সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বল হরিবোল— বুড়ির ঘর/ন্যাড়াপোড়া/চাঁচরপোড়া-র মাধ্যমে দোলের একদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় উৎসব। মূলত হোলিকা দহন থেকেই এই বিশেষ বহ্ন্যুৎসবের জন্ম। বসন্তের আগমনিবার্তা দিতে প্রকৃতি যেমন পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার রঙে রাঙা হয়, ঠিক তেমনই দোলের দিন কয়েক আগে থেকেই রংবেরঙের আবির, জল রং, বেলুন, বাহারি টুপির পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। আর তখন থেকেই চড়তে থাকে উৎসবের আমেজ। এটি হিন্দু বৈষ্ণব উৎসব হলেও দেশে ও বিদেশে ধর্ম নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের নারীপুরুষ এই রঙের উৎসবে শামিল হন। সকলে মিলেমিশেই মজাটা উপভোগ করেন। দোলযাত্রার ধমনিরপেক্ষতার দিক এটাই। বহ্ন্যুৎসব দিয়ে যে উৎসবের শুরু, তার শেষ হয় হোলির মাধ্যমে। দোলের পরদিন হোলি। মূলত উত্তর ভারতেই হোলি উৎসব পালিত হয়।
দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে। তাই একে বলা হয় দোলপূর্ণিমাও । চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম এই পূর্ণিমা তিথিতেই। তাই এটি গৌরপূর্ণিমা নামেও পরিচিত। মথুরা, বৃন্দাবনের মতো রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাই বাংলার রঙের উৎসবের মুখ্য আকর্ষণ। পশ্চিম বা মধ্য ভারতে এই উৎসবের কেন্দ্রে রয়েছে বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের কাহিনী। এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, ‘হোলি’ শব্দের উৎপত্তি ‘হোলিকা’ থেকে। হোলিকা ছিলেন কশ্যপবংশীয় রাজা হিরণ্যকশিপুর বোন। তিনি বর পেয়েছিলেন, অগ্নি তাঁকে বধ করতে পারবে না। ছেলে প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। বাবার উপরে বিষ্ণুকে স্থান দেওয়ায় ব্রহ্মার বরে দেব ও মানবজয়ী হিরণ্যকশিপু প্রচণ্ড রেগে যান। তাই, ছেলে প্রহ্লাদকে বোন হোলিকার কোলে বসিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেন। কিন্তু, ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদে প্রহ্লাদ বেঁচে যান, আর হোলিকা পুড়ে ছাই হয়ে যান। এই হোলিকা দহন থেকেই ‘ন্যাড়াপোড়া’ বা ‘চাঁচরপোড়া’-র সূত্রপাত। প্রসঙ্গত, প্রহ্লাদপুরী মন্দিরটি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মুলতানে অবস্থিত। আবার পৌরাণিক মতে, মহাদেবের পুত্রের হাতে তারকাসুরের মৃত্যু হওয়ার নিদান ছিল। কিন্তু দেবাদিদেব গভীর ধ্যানে মগ্ন। শিবের ধ্যান ভাঙাতে তাই পাঠানো হয় কামদেবকে। মহাদেবের মনে প্রেমের ভাব জাগ্রত করতে বাণ ছোঁড়েন কামদেব। তাতে ক্রুদ্ধ হন মহাদেব। তিনি তৃতীয় নয়ন উন্মোচন করতেই কামদেব ভস্ম হয়ে যান। পরে স্ত্রী রতির প্রার্থনা ও অনুরোধে তুষ্ট হয়ে প্রাণ ফিরে পান কামদেব। সেই থেকে তাঁর পুনর্জন্মের দিনই পালিত হয় এই উৎসব। এই ন্যাড়াপোড়া উৎসবের একটি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও রয়েছে। শীত ও বসন্তে রকমারি ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়ায়। চাঁচর পোড়ার সময় উদ্ভূত তাপমাত্রা এই সব জীবাণুকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে।
ভারতের নানা জায়গায় নানা আঙ্গিকে এই উৎসব ঘটা করে পালিত হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধের শান্তিনিকেতনে এই রঙের উৎসব বসন্তোৎসব নামে পরিচিত। ১৯২৫ সালে সেখানে এই উৎসবের সূচনা হয়। আগের দিন রাতে হয় বৈতালিক। আর দোলের দিন সকালে ‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল’ গানটির মাধ্যমে বসন্তোৎসবের সূচনা হয়। বিশ্বভারতীর প্রাঙ্গণে শুধু আবির দিয়েই রঙের উৎসবে মাতেন সকলে। সন্ধ্যায় গৌরপ্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথের কোনও একটি নৃত্যনাট্য পরিবেশন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা।
ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ব্রিটেন, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, মরিশাস, দক্ষিণ আফ্রিকা সহ বিশ্বের নানা প্রান্তে এই রঙের উৎসবে মাতেন প্রবাসীরা। তাঁদের সঙ্গে এই আনন্দে যোগ দেন অন্যান্য ধর্মের মানুষও। সাধারণত হোলি যে সপ্তাহে পরে, সেই সপ্তাহের শনি ও রবিবার প্রবাসীরা এই উৎসব পালন করেন। কোথাও কোথাও গোটা সপ্তাহ জুড়ে নানা রকম অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনীর আয়োজনও করা হয়। হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। চলে পারস্পরিক মিষ্টি বিতরণ। ব্যবস্থা থাকে দেদার ভুরিভোজেরও। ত্রিনিদাদ ও টোবাগোয় হোলি উৎসবের নাম ফাগুয়া। এটি পালিত হয় হোলির পর নিকটতম রবিবারে। ভারতের মতো (মূলত মহারাষ্ট্র ও গুজরাত) পাকিস্তানেও হোলির দিনে পিরামিড করে মাখনের হাঁড়ি ভাঙার বিশেষ চল রয়েছে।
দুর্গাপুজোর মতোই এই রঙের উৎসব প্রবাসীদের কাছে পরিণত হয় আরও একটি মিলন উৎসবে। এই নিয়েই কথা হচ্ছিল ফ্লোরিডার ট্যাম্পা বে-র ‘সৈকত’র বাসিন্দা অনসূয়া লাহিড়ীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, প্রতিবছরের মতো এবারেও তাঁরা প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন হোলি উৎসবের। এখানকার হোলি উৎসবের আয়োজন করেন মহিলারাই। ট্যাম্পার ট্রপিক্যাল আবহাওয়ার জন্য মার্চ মাসে হোলি উৎসব পালনে কোনও সমস্যা হয় না। আমেরিকার শীতপ্রধান শহরগুলিতে হোলি পালন করা বেশ অসুবিধার। বিশেষত, সেখানে জল রং একেবারেই ব্যবহার হয় না। শুধু আবির দিয়েই রং খেলা হয়। কিন্তু, তাঁদের ওখানে আবির, জল রং, পিচকারি, বেলুন দিয়ে দেশের মতোই পুরোদস্তুর হোলি খেলা হয়। ভারতে এই বছর দোল ২১ মার্চ, আর হোলি তার পরের দিন। অনসূয়া জানালেন, হোলির পরে প্রথম শনিবার তাঁরা এই উৎসব পালনের চেষ্টা করেন। তবে এবার ওখানে হোলি পালন করা হবে ৩০ মার্চ সকাল ১১টা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত, আপার ট্যাম্পা বে পার্কে।
বিদেশে প্রতি বছর বেশ সাড়ম্বরেই হোলি পালিত হয়। যেখানে যেখানে কৃষ্ণের মন্দির রয়েছে, সেখানে এই উৎসবে শামিল হন হাজার হাজার মানুষ। আবিরের রঙে রাঙা হয়ে ওঠে প্রবাসের আকাশ। চলে নাচ, গান, খাওয়া-দাওয়া। আমেরিকার মতো ব্রিটেনের নানা শহর জুড়েও এই উৎসবের আয়োজন হয়। সেখানে আগের দিন রাতে হয় ‘জ্বলনেওয়ালি হোলি’। আর পরের দিন পালিত হয় ‘রঙ্গোলি হোলি’। লন্ডন ছাড়াও ম্যাঞ্চেস্টার, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড— সর্বত্র রীতিমতো হইচই করে এই উৎসবে মাতেন হিন্দুদের পাশাপাশি ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষও। অধিকাংশ জায়গাতেই কোনও পেশাদার সংস্থার উপর এই উৎসবের আয়োজনের ভার থাকে। অনেক আগে থেকেই অনলাইনে এর জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। উৎসবের জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া থাকে। আর অনেক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাও থাকে নির্দিষ্ট। লাগে এন্ট্রি ফি। এলাকা ও সময় ভেদে মূল্য একেক রকম। যেমন, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে টিকিটের মূল্য কমবেশি ১৫ থেকে ৪০ পাউন্ড। পাঁচ থেকে ১২ বছরের ক্ষেত্রে এন্ট্রি ফি ৫ থেকে ২৫ পাউন্ড। পাঁচ বছরের নীচে ফ্রি। কোথাও চারজনের গ্রুপের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়। অংশগ্রহণকারীদের উপহার দেওয়া হয় এক প্যাকেট আবির। অধিকাংশ জায়গাতেই বলিউড থেকে উড়িয়ে আনা হয় ডিজে। তিনি হোলি সংক্রান্ত জনপ্রিয় হিন্দি (যেমন, বালাম পিচকারি, রং বরষে) গান বাজান। আর উপস্থিত সকলে সেই সুরের তালে তাল মেলান। অনেক জায়গাতেই থাকে ‘হোলি ককটেল’-এর বিশেষ ব্যবস্থা। সঙ্গে নানা পদের খাবার। আমেরিকাতে গোটা মার্চ মাস জুড়েই নিজেদের সুবিধামতো (আবহাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে) সময়ে প্রবাসীরা হোলি উৎসব পালন করেন। সেখানেও উৎসবের দিনে জনপ্রিয় হিন্দি গানের সুরে কোমর দোলান আট থেকে আশি। থাকে রঙের চৌবাচ্চা। সঙ্গীতের মূর্ছনায় একে অপরের দিকে আবির ছুঁড়ে দেন। সমীক্ষা বলছে, এই রঙের উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা প্রতিবছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আর এই তথ্যই বলে দেয়, প্রবাসে হোলির জনপ্রিয়তা কতটা!
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে