পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
সদ্য একপ্রস্থ ভোট শেষ হল। আড়াই মাসের মহাযজ্ঞ, কর্মহীনতা, সরকারি কাজকর্ম বন্ধ, রাজনীতির নামে কাদা ছোড়াছুড়ি, সংখ্যার লড়াই... এসব এখন ভারতের গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। আমরা আবার মারাত্মক রাজনীতি সচেতন। সেনায় কাজ করবে বলে ছেলেটা চার বছর ধরে নিজেকে তৈরি করার পর অগ্নিবীর নামক এক প্রহসনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, সে নিয়ে আমরা আলোচনা করি না। মেয়েটা বিয়ে হয়ে উত্তরপ্রদেশের ছোট একটা শহরে গিয়েছে। আর গিয়েই দেখেছে, এলাকার লোকজন বাড়ি এসে ঠিক করে দিচ্ছে, সে কী খাবে, আর কী খাবে না। এটাও আমাদের আলোচ্য বিষয়বস্তু নয়। আমাদের আড্ডা বা বৈঠকের অভিমুখ কী? ভোট এবং ভোটের ইস্যু। পরিষেবা নয়। শ্রেণি বা সমাজের বাস্তবিক উন্নতি নয়। অথচ সেটাই একজন সুনাগরিকের হওয়া উচিত। দল বা রাজনীতির দাঁড়িপাল্লায় না তুলে শুধু পরিষেবাকে মাপকাঠি ধরলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারেকাছে পা ফেলা মুশকিল। তারপরও তাহলে বিজেপি কীভাবে ১২টি আসন বাংলায় জিতল?
বাঁকুড়ার ছাতনায় মুদি দোকান চালান শ্যামল সেনাপতি। ভোটের আগে ওই এলাকায় গিয়ে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। আলোচনা যে বাঁকেই নিয়ে যাওয়া হোক না কেন, অবস্থান থেকে তিনি কিছুতেই নড়েন না। তাঁর কথায়, ‘এটা তো মোদির ভোট।’ অর্থাৎ, তাঁর মতো সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনাও এবার একদিকে বয়েছে—নরেন্দ্র মোদি। মোদির হার-জিতটাই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। কী বলা যায় একে? বিজেপির সাফল্য? এর উপর ভর করেই কি ১২টি আসন লাভ? আসলে দু’টি অঙ্ক এখানে কাজ করেছে। প্রথমত, বহু মানুষই প্রধান বিরোধী হিসেবে কংগ্রেসকে ভরসা করতে পারেনি। মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সরকারে তাদের ভবিষ্যৎ কতটা মজবুত হবে, সে নিয়ে সংশয় ছিল অনেকের। তার কারণ, কয়েকটি রাজ্যে জোট শরিকরাই নিজেদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। অর্থাৎ, মতবিরোধ ছিল। তার উপর বিরোধী জোট ক্ষমতায় এলে যদি রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে যান, সেই ছবিটাও মোদির বিকল্প হিসেবে মেনে নিতে পারেননি অনেক ভোটার। তাই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া সত্ত্বেও বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে পুরোপুরি ধস নামেনি। আর বহু চেষ্টা সত্ত্বেও কংগ্রেস ১০০ পেরতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, আরএসএস। সংসদীয় রাজনীতিতে তাদের অস্ত্র ভারতীয় জনতা পার্টি নামক দলের নেতৃত্বের সঙ্গে যতই মতবিরোধ থাকুক না কেন, ভোটের সময় ফিল্ড ওয়ার্কটা তারাই করে থাকে। অন্তত যে কেন্দ্রগুলিতে সঙ্ঘের পছন্দের প্রার্থী টিকিট পেয়েছে, সেই সব আসনে তো বটেই। বাংলার বেশ কয়েকটি জেলার ঘরে ঘরে গিয়ে সঙ্ঘের ‘সেবক’রা বুঝিয়েছেন, রাজ্য সরকারের থেকে পরিষেবা তো আপনাদের প্রাপ্য! কিন্তু তাতে কি কাজ মিলেছে? লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বার্ধক্য ভাতা পেলে নেবেন না কেন? ওটা আপনার অধিকার। কিন্তু কাজটাও আপনার প্রাপ্য। মানুষ শুনেছে, অনেকেই বুঝেছে, অনেকে তাতে ভেসে গিয়েছে। তারা প্রশ্ন করেনি, একই বিষয় তো কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ১০ বছরে তারা আমাদের জন্য কিছু করেনি কেন?
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, মোদির ভোট এবং সঙ্ঘের উদ্যোগ সত্ত্বেও কিন্তু উত্তরবঙ্গের প্রায় সব আসনে বিজেপির দাপট কমেছে। বেড়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিষেবার প্রভাব। তা সে চা-বাগান হোক বা আদিবাসী এলাকা—উত্তরবঙ্গের ছ’টি আসন কিন্তু হেলায় জেতেনি বিজেপি। উপরন্তু দক্ষিণের যে আসনগুলিতে তারা জয় পেয়েছে, সেই সবেও তাদের জোর লড়াই হয়েছে মমতার পরিষেবার সঙ্গে। বেশ কয়েকটি আসনে কান ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছে বঙ্গ বিজেপি। ওই কেন্দ্রগুলিতে তৃণমূলের সংগঠন যদি আরও মজবুত হতো, কিংবা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ফ্যাক্টর হয়ে না দাঁড়াত, গেরুয়া ব্রিগেডের আট পেরনো মুশকিল ছিল। তাহলে একে মোদির সাফল্য বলব? নাকি ব্যর্থতা? লোকসভা তো মোদির ভোট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব আসন পেলেও একক গরিষ্ঠ হতে পারতেন না। জোটের উপরই আস্থা রাখতে হতো। অন্যদিকে একটি করে আসনে জয় মানে মোদির আরও একটি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিকে এগিয়ে যাওয়া। তার মানে একটা বিষয় স্পষ্ট, বাংলাতেও দিনের শেষে ‘মোদির ভোট’ ব্যাখ্যাটা কাজে আসেনি। আজ ফল বেরনোর পর মরিয়া হয়ে কয়েকটি বিষয়ের উপর জোর দিচ্ছে বিজেপি। তার মধ্যে প্রধান হল, বিধানসভা আসনের নিরিখে ৮৮টিতে জয় পেয়েছে তারা। আর শহর তথা পুর এলাকায় তৃণমূলের লিড প্রায় সর্বত্র কমেছে। এই উদ্বাহু প্রচারের কারণ কী? ৮৮ বিধানসভা আসন সামনে খাড়া করেও তো বাংলায় নির্বাচিত সরকার ফেলে দেওয়া যাবে না। আবার এই একই অঙ্কে তৃণমূলের ১৯৪ আসন প্রাপ্তির গরিমাও কিন্তু ক্ষুণ্ণ হবে না। তাহলে হঠাৎ কেন এই মরিয়া চেষ্টা। উত্তর একটাই—২০২৬।
আর দু’বছরের মধ্যেই বাংলায় বিধানসভা নির্বাচন। এর মাঝে আরও একটি মাইলস্টোন গেরুয়া শিবিরের জন্য অপেক্ষা করছে। আগামী বছর সঙ্ঘের শতবর্ষ। তাই চব্বিশের ভোটে বিজেপির জিতে সরকারে ফেরাটা আরএসএসের জন্য খুব দরকারি ছিল। ২৪০’এ নরেন্দ্র মোদির থমকে যাওয়াটা কিন্তু সঙ্ঘের জন্য শাপে বরই হয়েছে। এই ফলাফলে সবার আগে অপমৃত্যু ঘটেছে ব্যক্তিসর্বস্ব হয়ে ওঠা বিজেপির। এবং আরএসএস ফিরে এসেছে স্বমহিমায়। ১০০ বছর ধরে বেশ কিছু এজেন্ডা মনের মধ্যে পুষে রেখেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। তার মধ্যে যেমন রয়েছে হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন, তেমনই আছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। বিজেপি সরকারে থাকলেও সেই প্রশাসনে যদি সঙ্ঘের প্রখর ভূমিকা না থাকে, এমন এজেন্ডা কখনও সফল হবে না। পথ মসৃণ করেছে ২৪০। নতুন সরকার গঠনের পর কয়েকটি সিদ্ধান্তে নজর করা যাক—১) জনকল্যাণমূলক যাবতীয় মন্ত্রক তুলে দেওয়া হয়েছে আরএসএস ঘনিষ্ঠ বিজেপি নেতাদের হাতে। যেমন গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক, স্বাস্থ্য, পরিবহণ। ২) মোহন ভাগবত থেকে ইন্দ্রেশ কুমার, সঙ্ঘের প্রথম সারির সব নেতা খড়্গহস্ত হয়ে রয়েছেন নরেন্দ্র মোদির ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কারের বিরুদ্ধে। ৩) দলীয় সংগঠনের ব্যাপারে সরাসরি বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অনেক হয়েছে... এবার সঙ্ঘই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। সোজা কথায়, তৃতীয়বার এনডিএ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে আরএসএস। আর এই নিয়ন্ত্রণ শুধু কেন্দ্রে নয়, রাজ্যগুলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হচ্ছে। বাংলায় রাজ্য সভাপতি পদে সুকান্ত মজুমদারের বিদায় সময়ের অপেক্ষা। তাঁকে দু’টি রাষ্ট্রমন্ত্রক দিয়ে মোটামুটি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছে। সুকান্তবাবুর জায়গায় এবার এমন কাউকে সঙ্ঘ চাইছে, যিনি সরাসরি নাগপুর হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে তালমেল রেখে চলবেন। আবার একটু দাপুটেও হবেন। এই নিয়োগের কাজটি কাগজে কলমে করবেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি। অর্থাৎ এই মুহূর্তে জে পি নাড্ডা যে পোস্টে আছেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে নাড্ডার বদলিও আসন্ন। দেখার বিষয় হল, নাড্ডার জায়গায় এবার কে বসতে চলেছেন। কারণ, তাঁর দাপট অনুযায়ী অন্য রাজ্যগুলির সংগঠনও নিয়ন্ত্রিত হবে। আর সেখানে অবশ্যই নরেন্দ্র মোদির কোনও ইয়েস ম্যানকে চাইছে না সঙ্ঘ। পাশাপাশি বাংলায় সাধারণ সম্পাদক পদে যাঁকে বসানো হবে, তিনি তাঁর টিম নিজের মতো তৈরি করে নেবেন। অর্থাৎ সহ সভাপতি, জেলা, মণ্ডল, শক্তিকেন্দ্র, বুথ এবং অন্যান্যদের নাম প্রস্তাব করবেন তিনি। তবে সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) পদে বদল কিন্তু সভাপতি করতে পারবেন না। এখানেই আর একবার শক্তিশালী হয়ে উঠছে সঙ্ঘ। দিল্লির দরবারে যা শোনা যাচ্ছে, এই পদের অধুনা অধিকারী অমিতাভ চক্রবর্তীকেও অন্য রাজ্যের দায়িত্ব দিয়ে সরিয়ে দেবেন মোহন ভাগবত। তাঁর জায়গায় কে আসবেন, তা নিয়ে এই মুহূর্তে তুমুল জল্পনা চলছে। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার—বিরোধী দলনেতা এবং সাধারণ সম্পাদকের (সংগঠন) মিলিজুলি ভেঙে দেওয়ার দিকেই এগচ্ছে আরএসএস। পরিষদীয় দলের নেতাকে বলা হচ্ছে, তুমি তোমার কাজ নিয়ে থাকো। সংগঠনের ব্যাপারে তোমাকে মাথা গলাতে হবে না। পাশাপাশি প্রার্থী ঠিক করার ব্যাপারেও তোমার ডানা ছেঁটে দেওয়া হচ্ছে। ওই সবটাই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং সঙ্ঘ ঠিক করবে। ফলে বঙ্গ বিজেপিতে যে তিনটি গোষ্ঠী তৈরি হয়ে গিয়েছিল, ২০২৬ ভোটের আগে সেটা উপড়ে ফেলতে চাইছে সঙ্ঘ। সেক্ষেত্রে বাংলার আসন্ন বিধানসভা ভোটেও কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী পদে বিজেপির অটোমেটিক চয়েজ বলে কেউ থাকবে না। আরএসএস জানে, বাংলার গেরুয়াকরণের স্বপ্ন সফল করতে গেলে পায়ের নীচে শক্ত মাটি চাই। সেটা সংগঠনের। দলবদলুদের অ্যাম্বিশনের ডানায় চেপে শুধু ভরাডুবিই সম্ভব, মানুষের মনে জায়গা করা নয়।
ও হ্যাঁ, বলা হয়নি যে, পোর্তো আলেগ্রেতে ১৫ বছরের মধ্যে বড়সড় বদল এসে গিয়েছিল। কেমন সেই বদল? বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, দেড় দশকের মধ্যে ওখানে নিরক্ষরের সংখ্যা শূন্য, ৯৮ শতাংশ বাড়িতে পানীয় জল, ৮৭ শতাংশ বাড়িতে নিকাশি ব্যবস্থা। সাফল্যের কৃতিত্ব? শুধুমাত্র দুয়ারে সরকারের। ব্রাজিল দেখিয়েছিল, পরিষেবা মানুষের কাছে পৌঁছলে ভোট চাইতে ধর্ম, হিংসা, রাজনীতির প্রয়োজন হয় না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিন্তু সেটাই প্রমাণ করেছেন। তাই ২৬ সালের দিকে নজর বিজেপির থাকতেই পারে, ভোটটা কিন্তু মোদির হবে না। ২০২৬ দিদির ভোট।