পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
যাঁরা নিজেদের ‘স্বাধীনতার ভগীরথ’ বলে দাবি করেছিলেন তাঁরা অতিদ্রুত ভুলে গিয়েছিলেন বাঙালি শরণার্থীদের প্রতি তাঁদের অঙ্গীকার-দায়িত্ব-কর্তব্য। প্রচারসর্বস্ব দানখয়রাতি কিছু জুটলেও ‘পুনর্বাসন’ কত বাঙালি উদ্বাস্তু পরিবার পেয়েছিল, সেই উত্তর সেকালে মেলেনি, আজও তা অধরা, অথচ দিল্লি ও কলকাতায় একযোগে চালু ছিল এই সংক্রান্ত দপ্তর। স্বাধীনতার নামে চেপে বসা দেশভাগের বলি হয়েছিল পশ্চিম প্রান্তের রাজ্য পাঞ্জাবও। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকেও এপারে উঠে আসেন কয়েক লক্ষ উদ্বাস্তু নারী-পুরুষ। তাঁদের পুনর্বাসন সমস্যা দ্রুত মেটানো হলেও চূড়ান্ত বৈষম্যের বলি হন বাঙালিরা। একযাত্রায় এই পৃথক ফলের জন্য উদ্বাস্তু বাঙালিকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ওইসঙ্গে ছিল নেতাজির সঙ্গে জাতীয় নেতৃত্বের বঞ্চনা-শঠতার যন্ত্রণা। সব মিলিয়ে কংগ্রসকে কোনোদিনই তার রাজনৈতিক শক্তি বলে বাঙালি মনে করেনি। একমাত্র বিধানচন্দ্র রায়ের কর্মদক্ষতা বাঙালিকে মুগ্ধ করেছিল। ১৯৬২-তে কর্মরত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু না-হলে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো কি না জানার সুযোগ নেই। তবে তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই যে বাঙালির মন থেকে কংগ্রেসের বিসর্জনের আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছিল তাতে বিতর্কের অবকাশ কমই।
প্রফুল্ল ঘোষ, প্রফুল্ল সেন ও অজয় মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে রাইটার্স যে-ক্ষমতার রাজনীতি প্রত্যক্ষ করেছে, তাতে কংগ্রেসের মহিমা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকী, বাহাত্তরে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে দিয়ে রাইটার্স দখল করেও বঙ্গে কংগ্রেস আর শক্তিশালী হয়নি, ঘটেছিল বরং উল্টোটাই—দলের মূলোচ্ছেদের বন্দোবস্ত! কারণ ‘সিদ্ধার্থশঙ্কর’ শব্দটি তাঁরই হাতযশে ‘গণতন্ত্র’-এর বিপরীতার্থক হয়ে উঠেছিল। ওইসঙ্গে দিল্লি লাগাতার উপহার দিয়ে গিয়েছে বাংলার প্রতি বঞ্চনার রকমারি। উদ্বাস্তু জনগণের ক্ষোভের আগুনে বাংলার প্রতি বঞ্চনা সুসিদ্ধ করে ভোটের বাজারে সহজপাচ্য পথ্যের মতোই পরিবেশন করেছেন মার্কসবাদী কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বামপন্থীরা। সাতাত্তর থেকে টানা সাতবার কেল্লা ফতে হয়েছে ওই এক টোটকাতেই।
জ্যোতি বসুর সরকারকে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপের হুংকার একাধিকবার দিয়েছিলেন গনিখান চৌধুরী। রাজীব গান্ধীও আওয়াজ তুলেছিলেন, ‘এই হতাশা ভাঙতে চাই, নতুন বাংলা গড়তে চাই’। কিন্তু তাঁর ডাকে সেদিন তো বটেই, বাংলা তার পরেও কখনও সাড়া দেয়নি। ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর বাঙালি সবচেয়ে হতাশ হয়েছিল প্রণববাবুর প্রতি বঞ্চনা দেখে। এমনকী দু-দুটি ইউপিএ সরকারেও সোনিয়া গান্ধী যোগ্য সম্মান দেননি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। তাঁকে রাষ্ট্রপতি (২০১২-১৭) পদের ‘ললিপপ’ বাঙালি মুখেই তোলেনি। ততদিনে রাইটার্স থেকে পগার পার হয়ে গিয়েছে সিপিএম। কিন্তু সেই বিশাল শৃন্যস্থান পূরণে, ৩০ এপ্রিল ১৯৭৭-এর পর, কংগ্রেসের আর ডাক পড়েনি। ২০ মে, ২০১১ থেকে দাপটে রাজপাট সামলাচ্ছেন মা-মাটি-মানুষের জনপ্রিয়তম নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তীকালে বিধানসভাতেও বিগ জিরো হয়ে গিয়েছে সিপিএম, সঙ্গে দোসর কংগ্রেস। ঠিক কার ‘সঙ্গদোষে’ যে কার এই সর্বনাশ হল, এটা রাজনীতির ছাত্রদের একটি সময়োচিত গবেষণার বিষয়। তবে স্বাধীনোত্তর ৭৭ বছরের রাজনীতির চর্চায় এটুকু পরিষ্কার যে, তাকে বঞ্চনার নায়ককে বাংলা কখনোই তার নিকনো দাওয়ায় বড়পিঁড়ি পেতে দেবে না।
সামনে এত সুন্দর সহজপাঠ রয়েছে, মোদি-শাহ জুটি তা পড়ে দেখতে আগ্রহী হলেন না, কিছু না দিয়েই বাংলার মন জয়ের খোয়াব দেখলেন তাঁরাও! অন্তত নরেন্দ্র মোদি ভেবেছিলেন, ভোটের বাজারে রবীন্দ্রনাথ সাজা কিংবা ভাষণের মাঝে মাঝে বিকৃত বাংলায় দু-চারটি বাক্য আওড়ানোই যথেষ্ট, বাঙালি গলে জল হয়ে যাবে। এহেন গেরুয়া শো একুশের ভোট থেকেই ফ্লপ হতে শুরু করেছে, চব্বিশে এসে তো সুপার ফ্লপ! হবে নাই-বা কেন? উনিশে বাংলা মোদিকে ১৮ জন এমপি দিয়েছিল। কিন্তু প্রতিদানে পেয়েছিল কী? ফিরে যাওয়া যাক চোদ্দোয়, দেশে মোদিযুগের সূচনা পর্বে। সেবার বাংলা থেকে দুটি আসন পেয়েছিল বিজেপি—আসানসোল এবং দার্জিলিং। বাংলার মানুষ ভোলেনি আসানসোলের ভোটদাতাদের কাছে মোদির সেদিনের দাবি—‘মুঝে ... চাহিয়ে!’ প্রথম মন্ত্রিসভার সূচনাতেই মন্ত্রী করা হয় আসানসোলের এমপিকে এবং বছর দুই বাদে মন্ত্রিসভায় জায়গা পান আলুওয়ালিয়া। উল্লেখ্য, তাঁরা দু’জনেই ছিলেন রাষ্ট্রমন্ত্রী। ২০০৯-এ বাংলা থেকে বিজেপি এমপি হন একজনই। কিন্তু দার্জিলিঙের যশবন্ত সিনহাকে নিয়ে বাঙালির তেমন আবেগ ছিল না। এগারোয় রাজ্যে পালাবদলের পর বিরোধীরা বাংলার মাটিকে তাদের দুর্জয় ঘাঁটি ভাবা ছেড়ে দেয়। ২০১৪ সালে বামফ্রন্ট ১৫ থেকে মাত্র ২-এ নেমে আসে! তারই বিপরীতে, ওই কঠিন মাটিতেও বিজেপি দখল করে বাংলার সাবেক শাসক সিপিএমেরই সমান সংখ্যক আসন (২)। স্বভাবতই, বাংলার মানুষের বিশেষ প্রত্যাশা ছিল মোদির কাছে, কেননা কেন্দ্রে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের (২০১২-তে রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী) পর বাংলা আর কোনও পূর্ণমন্ত্রী পায়নি। কিন্তু সেই আক্ষেপ-হতাশা দূর করার কোনও উদ্যোগ মোদি নেননি।
এরপর ২০১৯। প্রবল মোদি-বিরোধী ঢেউ উপেক্ষা করেই, বাংলার বহু কোটি মানুষ মোদির প্রতিনিধিদের ভোট দেন। একলপ্তে নির্বাচিত হন ১৮ জন, দলের রাজনৈতিক দাবি যাই থাক, বিজেপির ইতিহাসে সে ছিল এক অভাবনীয় ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা! কিন্তু অতঃপর বাংলার মানুষ আরও অবাক হয়ে দেখল, সেবারও মন্ত্রিসভায় কোনোরকম গুরুত্ব পেল না বাংলা। মন্ত্রী করা হল মাত্র দু’জনকে। আসানসোলের এমপি নগরোন্নয়ন এবং রায়গঞ্জের দেবশ্রী চৌধুরী নারীকল্যাণ মন্ত্রক পেলেন। দু’জনকেই করা হল নিয়মরক্ষার রাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাধীন দায়িত্বও দেওয়া হল না তাঁদের! ২০২১-২২-এ আসানসোলের এমপি গেরুয়াবেশ ত্যাগ করেন। পরে অজ্ঞাত কারণে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন দেবশ্রীও। ফলে, দেশের মন্ত্রিসভায় ১৮ এমপির বাংলার প্রতিনিধিত্ব পুরো ‘শূন্য’ হয়ে যায়! দেখেশুনে এই বিভ্রম হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গ নামক সবচেয়ে রাজনীতি সচেতন রাজ্যটি বোধহয় ভারতের মানচিত্র থেকে সাময়িক ছুটি নিয়েছে! অতঃপর, মোদির মন্ত্রিসভায় জায়গা পেলেন অন্য চারজন—শান্তনু ঠাকুর, সুভাষ সরকার, নিশীথ অধিকারী এবং জন বারলা। শেষদিন পর্যন্ত মন্ত্রিসভায় তাঁরাই থেকে গিয়েছিলেন, তবে রাষ্ট্রমন্ত্রী (বিরোধী কটাক্ষে যা ‘অর্ধ’ কিংবা ‘সিকি’ মন্ত্রী) পরিচয়ে।
সব মিলিয়ে নরেন্দ্র মোদি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সরকারের কাছে যাহাই ২ তাহাই ১৮! অতএব, বারোজন গেরুয়া এমপির বাংলা এবার যে আরও গুরুত্ব হারাতে চলেছে, এই সহজ অনুমান রাজনৈতিক মহল আগেই করেছিল। ৯ জুন পরিষ্কার তাতেই সিলমোহর দিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর তৃতীয় মন্ত্রিসভায় বাংলা থেকে জায়গা পেলেন মাত্র দু’জন এবং যথারীতি রাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেই—একজন দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এবং অন্যজন মতুয়া নেতা শান্তনু ঠাকুর। অর্থাৎ অর্ধ বা সিকি মন্ত্রীর সংখ্যাটিও হাফ হয়ে গেল! লক্ষণীয় যে, এমনও একাধিক নেতা মন্ত্রিসভায় সমাদৃত হয়েছেন, যাঁরা সংসদের কোনও কক্ষেরই সদস্য নন। যেমন ভোটে গোহারা হয়েও মন্ত্রী হয়েছেন পাঞ্জাবের রভনীত সিং বিটু। মন্ত্রিসভায় আরও ঢুকেছেন তামিলনাডুর প্রাক্তন বিজেপি সভাপতি এল মুরুগান। তিনিই গত মন্ত্রিসভার একমাত্র পরাজিত সদস্য (তবে রাজ্যসভার এমপি), যিনি এবারও মন্ত্রিত্ব ফিরে পেলেন। অন্যদিকে, সুরেশ গোপীর সৌজন্যে এবারই কেরলে খাতা খুলেছে বিজেপি, মোদি তাঁকেও মন্ত্রী করেছেন। সেখানে দলের খ্রিস্টান নেতা জর্জ কুরিয়েন মন্ত্রী হয়েছেন ভোটে না লড়েও! সুদূর দক্ষিণী রাজ্যটিতে প্রভাব বাড়াতেই এই কৌশল। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ধরাশায়ী। তবু মন্ত্রিসভায় সর্বাধিক (৯) সদস্য ইউপি থেকেই। এরপরেই বিহার (৪ জন পূর্ণমন্ত্রীসহ মোট ৮) এবং মহারাষ্ট্র (দু’জন পূর্ণমন্ত্রীসহ মোট ৬)। গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান পাঁচজন করে মন্ত্রী পেয়েছে। গুজরাতে ক্যাবিনেট মন্ত্রীই চারজন—তার মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ!
অর্থাৎ বিজেপি নেতৃত্ব বেশ জানেন, ভোটবৃদ্ধির জন্য সংগঠন মজবুত করা জরুরি। দিয়েথুয়ে মন জয় করতে না পারলে কোনও সমাজ তাদের সংগঠনমুখী হবে না। রাজ্যের নেতা-প্রতিনিধিরা দিল্লির দরবারে ওজনদার পদ না পেলে বাংলার জন্য দু’হাত ভরে আনবেন কী করে? দশ বছর যাবৎ সত্যিই উল্লেখযোগ্য কিছু আসেনি এরাজ্যে, আসার মধ্যে এসেছে কিছু কেন্দ্রীয় নজরদার টিম এবং সিবিআই, ইডি, আইটি, এনআইএ প্রভৃতি। তারা বরং বাংলা থেকে ঝেঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছে। মোদ্দা কথা হল, সবার জন্যই ‘গিভ অ্যান্ড টেক’, বাদ কেবল বাংলা! এরই পাশে রাখতে হচ্ছে, দার্জিলিংসহ উত্তরবঙ্গ নিয়ে বাংলার অখণ্ডতার পক্ষে উদ্বেগজনক গোপন গেরুয়া এজেন্ডাটিকে।
এসবেরই অনিবার্য পরিণতি দেখতে শুরু করেছে বঙ্গ বিজেপি—ক্ষয় ও ভাঙন—পতনের পোক্ত সড়ক। বিজেপিওয়ালাদের হালফিল মনোভাব অবশ্য মমতা-অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়দের জন্য একদিক থেকে স্বস্তিদায়ক। হলফ করে বলা যায়, বাংলায় প্রভাব বিস্তারের সমস্ত আশাই মোদি অ্যান্ড কোং ছেড়ে দিয়েছেন। মমতাকে টক্কর দিতে দু’শো পারের হুংকার, ছবি হয়ে গিয়েছে উনিশেই। না-হলে লাগাতার আর্থিক বঞ্চনা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পাশে মন্ত্রিত্ব নিয়েও এমন ধ্যাষ্টামো চলে! লেনাদেনার এই হতশ্রী মার্কা প্ল্যান নিয়ে কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষী দল অন্তত বাংলার বুকে রাজনীতি করতে পারে না।