হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
—কী করব? বাবলু যে পথ আটকাল।
—কোন বাবলু?
—যে আগে আপনাদের বাজার সরকার ছিল।
—ও, যে টাকা পয়সা চুরি করে ভেগে গিয়েছিল?
—সেই বাবলু।
—কী বলল বাবলু?
—নানারকম কথা।
—যেমন?
—বলল, তোমার কাজ তো বুড়োকে স্নান করানো, চুল আঁচড়ানো, জামাকাপড় পরিয়ে দেওয়া। বাজার করা কবে থেকে ধরলে?
—কী জবাব দিলে?
—বললাম, তুমি যবে থেকে ছেড়ে দিলে।
—শুনে বাবলু কিছু বলল না?
—বলল বই কি! বলল, ভালোই। তা আমদানি কেমন হচ্ছে?
—আমদানি?
—হ্যাঁ, আমদানি। জবাবে বাবলুকে বললাম, পা ভাঙা বুড়ো মানুষটাকে ঠকিয়ে যাচ্ছিলে। সেই জন্যে তোমার চাকরিটা গেল। আমার ওসব ধর্মে সইবে না।
—বাবলু কী জবাব দিল?
—হাজারটা সত্যি-মিথ্যে মেশানো কথা। ও আপনার শুনে কাজ নাই।
—পরে দেখা হলে আর কথা বোলো না। পাশ কাটিয়ে যেও।
—হবে না।
—কেন হবে না?
—তিনমনি গতর। চেষ্টা করেছিলাম পাশ কাটানোর। যেদিক দিয়েই এগোই, পথ আটকে দাঁড়ায়।
—তাহলে উপায়?
—কাল থেকে উপোস।
—উপোস? কেন?
—বিশ কেজি ওজন কমে বত্রিশে ঠেকলে ঠিক ফাঁক গলে বেরিয়ে যাব, বাবলু আটকাতে পারবে না।
—জগবন্ধু! তুমি নাকি ব্যাঙ্কে গিয়েছিলে?
—গেছিলাম।
—ব্যাঙ্কে গিয়ে কী করলে?
—মাস-মাইনে জমা করে এলাম।
—তুমি... ব্যাঙ্কে টাকা জমা করলে? কেমন করে?
—দিদিমণির হাতে টাকাগুলো দিলাম। দিদিমণি একখানা ফরোম দিল। সই করলাম। অ্যাকাউন্ট নম্বর খানা মেয়ে লিখে দিয়েছে। দেখালাম। কাজ হয়ে গেল।
—টাকা ঠিকমতো জমা পড়ল কি না বুঝবে কী করে?
—ও মেয়ে ঠিক বুঝে নেয়।
—মেয়ে বোঝে? কেমন করে?
—ঠান্ডা ঘরে গিয়ে দেখে আসে।
—টাকা ঘর?
—ওই যে ঘরের মধ্যে টাকা মেশিন। বোতাম টিপলেই টাকা।
—এটিএম? বেড়ে বলেছ তো! আচ্ছা জগবন্ধু, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবে না তো?
—না না, মনে করবার কী আছে? গরিব মানুষের অত মনে করলে চলে না।
—যে ক’টা টাকা পাও, মানে বেশি কিছু তো তোমায় দিতে পারি না, ওতে তোমার চলে?
—মাথা তুলুন, জানলার দিকে বাড়ায়ে দ্যান, ...আর একটু... হ্যাঁ, ...কী দেখছেন বাইরে?
—রাস্তা।
—রাস্তায়?
—লোক। গাড়ি।
—কী গাড়ি?
—বাস, লরি, অটো, প্রাইভেট কার, ঠ্যালা।
—চলে?
—বুঝলাম না।
—একখানাই রাস্তা। সেখানে মোটর গাড়িও চলে, ঠ্যালাগাড়িও চলে। চলে, যে যার নিজের মতন।
—বোঝা গেল। কিন্তু না চললে কী করো?
—শ্বশুরবাড়ি পাঠায়ে দিই।
—তোমার শ্বশুরবাড়ি?
—আমার জিনিস... অন্যের শ্বশুরবাড়ি নেবে কেন?
—তা বলছি না। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি... তারাই বা যখন-তখন....
—যখন-তখন তো নয়। দায়ে-বেদায়ে। সেই জন্যই তো শ্বশুরবাড়ি।
—এটা অবশ্য খারাপ বলোনি।
—এই ভুলটাই নব্বইভাগ মানুষ করে। বিয়ে করার সময় যায় মেয়ে পছন্দ করতে।
—মেয়ে পছন্দ করবে না?
—না, করবে না। দেখবে শ্বশুরের ঘর, জমি-জিরেত, উঠোনে ক’খানা মড়াই। ঘর পাকা না কাঁচা। ছাদ দিয়ে জল পড়ে কি পড়ে না!
—তুমিও তাই করেছিলে?
—করেছিলাম বলেই তো বেঁচে-বর্তে আছি। তবে, একখানা জব্বর ভুল করে ফেলেছিলাম।
—ভুল?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, দু’খানা শালী। আশ মিটিয়ে দেখেছিলাম। শালাবাবুকে দেখা হয় নাই।
—দেখলে কী করতে?
—সে কথা আর একদিন হবে।
—ওদিকে চেঁচামেচি হচ্ছিল কেন জগবন্ধু?
—চেঁচামেচি তো নয়, আলাপ-আলোচনা।
—কী নিয়ে আলোচনা?
—দুধ বিষয়ে আলাচনা।
—কী হল দুধে?
—ঠিক দুধ নয়, দুধে দেশলাইয়ের কাঠি।
—বাবা! এতো সুপার স্পেশালাইজেশন। কী বেরুল আলোচনায়?
—ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, দুধে দেশলাই কাঠি এল কেমন করে?
—কী জবাব দিলে?
—বললাম, বিড়ি খেয়ে ছুড়ে ফেলেছে, কাঠিটা উড়ে পড়েছে দুধে।
—গোরু বিড়ি খায়?
—গোরু কেন খেতে যাবে? কলের দুধ যারা বানায়, তারা খায়।
—কলের দুধ? দুধ কত প্রকার?
—অনেক প্রকার। গোরুকে দুইয়ে সঙ্গে সঙ্গে জ্বাল দিয়ে যে দুধ মেলে তা এক প্রকার। তাতে জল মিশিয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয় গোয়ালা। তা আর এক প্রকার। আর আপনারা খান প্যাকেটের দুধ। দুধের গুঁড়োয় জল মিশিয়ে প্যাকেটে ভরে যা দোকানে বিক্রি হয়।
—তা দুগ্ধ-বিষয়ে এত জটিল জ্ঞান হজম করে ম্যাডাম কী জবাব দিলেন?
—কোনও জবাব দিলেন না।
—বলো কী? কোনও কথাই বললেন না?
—কথা বললেন না। তবে চুপ করেও রইলেন না।
—তাহলে?
—গজগজ গজগজ।
—তখন তুমি কী করলে?
—কী আর করব? কথা বললে তার উত্তর হয়। বকাঝকা করলেও তার একটা মানে হয়। গজগজের কোনও জবাব হয় না।
—বাদ দাও। ও এমনিই চুকে যাবে।
—যাবে না। বকাঝকা হম্বিতম্বি সঙ্গে সঙ্গে চুকে যায়। গজগজ সুতোর গুলির মতো। খুলতেই থাকে।
—ঠিক আছে। অন্য কথা বলো। তোমার বাড়িতে গোরু আছে?
—ছিল। এখন নাই।
—সে কী? গেল কোথায়?
—বেচে দিইছি।
—বেচে দিয়েছ? কেন?
—পেলে-পুষে বড় করেছি। চোখের সামনে মরে যাবে? তার চেয়ে বেচে দেওয়াই ভালো।
—মরে যাবে কোন দুঃখে? অসুখ করেছিল?
—অসুখে নয়। না খেতে পেয়ে মরত।
—মানুষ না খেতে পেয়ে মরে শুনেছি। গোরুও মরে?
—গোরু ঘাস খেয়ে বাঁচে। গ্রামে আর ঘাস নাই।
—কী বলছ আবোল-তাবোল? গ্রাম মানেই তো ধানখেত আর মাঠ। মাঠ-ভর্তি ঘাস।
—আপনার গ্রাম আপনি নিয়ে থাকেন। এখন গ্রামে ধানও ফলে না, আর মাঠে ঘাসও দেখতে পাওয়া যায় না।
—তাহলে কী পাওয়া যায়?
—মাছ।
—মাছ? মাঠে ঘাসের বদলে মাছ?
—মাঠ কোথায় দেখলেন? মাঠ-খেত সব সমান করে এখন ভেড়ির পর ভেড়ি। সেখানে মাছ-চাষ। চাষিবাসী সবাই ধান চাষ ছেড়ে মাছ চাষে নেমে পড়েছে। মাছেই লাভ।
—বলছ কী? গ্রাম.... সেখানে মাঠ নেই? মাঠে ঘাস নেই? খেতে ধান ফলে না?
—তাও চেষ্টা করেছিলাম।
—কী চেষ্টা করেছিলে?
—গোরু দুটোকে মাছ খাওয়ানো রপ্ত করতে।
—ইয়ার্কি হচ্ছে? গোরু মাছ খায়?
—খিদের চোটে মানুষ মানুষের মাংসও খায়। কিন্তু পারলাম না। নিরেট মাথা। সাধে কি আর বলে গোরু? ঘাস ছাড়া কিছু মুখে তুলল না। ...বাধ্য হয়ে বেচে দিলাম।
—কিনল কারা?
—ওই যারা গোরু পাচার করে।
—গোরু পাচার?
—নোট আর গোরু। বর্ডারে দুটোই তো ব্যবসা।
—তা তুমিও কিছু একটায় হাত লাগাতে পারতে?
—হতো না।
—কেন জগবন্ধু?
—শুনলেন না? অত চেষ্টাতেও গোরুকে মাছ খাওয়ানো গেল না।
—আচ্ছা জগবন্ধু, গ্রামে আকাশ আছে?
—কেন থাকবে না? নীল আকাশ।
—নীল আকাশ কেন বললে? আকাশ তো নীলই হয়।
—সবসময় হয় না। আপনাদের আকাশ নীল?
—তা অবশ্য বটে। কলকাতার আকাশ ঘষা কাচের মতো। কেউ যেন ধুলো লেপে দিয়েছে। তোমাদের আকাশে সূর্য ওঠে?
—ও বাবা! সে জব্বর সূর্য। নীচে দু’ দণ্ড দাঁড়ানো যায় না। বড্ড তাপ। এখানকার মতো মিয়ানো সূর্য নয়।
—আর চাঁদ?
—মেঘ না থাকলে চাঁদ ওঠে। ছমছমে জোছনায় ছেয়ে যায় মাঠ-ঘাট। তাকিয়ে থাকলে ভেতরটা শান্ত হয়।
—গ্রামের মানুষ দেখে? সূর্য, চন্দ্র?
—দেখে। তবে আকাশে নয়।
—আকাশে নয়? তবে কোথায়?
—যন্ত্রে।
—যন্ত্রে? কী যন্ত্র?
—ওই যে হাতে হাতে ঘোরে ফেরে যন্ত্র। যাতে কথা বলি, তাতেই দেখা যায়। সূর্য-চন্দ্র-নদী-পাহাড়।
—ও, ফোন? সেলফোনের কথা বলছ?
—সেখানেই মানুষ কাছের জনকেও দেখে নেয়। বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে। পাশে গিয়ে বসার দরকার করে না। পিঠে হাত রেখে শুধোতে হয় না। কাঁধে মাথাখানা রাখতে হয় না।
—কী করবে জগবন্ধু? যে সময়ের যা রীতি।
—তবে, একটা খরচা কিন্তু কমে গিয়েছে। আগে হাটে-মেলায় আয়না বিক্কিরি হতো। নকশাদার হাতল, কোনওটা গোল, কোনওটা বা ডিমের মতো। আজকাল আয়নার দোকান খাঁ খাঁ করে। খদ্দের নাই।
—কেন জগবন্ধু?
—লোকে আর আয়নায় নিজেকে দেখে না।
—তাহলে কোথায় দেখে?
—ওই যে হাতের যন্ত্র। সেখানেই নিজের ছবি। ছবির পর ছবি। সেই ছবিই দেখে। সেলপি।
—সেলফি?
—ওই হল। ...নিজেকে দেখতে দেখতে আর সব ভুলে যায়। সূর্য-চন্দ্র-আকাশ। পাশের মানুষ। কাছের মানুষ।
—গ্রামে যেতে ইচ্ছে করে না?
—করে।
—মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করে?
—করে।
—মেয়ের মাকে?
—তাও করে।
—তাহলে যাও না কেন জগবন্ধু?
—সে অনেক কথা।
—বলো, শুনি সেসব কথা।
—গ্রামে যাই, কিন্তু চেনা মানুষগুলোকে আর দেখতে পাই না।
—সে কী? তারা গেল কোথায়?
—আছে। আশপাশেই আছে। কিন্তু অচেনা লাগে।
—অচেনা? কেন জগবন্ধু?
—মেয়ে, মেয়ের মা দু’জনকেই দু’খানা যন্ত্র এনে দিয়েছে মেয়ের মামা। সে জাহাজে কাজ করে, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। বাহারি জিনিস যা পায় নিয়ে আসে। দু’ হাতে বিলোয়। ঝকমকে জিনিস তো! চোখে ধাঁধা লেগে যায়। তখন কাছের মানুষকে চিনতেও ভুল হয়ে যায়।
—তাদের খাওয়া-পড়ার সংস্থান?
—আমিই করি। ভাত-কাপড়, মেয়ের লেখাপড়া। মন ওঠাতে পারলাম কই?
—তাও যাবে। চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল।
—যাই তো। ছুটে ছুটে যাই। মেয়েকে দেখলেও ভেতরটা শান্ত হয়। কিন্তু দু’দিনের জায়গায় তিনদিন থাকলেই তাদের যে অস্থির অস্থির লাগে সেটা বুঝতে পারি। আসলে বুঝি ভাঙা কাচ জোড়ে না। তাই যাবার ইচ্ছেটাই মরে মরে যায়।
—কেন এমন হয় জগবন্ধু?
—ওই যে যন্ত্র। যন্ত্রে সেলপি।
—এখানেও সেলফি?
—যন্ত্রে জায়গাটা ছোট তো! পর্দায় বেশি আঁটে না। নিজে। বড়জোর পাশে একজন। মেয়ের মামা। বউয়ের ভাই। সেখানে জগবন্ধু ঢোকে কী করে?
—তখন কী করো? ফিরে আসো গ্রাম থেকে?
—ফিরি। তার আগে ভিটেতে দু’দণ্ড বসি। গোরু দুটো ছিল, খোঁটা দু’খানা পড়ে রয়েছে, সেখানে হাত বোলাই। দাওয়ায় বসে মেয়েকে গান গেয়ে ঘুম পাড়াত মেয়ের মা। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। তারপর পুকুরধারে গিয়ে বসি, গাছের নীচে, গুঁড়িতে হেলান দিয়ে।
—কী গাছ জগবন্ধু?
—তালগাছ।
—সে তো মস্ত গাছ!
—মনে পড়ে, ভাদ্দরমাসে তাল পাকত, পড়ত ধুপধাপ শব্দ করে, মেয়ে ছুটত তাল কুড়োতে। সেই তাল এনে তালের বড়া, তালক্ষীর।
—তালগাছে আর তাল ফলে না?
—ফলে নিশ্চয়ই। পড়েও। কেউ কুড়োয় না। কাকে ঠুকরে খায়।
—গ্রামের লোক আর তাল খায় না? কী খায় তাহলে?
—শহরে যায়। পয়সা দিয়ে বিষ কিনে তারিয়ে তারিয়ে খায়।
—বিষ?
—ওই যে কেঁচোর মতো, প্যাঁচানো প্যাঁচানো। খেলেই পেট ব্যথায় কাত।
—বুঝেছি, নুডলস। তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।
—তালগাছের গায়ে গা লাগিয়ে বসে থাকতে থাকতে গাছটাকে খুব চেনা লাগে। খুব আপন।
—কেন জগবন্ধু?
—গাছটাও তো একসময় ছোট ছিল। তারপর বাড়তে শুরু করল। মাথা উঁচু করল। উঠতে উঠতে সবাইকে ছাড়িয়ে আকাশে পৌঁছে গেল।
—তারপর?
—সঙ্গীসাথীরা তালগাছকে ছেড়ে চলে গেল। বুক ভর্তি ফল নিয়ে গাছ অপেক্ষা করে, পাকা তালের গন্ধে চারপাশ ‘ম-ম’ করে। কেউ ছুঁয়েও দেখে না।
—কষ্ট হয় জগবন্ধু? চোখে জল আসে?
—কী জানি? তালগাছ কি কাঁদে?