পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
পূর্ব পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা
কলম্বাসের অভিযান, তাঁর আগের পরিস্থিতি এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে (যাকে ভুল করে ভারত ভেবেছিলেন তিনি) তাঁর কার্যকলাপ ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথাই শোনা যায়। সেই সঙ্গে আরও একটা প্রশ্ন সামনে চলে আসে। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের পূর্ব পরিচয় কী? তিনি কোন দেশের বাসিন্দা? এই প্রশ্নের বেশ কিছু সহজ উত্তর হল—তিনি ইতালির বাসিন্দা। বেশ কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, ইতালির লিগুরিয়া প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। নিজের চিঠি এবং নানা লেখায় সেই কথাই উল্লেখ করেছেন স্বয়ং কলম্বাস। বিশেষ করে ইতালির জেনোয়া নামক শহরের কথা। কিন্তু সত্যিটা কি তাই? এমন প্রশ্নও তুলেছেন বেশ কয়েকজন ঐতিহাসিক। তাঁদের মতে, কলম্বাসের জন্ম ইতালিতে নয়। পর্তুগালে। ওই ঐতিহাসিকদের যুক্তি, কলম্বাসের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল এক পর্তুগিজ মহিলার। নাম ফিলিপা মোনিজ পেরেস্তেলো। যার পরিবার সেই সময় ছিল যথেষ্ট সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী, সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানদের সাধারণ লোকের সঙ্গে বিয়ে হতো না। বিদেশি হলেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। তাহলে কীভাবে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মতো একজন বিদেশি ইতালীয়, অতি সাধারণ লোকের সঙ্গে ফিলিপার বিয়ে হল? বলা ভালো, কলম্বাসের অভিযানের আগেই ঘটেছিল এই ঘটনা। তাহলে কি কলম্বাস পর্তুগিজ ছিলেন? এবং তাঁর
আসল পূর্বপুরুষরা সেখানকার সম্ভ্রান্ত কেউ? এইরকমই অসংখ্য প্রশ্ন আজও ঘোরাফেরা করে।
অত্যাচারী ও বর্ণবিদ্বেষী
আমরা সবাই জানি, আতলান্তিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেছিলেন কলম্বাস। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, উত্তর ও মধ্য আমেরিকার উপকূলের আদিবাসী মানুষদেরই তিনি ভ্রান্তিবশত ‘ইন্ডিয়ান’ আখ্যা দিয়ে বসেন। ঐতিহাসিক লুইস বেলিজেট দাবি করেছেন, ‘কলম্বাস দাসত্ব ও নির্যাতন আমদানি করেছিলেন তাঁর আবিষ্কৃত ‘নতুন বিশ্বে’র সর্বত্র।’ তাঁর লেখায় কলম্বাসের একটি ডায়েরির অংশ তুলে ধরেন, যেখানে লেখা ছিল, ‘ওদের কাছে অস্ত্র তো নেই-ই। এমনকী সেটার ব্যবহারও জানে না
ওরা। আমি যখন ওদের দিকে তরোয়াল এগিয়ে দিলাম, ওরা ভুল করে সেটার ধারালো অংশে হাত দিয়ে ফেলায়
রক্তারক্তি কাণ্ড। ওরা লোহার ব্যবহার জানে না। এরা দারুণ দাস হতে পারবে। ৫০ জন মিলেই আমরা ওদের আয়ত্তে এনে ফেলতে পারব এবং ওদের দিয়ে যা খুশি করাতে পারব।’ ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর কলম্বাস এসে পৌঁছন সালভাদর দ্বীপে।
সেই দ্বীপটিতে পৌঁছে এক অজানা দেশ দেখার রোমাঞ্চের চাইতে কলম্বাসের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানকার সরল মানুষজন। এছাড়াও তাঁর দ্বিতীয় অভিযান ছিল আজকের হাইতিতে। কলম্বাস যার নাম দিয়েছিলেন হিস্প্যানিওলা। সেখানে উত্তর আমেরিকার আরাওয়াক জনজাতির হাজার হাজার মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছিলেন তিনি। একথা ঠিক যে কলম্বাস মোটেই দাসপ্রথার প্রবর্তন করেননি। তাঁরও বহু আগে থেকে সভ্যতার ধ্বজাধারীরা আবিষ্কার করে ফেলেছিল মানুষ হয়ে আরেক মানুষকে পশুর মতো খাটানোর কৌশল। বলা যায়, সেই প্রথারই নির্মম প্রয়োগ করেছিলেন কলম্বাস।
আমেরিকা আবিষ্কারের নেপথ্য কাহিনি
একটা সময় ছিল যখন ভারতের মশলার খ্যাতি ছিল বিশ্বজুড়ে। নানারকম সুগন্ধি মশলার ভাণ্ডার ছিল ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ও দ্বীপপুঞ্জগুলো। এগুলোকে ইউরোপীয়রা একত্রে ইস্ট ইন্ডিজ বলে অভিহিত করত। সেই সময় ইউরোপ থেকে সরাসরি ভারতে আসার কোনও জলপথ তাদের জানা ছিল না। ধীরে ধীরে ইউরোপীয়রা পুরনো গ্রিক ও রোমান গ্রন্থগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে তখনকার স্বর্ণখনি তথা ভারত সম্পর্কে আরও বিস্তৃতভাবে জানতে লাগল। আর এই স্বর্ণখনি ভারতের ধনসম্পদ ও মূল্যবান মশলাকে হস্তগত করার আকাঙ্ক্ষা তাদের মনে জেগে উঠল। স্বভাবতই তখনকার অন্যান্য ব্যবসায়ী ও নাবিকদের মতো ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মনেও এই একই আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল। তিনি চেয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিজে পৌঁছে সেখানকার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করতে। তিনি তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী, অর্থ সংগ্রহের জন্য গেলেন স্পেনের রানি ইসাবেলারকাছে। কলম্বাস তাঁকে আশা দিলেন পশ্চিমের নতুন পথ দিয়ে ভারত পৌঁছতে পারলে প্রচুর ধনসম্পদ পৌঁছে যাবে রানির কাছে। সেইমতো ১৪৯২ সালের আগস্ট মাসে ৩টি জাহাজ ও প্রায় ৯০ জন নাবিক নিয়ে শুরু হল তাদের ভারতে পৌঁছনোর নতুন পথের সন্ধানে সমুদ্রযাত্রা। এর প্রায় তিন মাস পর ১২ অক্টোবর ১৪৯২, কলম্বাস তাঁর দলবল নিয়ে অবতরণ করলেন একটি দ্বীপে। তিনি দ্বীপটির নাম দেন সান সালভাদর, যেটি আসলে আজকের বাহামা দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ। কলম্বাস ভাবলেন তিনি ভারতের কোথাও অবতরণ করেছেন। কিন্তু এই ভারতীয়দের গায়ের রং যেন আলাদা, লাল বর্ণের। তাই তিনি এদেরকে ডাকলেন ‘রেড ইন্ডিয়ান্স’ নামে। আমেরিকান অধিবাসীরা এভাবেই ‘রেড ইন্ডিয়ান’ নামটি পেল। কলম্বাস তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন—‘দ্বীপের অধিবাসীদের কোনও ধর্ম নেই বলে মনে হচ্ছে।’ কলম্বাস যখন তাঁর দলবল, সেখানকার বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী এবং কয়েকজন রেড ইন্ডিয়ানকে নিয়ে স্পেনে পৌঁছলেন, তখন রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলা তাঁদের আনন্দচিত্তে বরণ করলেন। এভাবেই ইউরোপের সঙ্গে পশ্চিমের আরও একটি মহাদেশ আমেরিকার যোগসূত্র স্থাপিত হল। ইস্ট ইন্ডিজ আবিষ্কার করতে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আবিষ্কার করে ফেললেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস।