পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
জীবনশিল্পী রবীন্দ্রনাথ। যা কবির চোখে দেখেছেন, অনুভব করেছেন, ব্যবহারিক জীবনে মানুষের মাঝে তার বিকাশ দেখতে চেয়েছেন বারবার। তাতেই তাঁর আনন্দ, তাতেই তৃপ্তি। তা না হলে বর্ষামঙ্গল, হলকর্ষণ সবেতেই বৃক্ষরোপণকে উৎসবে আয়োজনে ভরিয়ে তোলার প্রয়োজনও বোধহয় ছিল না। একই সঙ্গে বৃক্ষবন্দনা করেছেন, আবার তাতে উৎসবের প্রেরণাও জুগিয়েছেন। পরিবেশ শিক্ষার আদর্শ পাঠশালা গড়তে চেয়েছিলেন শ্রীনিকেতনকে। পরিবেশ চেতনার পাঠ দিতে কবিগুরু সুচারুভাবে মালা গেঁথেছিলেন শহুরে আধুনিক থেকে ‘গেঁয়ো’ মানুষদের নিয়ে।
নানা কথামালায় তিনি বলেছেন প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা। তিনি কত আগেই না বুঝেছিলেন, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা না করা গেলে, মাটি ও মানুষের যে চিরন্তন সম্পর্ক, সেটা আর টিকবে না। দীর্ঘ জীবনপ্রবাহে আর লেখনীতে তাই প্রকৃতির প্রতি মমত্ববোধ আর দায়বদ্ধতা প্রকাশ করেছেন। মানুষ যেমন হয়েছে তেমন নয়, মানুষ যেমন হতে পারত তেমন এক আদল রবীন্দ্রনাথ খুঁজেছেন প্রায় গোটা জীবন ধরে। মানুষের চারপাশটা যেমন আছে তেমন নয়, যেমন হলে হতে পারত মানুষের পূর্ণতার বিকাশ— সেই ছবি বুনতে চেয়েছেন তাঁর জীবনের অন্তিম দিন পর্যন্ত। প্রকৃতির উপর মানুষের লোভী আক্রমণ আর ধ্বংসযজ্ঞ রবীন্দ্রনাথকে বিচলিত করেছে গভীর বেদনায়। তিনি জানতেন মানুষের প্রকৃতির উপর এই অপরিসীম লোভ আর ক্ষুধা কখনও শেষ হবে না। তাই ‘প্রশ্ন’ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।’
গাছকে দেবতাজ্ঞানে পূজার্চনা ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ। বট-অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় বাঁধানো ঠাকুরের স্থান, উঠোনে তুলসীমঞ্চ, দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীতে বিল্ববৃক্ষের তলায় বোধন, সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নান, বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষ ইত্যাদি হাজারো উদাহরণের কথা আমরা জানি। স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকে জানা যায়, দার্জিলিঙের মহাকাল পাহাড়ের শৈবক্ষেত্রে ভুটিয়ারা গাছের ডালে বৌদ্ধধ্বজা ওড়ানোর মতো করে কাপড়ের টুকরো বেঁধে দিত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সখ্যের অবনতি ঘটে। জীবনযাত্রার জটিলতা যত বাড়ে, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের স্বচ্ছন্দ সম্পর্ক তত নষ্ট হয়। বিচ্ছেদ বেড়েই চলে। প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার ফলে ভূমিক্ষয়, ধস, বৃষ্টিপাতের অসাম্য, উষ্ণায়ন একে একে প্রকট হয়। অথচ, মাটিকে মরুগ্রাস থেকে রক্ষার জন্য, নীচের জলাধারকে অক্ষত রেখে, তার সরসতা বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুধাবন করেছিলেন বহু যুগ আগে। ‘গাছ’ কবির কাছে কখনও ‘গৃহহারা আনন্দের দল’, কখনও ‘মরুবিজয়ের কেতন’, আবার কখনও ‘মাটির বাঁশি’। মানবিক, আধ্যাত্মিক, বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও কর্মের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের পরিবেশবান্ধব নির্মাণ ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অব্যর্থ সত্যদৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যৎকে দেখেছিলেন। আমরা শুনিনি তাঁর পরামর্শ!
কবিগুরুর হাত ধরে বাংলার বৃক্ষরোপণ আন্দোলন পণ্ডিত নেহরুর মনে ধরেছিল। তাঁর পরামর্শে কৃষিমন্ত্রী কে এম মুন্সি ১৯৫০ সালে ১ জুলাই থেকে, বৃক্ষরোপণকে সর্বভারতীয় স্তরে সর্বত্র প্রয়োজনীয় হিসেবে ঘোষণা করেন। ছ’য়ের দশক পর্যন্ত প্রায় সকল ব্লক অফিসগুলিতে নৃত্য-গীত-আবৃত্তি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চারা লাগানো হতো। অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে, কোনও উচ্চপদস্থ আধিকারিক বৃক্ষরোপণ গাছ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলতেন। ব্লক থেকে প্রচুর গাছ বিতরণ করা হতো। সেই রকম গাছ আজও প্রতি বছরে লাগানো হয়। আবার তার পরিণতিও যে খুব দীর্ঘস্থায়ী হয় না, সেই করুণ সত্যও আমাদের অজানা নয়।
তাকিয়ে দেখ, আজ মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে বিশ্বজুড়েই পরিবেশ মানুষ এবং প্রাণীর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। যে জন্য গবেষকরা বেশি দায়ী করছেন উন্নত দেশগুলিকে, যারা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে যাচ্ছেতাইভাবে পরিবেশের উপর আধিপত্য দেখাচ্ছে। যার কারণে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। আর এর পিছনে মানুষের অরাজকতা, অসচেতনতা এবং লোভই সর্বাংশে দায়ী। সাম্প্রতিক গবেষণার এই গুরুত্ববহ বিষয়টি অর্থাৎ পরিবেশ ভাবনার বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় অনেক আগেই লক্ষ করা গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমন উপলব্ধি ছিল বলেই তিনি ‘অরণ্য দেবতা’ প্রবন্ধে এমন মন্তব্য করেছেন, ‘মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরণ্যসম্পদকে রক্ষা করা সর্বত্রই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ...বিধাতা পাঠিয়েছিলেন প্রাণকে, চারিদিকে তারই আয়োজন করে রেখেছিলেন– মানুষই নিজের লোভের দ্বারা মরণের উপকরণ জুগিয়েছে। বিধাতার অভিপ্রায়কে লঙ্ঘন করেই মানুষের সমাজে আজ এত অভিসম্পাত। লুব্ধ মানুষ অরণ্যকে ধ্বংস করে নিজেরই ক্ষতিকে ডেকে এনেছে; বায়ুকে নির্মল করবার ভার যে গাছপালার উপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিকে উর্বরতা দেয়, তাকেই সে নির্মূল করেছে। বিধাতার যা-কিছু কল্যাণের দান, আপনার কল্যাণ বিস্মৃত হয়ে মানুষ তাকেই নষ্ট করেছে।’ নগর জীবন নিয়ে আমরা প্রতিনিয়তই হা-পিত্যেশ করতে থাকি। যে উপলব্ধি রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।’ তাছাড়া তিনি প্রকৃতির সমন্বয় ও ঐক্যের পক্ষে ছিলেন বলেই শহরকে উদ্দেশ্য করে বলতে পেরেছিলেন, ‘...ইঁটের ’পরে ইঁট, মাঝে মানুষ-কীট–/ নাইকো ভালোবাসা, নাইকো খেলা।/ কোথায় আছ তুমি কোথায় মা গো,/ কেমনে ভুলে তুই আছিস হাঁগো।/ উঠিলে নব শশী, ছাদের ’পরে বসি/ আর কি রূপকথা বলিবি না গো!’
আগামী বুধবার বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এই পরিবেশ দিবস এখন অনেকাংশেই একটি বাৎসরিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালে স্টকহোম বিশ্ব সম্মেলনে পরিবেশ রক্ষার যে সঙ্কল্প নেওয়া হয়েছিল, তাকে এখনও সর্বত্রগামী করা যায়নি। আজও পৃথিবীর বায়ু, জলরাশি দূষণে আক্রান্ত হয়ে চলেছে। ‘আত্মঘাতিনী মাটি আপন বুকের সরসতা হারিয়ে রিক্তমূর্তি ধারণ’ করেছে। বিপন্ন পরিবেশে আক্রান্ত মানুষ, অরণ্যভূমি ও প্রাণীজগৎ। জনশক্তি সমবায়ের দ্বারা পরিবেশ পুনর্নির্মাণের দৃষ্টান্ত ভুবনডাঙায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের মানুষকে সচেতন করে ভূমি ও পরিবেশ সংরক্ষণের কমিটির মধ্যে দিয়ে প্রাণাত্মবোধের পরিচয়টিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘এর অজস্র দানে চারদিক স্বাস্থ্যে সৌন্দর্যে পূর্ণ হয়ে উঠুক।’
মানুষ আর প্রকৃতি যে এক অখণ্ড সত্তা— এই চেতনার উদ্বোধনই গড়ে তুলতে পারে মানবিক পরিবেশ সংস্কৃতি। এই প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের চর্চাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ভবিষ্যতের নিবিড় স্পর্শ অনুভব করে ১৯৪১ সালে জীবদ্দশায় শেষ ‘জন্মদিনে’ লিখেছিলেন, ‘আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি/ আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি...।’
এই ধ্বনি শোনা, অনুভব করা এবং তাতে সাড়া দেওয়ার সাধনাই আজ অন্তরময় পরিবেশ সাধনার আদর্শ। সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে রবীন্দ্র-পরিবেশ ভাবনার বিকল্প নেই।