পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মতো দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন নরেন্দ্র মোদিও। কিন্তু আজকের নরেন্দ্র মোদির বেশভূষা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। ট্রয় কস্তা নামে যে বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির তারকাদের পোশাক তৈরি করেন, নরেন্দ্র মোদির পোশাকও তিনিই তৈরি করেন। ‘রোমে গেলে রোমান সাজা’র নীতিকে মাথায় রেখে মোদির বেশভূষাও বদলায় প্রতিটি সফরে। প্রতিটি মুহূর্তে। যদিও রাজনীতির কারবারিরা বলেন, মোদি পোশাক নিয়েও রাজনীতি করেন। আর তাতে তাঁর গোটা শরীর থেকে ফুটে বেরয় অহংকারের দগদগে চিহ্ন! হয়তো নিজের অতীত ভুলে গিয়েছেন। বোঝাই যায় না একসময় তিনি নাকি চা বিক্রি করেছেন। বেড়ে উঠেছেন গরিব পরিবারের যন্ত্রণার মাঝেই...।
এমন টুকরো টুকরো পরিবর্তনের পরিণতিতেই মোদির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) দূরত্ব বেড়েছে। ভোট চলাকালীন বিজেপি সভাপতি জগৎ প্রতাপ (জেপি) নাড্ডা সঙ্ঘ সম্পর্কে এক বিবৃতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বিজেপি যত দিন সক্ষম ছিল না, তত দিন তাদের সঙ্ঘ সাহচর্য প্রয়োজন ছিল। এখন বিজেপি সক্ষম হয়েছে। নিজের ভালোমন্দ নিজেরাই বুঝতে শিখেছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে শিখেছে। এখন আর প্রতি পদে সঙ্ঘের প্রয়োজন নেই।’ কেন নাড্ডা হঠাৎ ওই মন্তব্য করেছিলেন তা এক বিস্ময়। তখন থেকেই শোনা যাচ্ছিল, এবারের ভোটে সঙ্ঘ বিজেপি প্রার্থীদের জেতাতে সেভাবে সক্রিয় হয়নি। নরেন্দ্র মোদির কর্তৃত্ববাদী আচরণ তাদের পছন্দ নয়। যেভাবে সঙ্ঘের আদর্শবিরোধীদের মোদি দলে টেনেছেন, নির্বাচনে প্রার্থী করেছেন, তা তাদের অনুমোদন পায়নি। নির্বাচনী প্রচার পর্বে যে গুঞ্জন পল্লবিত হয়েছিল, তা যে নিছক গুজব ছিল না, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। সরকার গঠনের পরদিন এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রকৃত সেবকের অহংকারী হওয়া সাজে না। মর্যাদা রক্ষা করে তাঁকে চলতে হয়। নির্বাচনী প্রচারে সেই মর্যাদা রক্ষিত হয়নি।’ সেই সঙ্গে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, সরকারকে স্থিতিশীল করতে গেলে মোদিকে সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। ঐকমত্যের উপর জোর দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি বারবার নিজেকে প্রধান সেবক বলে জাহির করতেন। সেই সেবকের প্রকৃত সংজ্ঞা কী, ভাগবত তাঁর ভাষণে তা ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন, ‘যিনি বাস্তবিকই সেবক, যাঁকে সত্যি সত্যিই সেবক বলা যায়, তিনি সব সময় মর্যাদা রক্ষা করে চলেন। যিনি সেই মর্যাদা পালন করে চলতে পারেন, তিনিই কর্মবীর। কিন্তু তাঁকে কাজের মোহগ্রস্ত হলে চলবে না। কাজ করার পর যেন তাঁর অহংকার না আসে। যেন না বলেন, আমিই এই কাজ করেছি। অহংকার যাঁকে গ্রাস করে না, তিনিই প্রকৃত সেবক।’
গত ১০ বছর সরকার পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইচ্ছাই ছিল শেষকথা। সঙ্ঘের ইচ্ছা–অনিচ্ছা প্রাধান্য পায়নি। মোদি নিজেকে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বড় ভেবেছিলেন, নিজেকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ মনে করছিলেন, আচার–আচরণে তার প্রতিফলন ঘটাচ্ছিলেন, সঙ্ঘের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনও বোধ করছিলেন না। এমনকী নিজেকে ঈশ্বরপ্রেরিত পরমাত্মার অংশ বলেও জাহির করে ফেলেছেন। তবু সঙ্ঘ তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্বে যায়নি। প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেনি। এখন বাস্তবের মাটিতে যখন মোদি আছড়ে পড়েছেন, তখন সঙ্ঘও তার প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়েছে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানো মোদির বিজেপিতে এবার সঙ্ঘের প্রভাব বাড়বে কি না, সেটাই এই মুহূর্তের জল্পনা। আর সেই জল্পনা বাড়িয়ে দিয়েছে, সঙ্ঘের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’। সেখানে এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, বিজেপির নেতা–কর্মীরা মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা উড়ছিলেন। এই ভোট তাঁদের আবার জমিতে ফিরিয়ে এনেছে।
‘অর্গানাইজার’-এ সঙ্ঘের অন্যতম সদস্য রতন সারদা এক নিবন্ধে লিখেছেন, এটা ঠিক যে আরএসএস কখনওই বিজেপির পদাতিক বাহিনী নয়। কিন্তু বিজেপির নেতা–কর্মীরা ভোটের কাজে সাহায্যের জন্য এবার স্বয়ং সেবকদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজনই বোধ করেননি। তাঁরা মোদিজির গৌরবে উদ্ভাসিত ছিলেন। জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ভেবেছিলেন, মোদিই জিতিয়ে দেবেন। এই নির্বাচনের ফল আসলে বাস্তব পরিস্থিতি। বিজেপির বহু নেতা–কর্মী অতিমাত্রায় আস্থাশীল ছিলেন। তাঁরা বুঝতেই পারেননি যে ৪০০ পার–এর স্লোগানের লক্ষ্য ছিলেন তাঁরা। মোদি চেয়েছিলেন তাঁদের উজ্জীবিত করতে। সে জন্যই লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি বিরোধীদের ভয় দেখাতেও চেয়েছিলেন। অথচ, নেতা–কর্মীরা নিজেদের বলয়ে আবদ্ধ থাকলেন। মোদির ছটায় নিজেদের ভাসিয়ে দিলেন। জোট প্রসঙ্গে রতন সারদা লিখেছেন, অজিতদের ভেড়ানোয় বিজেপির কর্মীদের মনোবল নষ্ট হয়েছে। কারণ, তাঁরা এত বছর ধরে কংগ্রেসের আদর্শের বিরুদ্ধেই লড়াই করেছেন। অজিত পাওয়ারকে দলে টেনে বিজেপি তার ব্র্যান্ড ভ্যালু নষ্ট করেছে। এরকম ২৫ শতাংশ দলবদলু প্রার্থীকে এবার প্রার্থী করেছিল বিজেপি।
অজিত পাওয়ারের এনসিপির হাল এবার সবচেয়ে খারাপ। মাত্র একটি আসনে জিতে তাঁর দলকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। সেই তুলনায় সিন্ধের অনুগামী সেনাদের হাল খানিকটা ভালো। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ সিন্ধের দলের কাছে রয়েছেন সাত সংসদ সদস্য। দুই দলকে একজন করে স্বাধীন ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীর বেশি বরাদ্দ করেননি মোদি। সিন্ধে রাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাদ্দ গ্রহণ করেছেন নিমরাজি হয়ে, অজিতের সঙ্গী প্রফুল্ল প্যাটেল প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, কেন্দ্রে পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর কম পদমর্যাদার কিছু গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। সিন্ধে ও পাওয়ার, দুই নেতাই জানিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থাকবেন। সিন্ধে তো সরাসরিই প্রশ্ন তুলেছেন, বিহারের ‘হাম’ নেতা জিতেন রাম মাঝি একটি আসন পেয়ে যদি পূর্ণ মন্ত্রী হতে পারেন, তাহলে সাতটি আসন জিতে তাঁর দল কেন সেই সম্মান পাবে না? মোদির চিন্তা হওয়ারই কথা। কারণ, মহারাষ্ট্রের রাজনীতির অলিন্দের খবর, সিন্ধের অনুগামীদের কেউ কেউ উদ্ধব থাকরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। অজিত পাওয়ার আবার সরাসরি কাকা শারদ পাওয়ারের গুণগান করে বলেছেন, এনসিপিকে একা হাতে তিনিই গড়ে তুলেছেন। এসব নেতার পাশাপাশি বেসুরো গাইছেন চন্দ্রবাবু নাইডুও। তাঁর প্রাথমিক চাহিদা ছিল তিন পূর্ণ ও এক রাষ্ট্রমন্ত্রী। সে জায়গায় এক পূর্ণ ও এক রাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে অসামরিক পরিবহণ মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েছেন সর্বকনিষ্ঠ সদস্য তাঁরই অনুগত কে রামমোহন নাইডু। কিন্তু এত অল্পে চন্দ্রবাবু কি সন্তুষ্ট হবেন? ফলে জোট রাজনীতি নিয়ে মোদিরও চিন্তা বাড়ছে।
ভোটের ফল প্রকাশের পর মোদি বেশ কিছুটা কোণঠাসা। ৩০৩ থেকে ২৪০টি আসনে নেমে আসা তাঁর ব্যক্তিগত পরাজয়। কারণ, গোটা নির্বাচনে তিনিই ছিলেন শাসক জোটের একমাত্র মুখ। প্রতিটি আসনেই তিনিই ছিলেন প্রার্থী। জনসভায় নিজেই বারবার সে কথা সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। সেই অর্থে এবারের ভোট ছিল মোদির পক্ষে–বিপক্ষের গণভোট। মোদি সরকার গঠন করলেও নিশ্চিতভাবেই জনতার সেই রায় তাঁর বিপক্ষে গিয়েছে। সেখান থেকে নিজেকে তিনি টেনে তুলতে পারলে আবার স্বমহিমায় ফিরতে পারেন। এই বছরই সেই পরীক্ষায় তাঁকে বসতে হবে। পরীক্ষা কিন্তু বেশ কঠিন। প্রথম পরীক্ষা, বিজেপির সভাপতি নির্বাচন। নতুন সভাপতি বাছাইয়ের সময় সঙ্ঘ চাইবে এমন একজনকে, যাঁর সঙ্গে সঙ্ঘের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ। যিনি ভবিষ্যতে অন্তত নরেন্দ্র মোদির অন্ধ অনুগামী হবেন না। দ্বিতীয় পরীক্ষা, পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোট। চলতি বছর শেষ হওয়ার আগেই হতে চলেছে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড ও জম্মু–কাশ্মীর বিধানসভার ভোট। পরের বছর ভোট দিল্লিতে। এসব রাজ্যের মধ্যে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিজেপি ক্ষমতায়। দুই রাজ্যেই লোকসভা ভোটে বিরোধীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। মহারাষ্ট্রে ৪৮ আসনের মধ্যে বিরোধীরা দখল করেছে ৩০টি, হরিয়ানায় ১০টির মধ্যে ৫টি। এই দুই রাজ্যে বিজেপি হারলে মোদির উপর চাপ আরও বাড়বে। বিরোধীরাও সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে।