হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
সহজ ঘরের কোণে যজ্ঞের কালিমাখা, সিঁদুর মাখানো করোটির দিকে তাকিয়ে থম মেরে বসে আছে। এই পিশাচ! তার গায়ের ভেতর শিরশির করছে। মেঝের ঠান্ডা শতরঞ্চি ভেদ করে তার হাড়ের ভেতর ঢুকে পড়েছে, কাঁপন তুলছে। ক্রমশ যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে ঘরের দেওয়ালগুলো। দম নিতে এখন অনেক বেশি হাওয়ার প্রয়োজন। তার বুকের ভেতর এখন অনেক কথা— তাহলে ক্যাপ্টেন কেন পিশাচ সেজে ঘোরেন? বারবার কেন নিজেকে পিশাচ সাজান? বঁড়শি তো এতদিন বলছিল, সে ক্যাপ্টেনের ছোট বউ? তাদের উনিশ মাস বিয়ের হিসেব দেখিয়েছিল? এখন বঁড়শিই তাকে বলছে ক্যাপ্টেন নয়, তার বিয়ে হয়েছে ওই করোটির সঙ্গে!
সহজের মাথার ভেতর দপদপ করছে। বঁড়শির কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে ওই করোটির যে মালিক সে ১০৮টি মড়া পোড়ানো এক শ্মশান ডোম। তার আবার অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। কীভাবে মরেছিল সে? তার মৃত্যু যে অপঘাতে হয়েছিল, এ কথা ক্যাপ্টেন জানলেন কী করে? তারই করোটিকে জাগিয়েছেন ক্যাপ্টেন!
ঘরের ভেতর অদ্ভুত নীরবতা! বঁড়শির খিলখিল হাসি থেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগে। বঁড়শি এখন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে সহজের দিকে। ও কোনও মজা করছে না তো? ঠিক বলছে?
একজন মৃত মানুষের মাথার খুলির সঙ্গে একটা হেঁটে চলে বেড়ানো, শ্বাস নেওয়া জীবন্ত মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়! উনি ক্যাপ্টেন হোক বা সাধু তিনি ফাঁদ পেতেছেন পিশাচকে বিয়ে দিয়ে সংসারে বেঁধে রাখতে? আর তাঁর টোপ এই মেয়ে? বঁড়শি!
সহজের সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বার বার তার মনে হচ্ছে সে এক আলো-আঁধারির আজব দুনিয়ায় ঢুকে পড়েছে। যেখানে তার কিছুই করার ক্ষমতা নেই। এখানকার খেলা ভিন্ন। এই খেলাতেই কি ফেঁসে আছে পরমেশ্বরদা?
পরমেশ্বরদা কি জানে তার ক্যাপ্টেনের এই আজব বিবাহবৃত্তান্ত!
যে করোটির আছে কেবল কতকগুলো গহ্বর, তার কি না আলজিব! সেই আলজিবে টোপ হয়ে বিঁধে আছে বঁড়শি!
থম মারা সহজের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল বঁড়শি। বলল, ‘কী গো আকাশপাতাল কী ভাবছ? আমার কথা কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?’
সহজ হাসল। বলল, ‘ভাবছি তোমার বরের কথা!’
‘ও তুমি তোমার ব্যাটাছেলে-সতীনের কথা ভাবছ? হিংসে হচ্ছে নাকি? ও কিন্তু আমার সঙ্গে ফুলশয্যা করেনি, তবে ওর সঙ্গে কিন্তু আমার কালরাত্রি হয়েছে। সেদিন আমি এই ঘরে আসিনি। ওর মুখদর্শন করিনি!’ বঁড়শি গলগল করে আগল খুলে কথা বলে।
‘কীভাবে বিয়ে হল তোমার— একটা মড়ার মাথার খুলির সঙ্গে?’
‘অমন হয়, মড়ার মাথার খুলি বলেই তোমার আপত্তি নাকি? কেন আগে কোনওদিন শোনোনি গাছের সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে দিতে? এটাও তেমন। গাছ না হয়ে, মড়ার মাথার খুলি!’
বঁড়শি নিজের শরীর ঝাড়া দেয়, ‘সেজন্যেই তো আমার জ্বালা! গাছ হলে নয় একটু ভাবতাম, সহ্য করে নিতাম, সে আমার দিকে তাকালে ভালো লাগত, গা জ্বলত না। ইচ্ছে হলে তাকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম, মনের দুঃখ হলে তার তলায় বসে চোখের জলও ফেলতে পারতাম। সেও ভালোবেসে আমার গায়ে তার গন্ধ ছড়িয়ে দিত। টুপ টুপ করে পাতা খসিয়ে দিত। ওপর থেকে হাওয়া ধরে আমাকে উড়াত, বৃষ্টির ফোঁটা দিয়ে আমাকে সাজাত। শীতে তার পাতা ঝরলে আমার কষ্ট হতো, বসন্তে তার নতুন পাতায় আমাকে আহ্লাদ দিত। ডালে পাতায় ফুলে ফলে গাছ তো মানুষের মতো! কিন্তু ওই মড়ার খুলি— ওর সবটা জুড়ে শুধু গর্ত। সেই গর্তের ভেতর জমাট অন্ধকার। ওই গর্তের দিকে একদৃষ্টিতে তাকাও, তোমার ঘোর লাগবে, শীত করবে, সাড় চলে যাবে। অসাড় হয়ে পড়ে থাকবে ওর দিকে তাকিয়ে, নড়তে চড়তে পারবে না। তাকিও না ওর দিকে। ও দেখুক। ওর চোখে যতদিনে না আমি আগুন ঢালি, ততদিন দেখুক।’
সহজ শান্ত গলায় বলে, ‘ভাবছি, কেমন তোমার বর? হাত নেই, পা নেই, মাথার নীচে শরীর নেই—!’
সহজের কথার রেশ টেনে বঁড়শি বলল, ‘কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু নেই, আছে শুধু দু চোখের গর্ত! ওই গর্তের চোখ দিয়ে সারাদিন আমাকে শুধু গিলছে। আমি ওর চোখের গর্তে একদিন কর্পূর জ্বেলে দেব।’
সহজ চুপ করে বসে আছে। তার শরীর ভারী হয়ে যেন পাষাণ! ও কি ওই মড়ার খুলির দিকেই তাকিয়ে আছে?
বঁড়শি বলল, ‘তুমি ওকে জ্বালাতে পারবে?’
সহজ মানে বুঝল না বঁড়শির কথার। বঁড়শি কি ওই খুলির চোখে কর্পূর জ্বেলে দিতে বলছে?
বঁড়শি বলল, ‘পারবে কি না বলো— তুমি এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরো, ও তাকিয়ে তাকিয়ে জ্বলুক। দেখি ওই পিশাচ আমার কী করে?’
বঁড়শি এগিয়ে এল সহজের দিকে।
সহজ স্থির হয়েই বসে আছে। একটুও নড়ল না। বঁড়শি বলল, ‘তুমি কি ভয় পাচ্ছো?’
‘না।’
‘তবে আমাকে জড়িয়ে ধরছ না কেন? আমি তো তোমাকে ডাকছি, তুমি আমাকে টানছ না। তোমার ভয় নেই।’
‘আমি ওই সামান্য একটা মড়ার খুলিকে ভয় পাই না।’
‘তুমি ভয় পাবে না। একবার ওকে ভয় পেলে ও তোমাকে ভয় দেখিয়ে আটকে রাখবে। ও তোমাকে দখল করার চেষ্টা করবে। তোমার শরীর নিয়ে আমার সঙ্গে সংসার করতে চাইবে। আমি তোমাকে চাই। কিন্তু তোমার শরীরে ওকে চাই না।’
বঁড়শি বিড়বিড় করল। ‘তুমি আমার বর হয়ো না, তুমি আমার ভালোবাসার জন হয়েই থাকো।’
সহজ বলল, ‘আমি সহজ হয়েই থাকব।’
মাথা নিচু, চুপ করে বসে থাকল বঁড়শি। তারপর খুব আস্তে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি আশ্রমের মেয়ে হয়েই থাকতে চেয়েছিলাম। পারলাম কই—’
‘আশ্রম কন্যা!’ সহজ স্বগতোক্তি করল।
‘হ্যাঁ, আশ্রম কন্যা। আমি জন্ম থেকেই আশ্রমে মানুষ হয়েছি। আমার বাবা মস্ত বড় গুনিন ছিলেন। সর্পতান্ত্রিক।’
‘সাপের বিষ ঝাড়ানো ওঝা?’
‘না, আমার বাবা ছিলেন নাগপন্থী সাধু। উপাস্য দেবতা সর্প। সাপের সঙ্গে মানুষের জন্মরহস্যের চাবিকাঠি। আমার বাবার কাছে দলে দলে মেয়েরা আসত সন্তান কামনায়। বাবা তাঁর গুরুদেবের কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছিলেন। কিন্তু কী করে যেন আমার বাবা ভ্রষ্ট হয়ে গেলেন। মানুষ তাকে খারাপ কাজ করার জন্য নানা লোভ দেখাতে শুরু করল। লোভে পড়ে বাবা মানুষের ভালো করতে ভুলে গেলেন, মা অনেক বলত, কিন্তু বাবা প্রতিবারই বলতেন, আর করব না, এবারটা দেখি—গুরুর শেখানো বিদ্যা কাজে লাগে কি না? আর সেই বিদ্যা মানুষের খারাপই করত। বাবা বছরের বেশির ভাগ সময়ই বাড়ি থাকতেন না। আমি তখন ছোট, হঠাৎ খবর এল বাবা মারা গিয়েছেন। মরেছিলেন সাপের কামড়ে। এমন বিষ উঠেছিল, রাত পোহাতেই নাকি সারা শরীর পচে গিয়েছিল। অথচ মা বলত, বাবার গুরুদেব বাবাকে বলেছিলেন, কোনওদিন নাকি আমার বাবাকে সাপ দংশন করতে পারবে না। খুব সন্দেহ ছিল মায়ের। মা বলত, নির্ঘাত তোর বাবাকে সাপের বিষ খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমন আশঙ্কা মা শুনেছিল বাবার চেলাদের কাছ থেকে। বাবাকে আর দেখিনি। বছর ঘুরতে না ঘুরতে বাবাকে কেন সর্প দংশাল, কে বিষ দিল— তার চিন্তায় মা মরে গেল। তখন আমি খুব আতান্তরে পড়েছিলাম। আমার ন’বছর বয়স। তখন এই যোগীনবাবা আমাকে তার কালীকঙ্কালীতলার আশ্রমে নিয়ে আসেন। যোগীনবাবা আমাকে নিজের মেয়ের মতো করেই আশ্রমে এনেছিলেন। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। ক’বছর না যেতে যেতে সারা আশ্রমের সব দায়দায়িত্ব উঠল আমার কাঁধে। কত সাধু মহাজন আসতেন, হোম যজ্ঞ ক্রিয়াকলাপ হতো, আমি তার সব গুছিয়ে দিতাম। যোগীনবাবা মানুষের ভালো করার জন্যই সাধন ভজন করতেন। কিন্তু ওঁর আশ্রমে যাঁরা আসত, তারা সবাই ভালো ছিল না। অনেকেই মন্দ ছিল। তারা নানা ধান্দায় আসত। যোগীনবাবা ভালো মানুষ— সব ঠেকাতে পারত না। পারত না বলেই হয়তো মরে যেতে হল। কেউ বিষ দিয়েছিল যোগীনবাবাকেও। কে দিল? কেন দিল? কখন দিল? কেউ জানতে পারল না। সারাদিন আশ্রমে নানা কথা উড়ল। পুলিস এসে আশ্রমের দোরে অপেক্ষা করছে, ভক্তরা বললেই তারা আশ্রমে ঢুকবে। অবিশ্যি শেষ পর্যন্ত তা হল না, বাবার সমাধি হল আশ্রমের উঠোনে। তবে একদল ভক্ত যারা চেয়েছিল পুলিস এনে বাবার শরীর কাটাছেঁড়া করে দেখতে বিষ দেওয়া হয়েছিল কি না, তারা শাসাল, বলল, কোর্টে যাবে। সমাধি থেকে বাবার শরীর তুলে পরীক্ষা করাবে। খুব গোলমাল। সবাই ভয়ে ঠকঠক কাঁপছে। উনি বললেন, ওই মেয়ে ভাগ। না, ভাগলে পুলিস তোকে টেনে নিয়ে যাবে। তোর যোগীনবাবাকে কাটাছেঁড়া করবে, তোকেও কাটাছেঁড়া করবে। পুলিসে আমার খুব ভয়। সেই ভয়েই আমি চলে এলাম এঁর সঙ্গে। আগে চিনতাম, জানতাম, বড় মাপের সাধু মানুষ। তবে গৃহী। যোগীন বাবা বলত, ওকে আশ্রমে আটকে রাখতে হবে। তাহলে সবার একটু শিক্ষে হবে। ডিসিপ্লিন শিখবে। মিলিটারি ডিসিপ্লিন শেখাবে ক্যাপ্টেন সাধু। ভেবেছিলাম, ওর গৃহেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দেব। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম সব ভোঁ ভাঁ। এর আশ্রম কই, যা আছে তা ঠেক। এই আশ্রমে সাধন পূজন থেকে নেশা হয় বেশি। কত রকমের নেশা। কী নেই তাতে। কত তার উপকরণ! তার মাঝেই আর এক উপকরণ এই আমি। নেশা করতে বসলেই আমাকে নিয়ে ডাকাডাকি। সবার সামনে রসের কথা। রসকলি! বাইরের লোকরাও হ্যা হ্যা করে হাসবে। একদিন আমি, মুখ-ধরা হলাম। বললাম, তুমি সাধু না, নেশাড়ু। তোমার ঠেকে আমি আগুন লাগিয়ে চলে যাব। তোমাকে পুড়িয়ে মারব। উনি বললেন, বেশ! আমি নেশাড়ু, তোর বাপ কী? তোর বাপ তো বাঁজা মেয়ের গর্ভে সর্প-চালনা করা সাধু। তোর বাপ সাধু নাকি— একটা লম্পট! ওঁর কথায় আমি খুব কাঁদলাম। তুমি সর্প-চালনের মানে জানো? সর্প-চালনা মানে জন্মবীজ দান করা। জন্মবীজের ছবি দেখেছ কখনও—লক্ষ লক্ষ সর্প ছুটে যায় যেন! অথচ আমি মায়ের কাছে শুনেছি, বাবার গুরুদেব নাকি বলেছিলেন—আমার বাপের শরীরে নাকি নাগ-লক্ষণ ছিল। সাপের মতো লম্বা ছিল আমার বাবার জিব। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বাবার গা থাকত বরফের মতো শীতল। যখন ঘুমাত ঘুমিয়েই থাকত, যখন জাগত দিনরাত জেগে থাকত। গুরুদেবের কথামতো, কোনওদিন নাকি আমার বাপকে সাপ দংশন করতে পারবে না। অথচ সেই বাপকে সাপে কাটল! সেই শোকে আমার মা মরল। সেই বাপকে লেখাপড়া জানা ক্যাপ্টেন সাধু বলল—লম্পট!
আমার কান্না দেখে ক্যাপ্টেন সাধু বলল— যা তুই বেরো এখান থেকে। আমি বললাম, আমি কোথায় যাব? আমার যাবার জায়গা নাই। আমি এখানেই থাকব। তখন ক্যাপ্টেন বলল, তুই এখানে থাকলে মানুষ আমাকে লম্পট বলবে। আমার সব ভক্ত ভেগে যাবে। তোর টানে সবাই এখানে ভিড় করে। তোর সঙ্গে রসকলি করে। কী তোর পরিচয়? এখানে থাকলে আমাকে বিয়ে করতে হবে। আমি বললাম— করব। উনি বললেন, তবে আজ রাতেই বিয়ে হবে। আমি বললাম, আজ রাতে কী করে বিয়ে হবে? আলো জ্বলল না, সানাই বাজল না, গলা পর্যন্ত ভোজন হল না, বিয়ে হবে! উনি বললেন, সব হবে। পাত্র আছে, পাত্রী আছে, বিয়ে হবে আজ রাতেই। উনি ডেকে আনলেন গোবরা আর মাধাইকে। দুজনকে ভরপেট নেশা করিয়ে আমাদের বিয়ের ভোজ দিলেন। আর ওরা খিস্তি করে সারা পাড়া উদ্ধার করল। উনি বললেন, দেখ দেখ, গোবরা মাধাই তোর বিয়ের সানাই বাজাচ্ছে। আমি বললাম—আলোর রোশনাই কই? উনি বললেন, এই তো আলো! আজ অমাবস্যা। অমাবস্যায় চাঁদের আলো—আঁধার গলানো তরল কালো! নে উৎসব কর, আনন্দ কর, উনি জোর করে আমাকে নেশা করালেন। আমি শতরঞ্চির ওপর যখন গড়াগড়ি খাচ্ছি—তখন বললেন মন্ত্র পড়— বললেন, মালা বদল কর— বললেন, এই তোর সিঁথিতে সিঁদুর উঠল—বললেন, নে শুভদৃষ্টি কর। কোনও ক্রমে তাকিয়ে দেখলাম— বরের দু’চোখে ঘুটঘুটে অন্ধকার!’
আবার খিলখিল করে হেসে উঠল বঁড়শি। বলল, ‘আমি কালরাত্রি করেছি, ফুলশয্যা করিনি।’ হাসতে হাসতে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।
(চলবে)