেন। তারজন্যই রাজনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে উঠে আসছেন মহিলারাও। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের হাত ধরে বাংলার রাজনীতিতে সূচনা হয়েছে এক নতুন অধ্যায়ের।
যুগ যুগ ধরে মহিলারা ছিলেন শুধুই ‘ভোটার’। তাঁরা স্বামীর ‘নির্দেশ’ মেনে অথবা পারিবারের রাজনৈতিক ঐতিহ্য মতো নির্দিষ্ট একটি দলের প্রার্থীকেই ভোট দিতেন। ফলে পরিবারের সব ভোট যেত একদিকে। একটা সময় ছিল যখন পরিবার গুনে বলে দেওয়া যেত, কোন বুথে কার কত লিড হতে পারে। কিন্তু এখন আর সেই অঙ্ক মেলে না। কারণ ভেঙেছে ‘পারিবারিক ভোট’ প্রথা। এখন মহিলারা দেখেন, কাকে ভোট দিলে তাঁদের লাভ। সেই অঙ্ক কষেই তাঁরা ভোট দিচ্ছেন। চেতনার জন্ম হয় এভাবেই।
এতদিন সকালে ভোটের লাইনে ভিড় হতো মূলত পুরুষদেরই। মা, বোনেরা রান্না করে, সংসারের কাজ সেরে দুপুরের পর ভোট দিতেন। কিন্তু, এবার উল্টো ছবি। মা, বোনেরাই সাতসকালে দাঁড়িয়েছিলেন ভোটের লাইনে। তাই মহিলাদের লাইন ছিল পুরুষদের চেয়েও লম্বা। কোনও কোনও জেলায় পুরুষদের চেয়েও মহিলাদের ভোট পড়েছে বেশি। ঝাড়গ্রামে ৯২ শতাংশ মহিলা ভোট দিয়েছেন। এতদিন তাঁরা শুধুই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতেন। এবার তার পাশাপাশি পালন করেছেন ‘কর্তব্য’ও। ভোট দিতে আসা মহিলাদের অনেককেই বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘দিদি আমাদের জন্য অনেক করছেন। তাই দিদির পাশে দাঁড়ানোটা আমাদের কর্তব্য। সেই কর্তব্যটা পালন করে গেলাম।’
এবার আরও একটা বৈশিষ্ট্য অনেকের নজর কেড়েছে। এতদিন বুথের বাইরে রাজনৈতিক দলের ক্যাম্পে থাকতেন মূলত পুরুষরাই। এবার সেখানে ছিল বহু মহিলা পরিচালিত ক্যাম্প। তাঁরা ভোট দিয়ে বাড়ি না গিয়ে ভোটাদের বুথ স্লিপ দিয়েছেন। বয়স্কদের বুথে যেতে সাহায্য করেছেন। এটা গ্রাম বাংলার নতুন ছবি।
সব রাজনৈতিক দলেরই মহিলা সংগঠন আছে। সিপিএমের মহিলা সমিতি। বাম আমলে মহিলা সমিতির সদস্যরা নারী নির্যাতনের কোনও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটলে তবেই রাস্তায় নামতেন। আর ভোটে মহিলা সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী দেওয়ার জন্য তাঁদের খোঁজ পড়ত। সংরক্ষণের জোরে মহিলারা প্রধান, উপ প্রধানের চেয়ারে বসতেন। কিন্তু অধিকাংশই ছিলেন ‘রাবার স্ট্যাম্প’।
রাজ্যে ক্ষমতা পরিবর্তনের পর অনুব্রত মণ্ডল বীরভূম জেলায় প্রতিটি ব্লক ধরে মহিলা সম্মেলন করতেন। তাঁর প্রতিটি সভায় প্রচুর মহিলা ভিড় করতেন। কিন্তু রাজনীতিতে মহিলাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ হাতে গোনা দু’একটি জেলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার চালুর পর ছবিটা দ্রুত বদলাতে থাকে। রাজ্যে তৃণমূলের মহিলা সংগঠনে জোয়ার এসেছে। লোকসভা ভোটের আগে মিটিংয়ে, মিছিলে মহিলাদের উপস্থিতি অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। তৃণমূলের প্রমীলা বাহিনী এখন এতটাই শক্তিশালী যে তারা এককভাবে মিটিং, মিছিল করার ক্ষমতা রাখে। আরামবাগে মহিলা তৃণমূলের পদযাত্রায় জনস্রোত বয়ে গিয়েছিল। তৃণমূলের জন্য রাজ্যের কঠিনতম আসন ছিল আরামবাগ। সেখানে তৃণমূল জিতেছে। মিতালি বাগের এই জয়ের পিছনে মহিলাদের অবদান অনস্বীকার্য।
মহিলারা এবারের ভোটে ডিসাইডিং ফ্যাক্টর হতে চলেছে, সেটা টের পেয়ে ছিলেন নরেন্দ্র মোদিও। তাই সন্দেশখালির রেখা পাত্রকে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা বলে অভিহিত করে মহিলাদের পাশে টানার কৌশল নিয়েছিলেন। নির্বাচনের মুখে পাশ করিয়েছিলেন মহিলা সংরক্ষণ বিল। বিজেপি ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের কথা বলছে। কিন্তু
এবার তারা ৪২৯জনের মধ্যে মাত্র ৬৯ জন মহিলা প্রার্থী দিয়েছিল। শতাংশের হিসেবে মাত্র ১৬। এককথায় মোদিজির সংরক্ষণ আইন পাশ করা ছিল মহিলা ভোট টানার ‘গাজর’। তবে, শতাংশের নিরিখে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মহিলা প্রার্থী দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ৪২ প্রার্থীর মধ্যে ১২জনই মহিলা। প্রায় ৩০ শতাংশ। এতেই বাংলার মা, বোনেরা বুঝে গিয়েছেন, বিজেপির কাছে মহিলারা ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’ হলেও মমতার রাজত্বে নায়িকা তাঁরাই।