পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
ভোটদাতারা
ভোটদাতাদের যথেষ্ট সাধারণ জ্ঞান রয়েছে, তাঁরা সেইমতোই তাঁদের যথার্থ মত দিয়েছেন। বিজেপির দেশ-শাসনের গত এক দশকের মডেলকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁরা। তাঁদের তরফে, একইসঙ্গে নরেন্দ্র মোদিকে আর একটি সুযোগও দেওয়া হয়েছে, যদি বড় ধরনের কোনও সংশোধন তিনি করতে পারেন। বিজেপি ৩০৩টি আসন দিয়ে শুরু করেছিল। পরে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল নিজের জন্য ৩৭০ এবং এনডিএর জন্য ৪০০+। টার্গেটটা, দুঃখজনকভাবে, দু’দিক থেকেই অপূর্ণ রয়ে গিয়েছে। শেষমেশ বিজেপি নিজে থেমে গিয়েছে ২৪০-এ পৌঁছে, যা তাদের জন্য বেদনাদায়ক এবং এনডিএর পক্ষে সংগ্রহের পরিমাণ মাত্র ২৯২। বিজেপির প্রতি জনগণের বার্তা এবার স্পষ্ট—শরিক দলগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকারসহ একটি জোট সরকার গঠন করো, ত্যাগ করো বিভাজনের নীতি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বাস্তবতা মেনে নাও, সামাজিক ক্ষেত্রে বিভাজনের যে যন্ত্রণা উপস্থিত হয়েছে তার নিরাময়ে উদ্যোগী হও, ফালতু অহঙ্কার ছেড়ে আপামর ভারতবাসীকে উন্নয়নের সড়কে টেনে তোলো।
ভোটদাতারা অন্য একটি সিদ্ধান্তেও পৌঁছেছেন যে, প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া প্রয়াস চালিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা সম্ভবত এখনও তেমন প্রস্তুত নয়। লোকসভায় মোট ১৭০টি আসন রয়েছে এমন ৯টি রাজ্যে কংগ্রেসের শিকড় ফের গভীরে নিয়ে যাওয়া জরুরি।
বিজেপি
মাননীয় নরেন্দ্র মোদি সরকার গঠনের জন্য মানুষের যে রায় পেয়েছেন তা শর্তসাপেক্ষ, কিন্তু অতিশয় আত্মবিশ্বাসের কারণে তিনি সেই সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেননি। প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে উঠেই তিনি ভেবে নিয়েছেন যে, দলে তাঁর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই এবং সরকার গড়ার দাবি পেশের মতো সংখ্যা নেই অন্যকোনও দলেরও। মোদিজি যথার্থ উপসংহারে পৌঁছেছেন যে চন্দ্রবাবু নাইডু (টিডিপি) এবং নীতীশ কুমার (জেডিইউ)—এই দু’জনেই হলেন মূলত লেনাদেনার নেতা। দিল্লিতে ‘কিংমেকার’ হওয়ার খেলার চেয়ে তাঁরা বরং বেশি উদগ্রীব, যথাক্রমে—অন্ধ্রপ্রদেশ এবং বিহারে তাদের কষ্টার্জিত গদি রক্ষা নিয়ে। আর এটাই দেখা গেল যে, মোদিজি ব্যক্তিগত আশ্বাসেই তাঁদের সন্তুষ্ট করতে পারেন। চন্দ্রবাবু এবং নীতীশের রাজ্যের জন্য ফান্ড, কিছু স্কিম এবং একধরনের ‘বিশেষ মর্যাদা’ দিলেই তো কেল্লা ফতে!
মোদিজি তাঁর ‘কোর টিম’কেই আবার ফিরিয়ে এনে কী ভুল করেছেন, নীচে সেটাই বলব।
কংগ্রেস
পাটিগণিত কথা বলে সোজাসুজি। কংগ্রেস মোট ৯৯টি আসনে জিতেছে। কিন্তু তার মধ্যে ৭৯টি এসেছে ৯টি রাজ্য থেকে। অন্য এমন ৯টি রাজ্য আছে যেগুলিতে মোট আসন সংখ্যা ১৭০, কিন্তু কংগ্রেস সেগুলি থেকে পেয়েছে মাত্র ৪টি! চিন্তার বিষয় এই যে, কংগ্রেসের প্রাপ্তি—৫টি রাজ্যে জাস্ট শূন্য (০) এবং ৪টি রাজ্য থেকে মাত্র ১টি করে আসন। কংগ্রেস প্রথমোক্ত ৯টি রাজ্যে কী ভালো কাজ করেছে এবং শেষোক্ত ৯টি রাজ্যে কী ভুল করেছে, দলটির ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যই তা বিশ্লেষণ করা দরকার। উদয়পুর এবং রায়পুরে অনুষ্ঠিত দলীয় সম্মেলন থেকে প্রস্তুতিমূলক কাজ কিছু করা হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রস্তুতিকে কাঙ্ক্ষিত পরিণতি দেওয়া গিয়েছে বলে আমার মনে হয় না। কয়েকমাস পরেই যে রাজ্যগুলিতে বিধানসভার ভোট, সেই হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডে এই নির্বাচনে কিছু আশার আলো দেখা গিয়েছে। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে ওই তিন রাজ্যে সহযোগীদের নিয়ে কংগ্রেস যে ফল করেছে তাতে বিধানসভার ভোটে তারা এগিয়েই থাকবে এবং সেখানে তাদের ক্ষমতা দখল করার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয়েছে। বিজেপি নিশ্চয় কঠিন লড়াই দেবে, তবে অবশ্যই জয়ী হওয়ার মতো লড়বে ‘ইন্ডিয়া’ ব্লকও।
সরকার
নরেন্দ্র মোদি যখন পরিবর্তনের বদলে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বেছে নিয়েছেন, তখন তিনি কুড়ুল মেরেছেন নিজের পায়েই। মোদির তৃতীয় সরকারের গঠন এবং পোর্টফোলিও বা মন্ত্রক বণ্টন থেকে একাধিক সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে। প্রথমত, তাঁর সরকারের চলন এবং চলার ধরন পরিবর্তন করার জন্য ভোটদাতারা যে সতর্কবার্তা দিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদি তা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেননি। দ্বিতীয়ত, তাঁর সরকার পরিচালনার মৌলিক নীতিতে ফের অবিচল আস্থা রেখে তিনি এটাই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, তাঁর কোনও ভুল ছিল না। এটা তিনি বুঝিয়েছেন বিশেষ করে অর্থনীতি, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং বিদেশনীতি সম্পর্কে। তৃতীয়ত, মোদি পরোক্ষভাবে এও স্বীকার করেছেন, যে-পদ অলঙ্কৃত করেন সেই পদের উপযুক্ত প্রতিভাধর তিনি নন। চতুর্থত, তাঁর তৃতীয় সরকার পিএমও মারফতই চালিত হবে—যাঁরা এটা মেনে নেবেন মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হবে কেবল তাঁদেরই—এটা তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। সবশেষে বলব, তিনি নিশ্চিত যে—অমিত শাহ এবং তিনি এনডিএ শরিকদের ‘ম্যানেজ’ করে চলার ক্ষমতা ধরেন, সরকারে শরিকদের সম্মানজনক ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ ছাড়াই এই ম্যানেজ প্রক্রিয়া চলবে।
মন্ত্রীদের কেউই এখনও তাঁর অগ্রাধিকার বা নীতি সম্পর্কে কোনও কথা বলেননি। নির্মলা সীতারামন হয়তো আগের মতোই জোরের সঙ্গে বলে যাবেন—মোদি জমানায় ভারতীয় অর্থনীতি ‘ক্লিপিং রেটে’ বাড়ছে, ২৪ কোটি মানুষের দারিদ্র্যমুক্তি ঘটেছে, মুদ্রাস্ফীতি নীচের দিকে, নতুন নতুন চাকরি হচ্ছে এবং কোনও একদিন ভারত ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি হয়ে উঠবে। বজায় থাকতে পারে অমিত শাহেরও দাবিগুলি—সন্ত্রাসবাদ পরাজিত হয়েছে, সংবিধান মেনেই শাসনকার্য চলছে মণিপুরে, সিএএ এবং ইউসিসির কাজ যথারীতি চলছে এবং আইপিসি, সিআরপিসি ও সাক্ষ্য আইনের স্থলে যে তিনটি আইন আনা হয়েছে, ভারতে টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকোলের কাল থেকে ধরলে সেগুলিই সেরা। বিশ্ব রাজধানীতে ছবি প্রদর্শনের সুযোগে এস জয়শঙ্কর গৌরবাচ্ছন্ন হতে পারেন, কিন্তু চীন ততক্ষণে চুপি চুপি ভারতের সঙ্গে তার স্বঘোষিত সীমান্ত পোক্ত করে নিচ্ছে এবং মালদ্বীপ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমারের সঙ্গে গড়ে তুলছে নতুন অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক। রাজনাথ সিং বিশ্বাস করতে পারেন যে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাজ হল—সময়ে সময়ে সৈন্যদল পরিদর্শন করা এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসএ) ও কম্বাইন্ড ডিফেন্স সার্ভিসকে (সিডিএস) কম গুরুত্ব দেওয়া। অন্যদিকে, যখন বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বছরে ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি (পরিমাণটা শুধুমাত্র চীনের সঙ্গেই ৮৫ বিলিয়ন ডলার) থেকে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল, তখন পীযূষ গোয়েল এই ধারণা ফেরি করতে পারেন যে, শিল্প ও বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারত উন্নতি করছে! পি কে মিশ্রকে প্রধান সচিব এবং অজিত দোভালকে এনএসএ হিসেবে নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে মোদি সরকার নিশ্চিত করেছে যে, তারা আগের জায়গাতেই অনড় রয়েছে, সই এবং সিলমোহর দুটিই পড়েছে সেই চিন্তাধারায়।
এটা মোটেই মোদি ৩.০ নয়, মোদি ২.১ সরকার।
জনগণ তাদের জীবনে ‘ভালোর জন্য একটা পরিবর্তন’ চেয়েছিল। চাকরি, জিনিসপত্রের দামে স্থিতিশীলতা এবং শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে ভোট দিয়েছে জনগণ। একই মন্ত্রীরা একই দপ্তর দখল করে থেকে যদি একই নীতির প্রচার করে যান, তবে তার মানে দাঁড়াবে জনগণের রায়ের প্রতি নিষ্ঠুর উপহাস করা হল। প্রথম ধাপে হল সরকার গঠন। তাতেই মোদিজি দেশকে থমকে দিয়েছেন এবং হতাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতির ভাষণ এবং বাজেট অতঃপর। এই দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের প্রতীক্ষায় রইল জনগণ।