পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
জয়ী শাসকের অন্দরেই এত টানাপোড়েন আর আত্মসমালোচনার ধুম শেষ কবে দেখেছে দেশ? এক্স হ্যান্ডেল থেকে একদা প্রধানমন্ত্রীরই আহ্বানে গড়ে ওঠা ‘মোদি কা পরিবার’ বাদ দেওয়ার আবেদনই-বা কীসের ইঙ্গিত? এ কি ‘আমিত্বে’র পাপক্ষালন কিংবা নৈতিক পরাজয় মেনে নিয়ে শুভবুদ্ধির উদয়? ১৯৬২ সালের পর তাঁর টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অভাবনীয় কীর্তিকে দুয়ো দিয়ে নিজেই ভক্তদের বলছেন, ‘মোদি পরিবার’ লেখা বন্ধ করুন। বাস্তবের মাটিতে গোত্তা খেয়ে নামা চারশো পারের প্রকাণ্ড বেলুনের কী নির্মম পরিণতি! এক ঝটকায় ‘মোদির গ্যারান্টি’ খোলস ছেড়ে আজ এনডিএ’র প্রতিশ্রুতি! উল্টোদিকে দেখুন, সরকার গড়তে না পারলেও কংগ্রেস বিজয় উৎসব পালনে বেরিয়ে পড়েছে। সেঞ্চুরিও হয়নি, জুটেছে মাত্র ৯৯! তবু যেন কিছুই হারাবার নেই। পুরোদস্তুর লাভই হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ আর মহারাষ্ট্র থেকেই দলটার পুনরুজ্জীবন ঘটেছে এমন ভাব। সঙ্গী পাঞ্জাব আর হরিয়ানার কৃষক বিক্ষোভ। অনুগত মাঝারি মাপের এক অপরিচিত নেতাকে দিয়ে আমেথি পুনরুদ্ধার করে মৃগয়ায় মেতেছে গান্ধী পরিবার। ওয়েনাড়ের সঙ্গে রায়বেরিলিও অক্ষুণ্ণ। ব্যবধান যথাক্রমে ৩ লক্ষ ৬০ হাজার এবং ৩ লক্ষ ৯০ হাজার। উত্তরপ্রদেশের ৪০৩ বিধানসভা আসন ছুঁয়ে জনসংযোগ যাত্রায় বেরবার এই তো সঠিক সময়। সে-কথাই ঘোষণা করা হয়েছে এআইসিসির পক্ষ থেকে। দলিত, ওবিসি, আদিবাসী ও মুসলিমরা ইন্ডিয়া জোটের দিকে হাত বাড়িয়েছে। আর গেরুয়া শিবির হতোদ্যম, কতদিন পাল্টুরাম জোট শরিকদের দিয়ে-থুয়ে তাঁবে রাখা যাবে, তা নিয়েই কাটাকুটি খেলা চলছে। ভয় এতটাই যে অযথা কাউকে কোনও বিষয়ে মন্তব্য করতে পর্যন্ত নিষেধ করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। ছোট-বড় সবার মুখে তালা। এমনকী, প্রথম কলিঙ্গ জয়ের সাফল্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার মনটাও যেন মরে গিয়েছে। এর শিক্ষা একটাই, বেলুন বেশি ফোলাতে নেই। তাতে বিপদ দুই প্রকার—হয় লোক হাসিয়ে সশব্দে ফাটবে, না-হয় তো হাতের সুতো ছিঁড়ে তা আকাশের দু’শো অচেনা তারার মধ্যিখানে হারিয়ে যাবে! বিজেপির ঠিক সেই দশা, অতিদর্পে হাতের রশিটাই কখন চুরি হয়ে গিয়েছে। এখন আদর্শের চুলোচুলি চলছে দল ও আরএসএসের থিঙ্কট্যাঙ্কের মধ্যে। সঙ্ঘ এতদিন চুপ ছিল। এখন ঘোমটা নামিয়ে সরাসরি বলছে, ভগবান রাম ঔদ্ধত্যের শাস্তি দিয়েছেন, অযোধ্যা থেকে সীতাপুর, দক্ষিণে রামেশ্বরম কোথাও প্রসন্ন হননি রামসেবকদের ওপর। ২৪০ আসনে থেমে যাওয়া তারই প্রমাণ!
কে না জানে, দিল্লি দখল করার চাবিকাঠি লুকিয়ে উত্তরপ্রদেশের ফলাফলেই। গত দশবছর উত্তরপ্রদেশে একাধিপত্যের জোরেই সরকার ও দল সর্বত্র বিরোধীদের থোড়াই কেয়ার মনোভাব ছিল মোদিজির। সেই ‘বাস্তিল’ দুর্গের পতন হয়েছে দীর্ঘ একদশক পর। ৪০ বছর পর সবাইকে চমকে এলাহাবাদ আসনে আবার জয়ী হয়েছে রাহুল ও সোনিয়ার কংগ্রেস। ১৯৮৪ সালে শেষবার কংগ্রেসের টিকিটে এলাহাবাদে জয়ী হয়েছিলেন মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চন। তারপর দীর্ঘ শূন্যতা। নেহরুর স্মৃতিবিজড়িত শহরটি শুধু হাতছাড়াই হয়নি, কংগ্রেসের আধিপত্যও গোটা রাজ্যে ধীরে ধীরে অস্তমিত হয়ে যায়। এবার কংগ্রেসের উজ্জ্বল রামন সিং ৫৮ হাজার ভোটে হারিয়েছেন বিজেপির নীরজ ত্রিপাঠীকে। গান্ধী পরিবারের গড় বলে পরিচিত আমেথি ও রায়বেরিলিতেও বিজয় উৎসব করছে কংগ্রেস। পাঁচবছর আগে রাহুল গান্ধীকে হারিয়ে আমেথির দখল নেন বিজেপির স্মৃতি ইরানি। অসুস্থতার কারণে রায়বেরিলিতে এবার সোনিয়াজি দাঁড়াননি। শেষ মুহূর্তে নেমেও আসনটি পুনরুদ্ধার করেছেন রাহুল। অনেক টানাপোড়েনের পর আমেথিতে প্রার্থী করা হয় ১০ জনপথের একান্ত অনুগত কিশোরীলাল শর্মাকে। কিশোরী জেতেন ১ লক্ষ ৬০ হাজার ভোটে। কংগ্রেসিরা সেই দেখেই আশায় বুক বাঁধছেন। বলছেন যদি প্রিয়াঙ্কা দাঁড়াতেন তাহলে শুধু আমেথি নয় বারাণসী আসনটিও দখলে চলে আসত—নির্ঘাত হারতেন ৫৬ ইঞ্চি! এমনই দাবি উজ্জীবিত কংগ্রেসের। উত্তরপ্রদেশে জাগলেই তা সংক্রামিত হবে সারা দেশে।
এবার কংগ্রেসের সরকার গড়া হয়নি ঠিকই, কিন্তু দলের আসzন সংখ্যা একলাফে ৫২ থেকে বেড়ে ৯৯ হয়েছে, সঞ্জীবনী বটিকা এটাই। তারও আগে চোদ্দো সালে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪৪টি আসন। আর বিভিন্ন রাজ্যে সার্বিক আসন সমঝোতা না-হলেও ইন্ডিয়া জোট ২৩৫ আসন জিতে বিজেপির ঘাড়ে ক্রমাগত নিঃশ্বাস ফেলছে। রাজ্যে রাজ্যে আসন সমঝোতা করে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দাঁড় করানো গেলে ২৪০ আসনও পেত না গেরুয়া শিবির। জাতীয় রাজনীতির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ রাজ্য উত্তরপ্রদেশে জোট গড়ে লড়ে বিজেপিকে অনেক পিছনে ফেলে দিতে সমর্থ হয়েছে কংগ্রেস ও অখিলেশ জোট। তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলেও এই নৈতিক পরাজয়টাকে কিছুতেই অস্বীকার করতে পারছেন না মোদিজি।
সভা-সমিতি, চায়ের আড্ডা ও সান্ধ্য আলোচনায় গত ছ’মাস ধরে একমাত্র আলোচ্য ছিল—উত্তরপ্রদেশের ৮০টি লোকসভা আসনের মধ্যে বিজেপি গতবারের ৬২ আসন ছাপিয়ে ঠিক কত-য় থামবে? ফল বেরতে দেখা গেল, ৬২ পেরনো দূর, ৯ শতাংশ ভোট হারিয়ে বিজেপি থেমে গিয়েছে ৩৩ আসনে! আর অখিলেশ-কংগ্রেস জোট সবাইকে তাক লাগিয়ে পেয়েছে ৪৩টি আসন। এইটুকু পড়ে অনেকে ভাবতেই পারেন ফল বেরনোর ১২ দিন পর এই তথ্য তো ইতিমধ্যেই বাসি হওয়ার পথে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, যদি মায়াবতী ভোট কেটে অখিলেশের যাত্রাভঙ্গ না করতেন তাহলে আরও অন্তত ১৬টি আসন বিজেপিকে হারতে হতো, থামতে হতো ১৭-য়! সেক্ষেত্রে সরকার গড়ার স্বপ্ন পরিণত দুঃস্বপ্নে। যেমন ধরুন, ফতেপুর সিক্রিতে বিজেপি জিতেছে ৪৩,৪০৫ ভোটে। অথচ ওই আসনে মায়াবতীর বিএসপি পেয়েছে ১ লক্ষ ২০ হাজার ভোট। একই অবস্থা আলিগড়, ফারুকাবাদ ও আমরোহার। আলিগড়ে বিজেপি জিতেছে মাত্র ১৫,৬৪৭ ভোটে। ওই কেন্দ্রেও বিএসপি পেয়েছে ১ লক্ষ ২৩ হাজার ভোট। ফারুকাবাদের চিত্র আরও কঠিন। মাত্র আড়াই হাজারের সামান্য কিছু বেশি ভোটে বিজেপি আসনটি দখল করেছে। হাড্ডাহাড্ডি সেই লড়াইয়ে মায়াবতীর দলের প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ৪৫ হাজার। বিজেপির কাছে এই ভোট কাটাকুটি নিঃসন্দেহে আশীর্বাদ? সব অর্থেই উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে বড় লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন মায়াবতী। না-হলে তৃতীয়বার শপথ নেওয়াই সম্ভব হতো না মোদি-অমিত শাহ বাহিনীর। উত্তরপ্রদেশে হেরে কুর্সির দৌড় থেকে ছিটকেই যেতেন ‘বিশ্বগুরু’।
সেক্ষেত্রে ইতালিতে চলতি জি-৭ গোষ্ঠীর বৈঠকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতেন কে, তা কোটি টাকার প্রশ্ন।
পাঁচবছর আগে ২০১৯ সালের রাজ্যওয়াড়ি ভোটের ফলে উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র দুই রাজ্যেই একটি, দুটি করে আসন পেয়ে কংগ্রেস প্রায় আইসিইউতে চলে গিয়েছিল। এবার উত্তরপ্রদেশে ৬টি এবং মহারাষ্ট্রে ১৩টি আসন মিলেছে তাদের। অখিলেশ জিতেছেন ৩৭টি। সব মিলিয়ে উত্তরপ্রদেশে ৪৩টি আসন জিতে অমিত শাহদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে ইন্ডিয়া জোট। আর বিজেপির সৌজন্যে বত্রিশভাজা মহারাষ্ট্র রাজনীতিও মুখ ফিরিয়েছে। হরিয়ানাতেও ইন্ডিয়া জোট ভালো করেছে। কেরলেও কংগ্রেসের অভূতপূর্ব সাফল্যে প্রায় নিশ্চিহ্ন বামেরা। মূলত বিহার, ওড়িশা, অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানাই এবার মুখরক্ষা করেছে নরেন্দ্র মোদির। তা না-হলে দু’দশক পর বাজপেয়ি আমলের ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’র মুখ থুবড়ে পড়ার রিপ্লে দেখতে হতো আম জনতাকে। এই দেওয়াল লিখনটাই বিজেপিকে জয় উপভোগ করতে বাধা দিচ্ছে। কোথায় যেন পা টেনে ধরছে। তামিলনাড়ুতে প্রায় প্রতি সপ্তাহে গিয়েও আস্ত অশ্বডিম্ব প্রসব করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আসন তো মেলেইনি, উল্টে রাজ্য বিজেপি প্রধান আন্নামালাইয়ের সঙ্গে আর এক হেভিওয়েট নেতা তামিলসাইয়ের বিরোধ সামনে চলে এসেছে। উত্তরপ্রদেশের এই ফল সরাসরি মোদিজির প্রতি অনাস্থা, না পদে পদে উপেক্ষিত হয়ে যোগীজির প্রতিশোধ, সেই জল্পনাও চলছে দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের সাতমহলা পার্টি অফিসে।
বহুমুখী চাপ আর অস্বস্তির মুখে দেশে নানা কারণে বিজয় উৎসব করার সুযোগ না পেলেও প্রধানমন্ত্রী বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। ইতালির জি-৭ মঞ্চে তাঁর বিশ্বগুরু ভাবমূর্তি কতটা উজ্জ্বল হবে জানি না। তবে বিশ্বনেতা জেলেনস্কি, মেলোনি, সুনাকের সঙ্গে করমর্দনে মিলিত হয়েও তাঁর মন নির্ঘাত পড়ে রয়েছে দেশে, সাউথ ব্লকের অলিন্দে। আধো অন্ধকারে তিনি ভূত দেখছেন গিরিধর গোমাংয়ের। ১৯৯৯ সালে গিরিধরজির একটি ভোটেই ১৩ মাসের মাথায় পড়ে গিয়েছিল অটলজির সরকার। গিরিধর তখন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সাংসদ পদে ইস্তফা দেননি। সটান সংসদে গিয়ে বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে বাজপেয়ি সরকার ফেলে সেদিন অনর্থ ঘটিয়েছিলেন তিনি। মোদিজি কি গিরিধরের ছায়া দেখছেন শরিকদের মধ্যে? বছর শেষে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা ভোট। অন্তত দুটি রাজ্যে জিততে না-পারলে বিজেপির রাজনৈতিক কর্তৃত্ব খতম হতে বাধ্য। তাই সরকার গড়লেও মোদিজি স্বস্তিতে নেই মোটেই। হিন্দুত্বের এজেন্ডা, এক দেশ এক নির্বাচন, দেশকে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করার চেয়েও তাঁর সামনে সরকার টিকিয়ে রাখাই এই মুহূর্তে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আপাতত বেলুনওয়ালার বিদায়, গেরুয়া রাজনীতির ধ্রুবপদ একটাই—আপনি বাঁচলে বাপের নাম!