হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
দরজা বন্ধ হতেই সহজ দেখল বাড়ির ভেতরে একরাশ অন্ধকার জমে। সে পিছন ফিরল। দরজা বন্ধ। সামনে বঁড়শি। বঁড়শি বলল, ‘এ কী অমন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে কেন! ভেতরে এসো।’
সহজ নির্লিপ্ত গলায় বলল, ‘উনি তো নেই, কী করব গিয়ে?’
‘কেন আমার সঙ্গে গল্প করবে!’
পিশাচ সাধুর বাড়িটা অদ্ভুত। বাড়ির সামনে একটা টানা রক। রকের এক পাশ দিয়ে তিনধাপ সিঁড়ি। সিঁড়ি পেরিয়ে দরজা। দরজা খুললে, দু’দিকে দুটো সরু প্যাসেজ। একটা সোজা, সেটা কোথায় গিয়েছে সহজ জানে না। কিন্তু ডানদিক ধরে এগলেই লম্বা হল ঘর। এটাই এ বাড়ির বৈঠকখানা থেকে সাধনক্ষেত্র।
সহজ বলল, ‘ওঁর সঙ্গে দরকার ছিল। উনি যখন নেই, আমি আর কী করব!’
বঁড়শি ফুঁসে উঠল। বলল, ‘উনি এসে যদি শোনেন, তুমি এসে ফিরে গেছ, আমাকে সাত কথা শোনাবেন। গালাগালিও দিতে পারেন। তখন অশান্তি সামলাবে কে?’
সহজ চুপ করে দাঁড়িয়ে। ‘বলবে আমি অপেক্ষা করিনি। উনি নেই শুনে ফিরে গেছি—।’
‘হ্যাঁ, সে কথা শুনেও বলবে— চা দিয়েছিলি, বসতে বলেছিলি, চা খেল না, বসলও না। তোকে কি ভয় পেল? তুই কেমন মেয়েমানুষ যে তোকে পুরুষেরা ভয় পায়! শোনো, তুমি চুপ করে ওই ঘরে গিয়ে বসো, চা করি খাও, ভালো মন্দ দুটো গল্প করি, তারপর তুমি যাও। এখন যদি উনি এসে পড়েন, খুব খুশি হবেন। বলবেন— কাজের কাজ করেছিস, আটকে রেখেছিস, গুড! গুড! আর যদি না আসেন, আমি বলতে পারব, ছেলেটাকে অনেকক্ষণ আটকে রেখেছিলাম, চা খেল, গল্প করল, এতে উনি চোখ কোঁচকাবেন, কেমন একটা সন্দেহ সন্দেহ মুখ করবেন। কিন্তু ট্যাঁ ফোঁ করবেন না। শুধু বলবেন, আবার কবে আসবে বলল—?’
সহজ তবু বঁড়শির দিকে তাকিয়ে আছে। বঁড়শি বলল, ‘কী ছেলে গো, ফাঁকা বাড়ি, একা একটা মেয়েমানুষ ভয় পাওয়ার কথা তার, এ ছেলে দেখি নিজে ভয়ে কাঁপে। শোনো, ভীতু পুরুষকে কোনও মেয়ে পছন্দ করে না। উনি এলে, আমি কিন্তু ওঁকে শোনাতে ছাড়ব না, —কেমন পুরুষ একটা দেখে দিলেন, সে যে ছাগলছানার মতো ভয়ে ঠক ঠক কাঁপে! এসো—।’ বঁড়শি এগিয়ে এসে সহজের হাত ধরে টেনে নিয়ে সোজা ডানদিকের সেই ঘরে নিয়ে হাজির করে। টক করে আলোর সুইচ টেপে, লালচে বাল্বের আলো সারা ঘরে থমথম কর। সে পর পর দুটো জানলা খুলে দেয়। বলে, ‘চেয়ারে বসবে, না শতরঞ্চিতে বসবে?’
ঘরে একধারে শতরঞ্চি পাতা। চেয়ারগুলো পরপর দেওয়ালের ধারে সাজানো। তার পাশে একটা বেঞ্চ। সহজ গিয়ে শতরঞ্চিতেই বসে। ‘এই তো ভালো ছেলে। বসো, বোতলে জল আছে, খাও। আমি চা করে আনি।’ কথাটা বলে বঁড়শি চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ থেকে ঘুরে দাঁড়াল, বলল, ‘আমি চলে গেলে তুমি আবার পালিয়ে যেও না যেন।’
সহজ হাসল, ‘আমি তো সেটাই ভাবছিলাম— তুমি ওদিকে গেলেই আমি কেটে পড়ব।’
‘তাহলে আমার বড্ড অপমান হবে। আর অপমান হলে আমি কাউকে ছাড়ি না। তোমাদের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে এমন অশান্তি করব, তুমি আর কোনওদিন এমুখো হতে পারবে না।’
‘তোমার কথা ক্যাপ্টেন শুনবে?’
‘ওর ঘাড় শুনবে। আমার অশান্তি তো জানো না, দিন রাত এক হতে দেব না, উঠতে বসতে দেব না, বুড়োলোকের বাচ্চাবউ, সে বউয়ের কথা শুনবে না তো কি তোমাদের মতো খড়খড়ে দাড়িওয়ালা ছেলেদের কথা শুনবে! ভালো মানুষ হয়ে বসো চুপ করে, আমি আসছি।’
বঁড়শি পায়ের শব্দ তুলে চলে গেল। একা সহজ শতরঞ্চিতে এসে বসল। চুপ করেই বসল, কারণ একা একা তো আর কথা বলা যায় না। জানলা দিয়ে ফিনফিনে আলো আসছে। এ-ঘরে যে বসবে সে শতরঞ্চিতেই বসবে। কেন না চেয়ারগুলো এমনভাবে দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো, যেন ওগুলো এ ঘরের থেকে আলাদা। পর পর রাখা চেয়ারগুলো ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
চেয়ার দেখতে দেখতে হঠাৎ সহজের নজর পড়ল ঘরের উত্তরদিকে মাটিতে কিছুটা জায়গায় বালি ফেলা। পোড়া কাঠ পড়ে আছে এক ধারে। সমিধের স্তূপ। ওখানে হোমযজ্ঞ হয়। আগেও জায়গাটা সহজ দেখেছে, জায়গাটা বেশ চোখ টানে। ইন্টারেস্টিং। এভাবে দুম করে না চলে এলেই ভালো হতো। ঠিক হল না। হঠাৎ ওর মনে হল ও কি একটু বেশিই জড়িয়ে যাচ্ছে! সহজ চোখ বন্ধ করল— জড়াচ্ছে নাকি জট খুলতে চাইছে? এটাই মনে হয় ঠিক, ও মন থেকে ক্যাপ্টেন বা পিশাচ সাধুকে মানতে পারছে না। ওর যুক্তি বুদ্ধি বলছে, এ হতে পারে না। এখনও পর্যন্ত যা ঘটছে তা সবই কাকতালীয়। কিন্তু ঘটনাগুলো পর পর ঘটে যাচ্ছে।
বিচিত্র ঘোষাল পিশাচ সাধুর কথায় প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন ওর খপ্পরে পড়ো না। ও পার্টির অনেক ক্ষতি করেছে। সহজের প্রশ্ন— একদম একটি বিপরীত মেরুর মানুষ কী করে এত বড় একটা পার্টির ক্ষতি করবে? তবে কি বিচিত্র ঘোষাল ভয় পান পিশাচ সাধুকে!
‘চোখ বন্ধ করে কী ভাবছ?’ ঘরে ঢুকেই গলা তুলে বলল বঁড়শি।
চোখ খুলে সহজ হাসল, ‘কিচ্ছু না। আচ্ছা এই চেয়ারগুলোয় কোনওদিন কেউ বসেছে?’
‘বসে, পুজোআচ্চার সময় যাদের কোমরের ব্যামো আছে, তারা এসে বসে। তবে সহজে কেউ বসতে চায় না। সবাই মেঝেতেই বসে, সে যত কষ্টই হোক।’
‘এবার থেকে আমি এসে চেয়ারে বসব।’
‘তবে আমি শতরঞ্চিতে বসব। তুমি চেয়ারে। চেয়ার থেকে ছুড়ে ছুড়ে প্রেমের কথা বলবে।’
বঁড়শির কথার পাল্টা কথা খুঁজে পেল না সহজ। এই ফাঁকা বাড়ি, একা ঘরে একটি মেয়ে প্রেমের কথা শুনতে চাইছে, অথচ সে কথা সহজ জানে না। বঁড়শি বলল, ‘তবে প্রথম প্রথম একটু দূরে থাকাই ভালো। এ ঘরের মতি মর্জি বুঝে চলতে হবে। তুমি আমি যা-ই বলি না কেন একজন কিন্তু দু চোখ জ্বেলে, দু’কানের ফুটো পেতে সব শুনছে।’
‘কে?’
‘কে আবার এই ঘর যার, তিনি?’
‘তিনি কোথায়? তুমি যে বললে তিনি বেরিয়েছেন?’
‘আহা আমি তাঁর কথা বলছি না। আমি এই ঘরের মালিকের কথা বলছি।’
‘এই ঘরের মালিকটা কে?’ সহজ একটু জোরেই কথাটা বলল।
‘কে আবার পিশাচ! এই ঘর তো তার।’
‘আমি তোমার কথা ঠিক বুঝলাম না।’
বঁড়শি হাসল, বলল, ‘উনি কি একা একা দু’টি নারী পুরুষকে ছেড়ে দিয়ে গেছেন। উনি জানেন এই বাড়ির ভেতর সব তাঁর ইশারায় চলে, আমরাও তার ইশারায় চলব, কিচ্ছুটি আমরা আমাদের জন্য করতে পারব না। যা করব তা সব ওঁর ইচ্ছে অনিচ্ছেতে।’
সহজ হাসল, ‘তাঁর ইচ্ছেতেই তুমি আমাকে আটকালে। কিন্তু আমি যখন এলাম, তখন তিনি তো বাড়ি ছিলেন না। তবে তাঁর ইচ্ছে হল কী করে?’
বঁড়শি চোখ ছোট করে সহজের দিকে তাকিয়ে থাকল। ‘তুমি কার কথা বলছ? বোকাছেলে!’
‘আমি পিশাচ সাধুর কথা বলছি।’
‘আমি পিশাচের কথা বলছি।’ বঁড়শি দৃঢ়তার সঙ্গে বলল। ‘তিনি এই জমির মালিক। তিনি এই বাড়ির পাহারাদার। তিনি ঘরের দখলদার। তিনিই সব। তোমাদের ওই পিশাচ সাধু তার কথায় নড়ে চড়ে।’
সহজের মনে হল বঁড়শি যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথাগুলো বলছে। খুব ধীরে, পেটের ভেতর থেকে কথাগুলো ডুবে ডুবে তুলে আনছে। সহজ বলল, ‘তিনি কোথায়?’
‘ওই তো উঠে গিয়ে দেখো।’ বঁড়শি হাত তুলে আঙুল উঁচিয়ে ঘরের একটা কোণ দেখাল। সেদিকে সহজ তাকাল, তেমন কিছুই দেখতে পেল না। ওদিকে অন্ধকার যেন বড্ড বেশি ঘাপটি মেরে জমাট হয়ে আছে।
বঁড়শি বলল, ‘দেখতে পেলে?’
‘না, ইট বালি, কিছু কাঠ, শুকনো বেলপাতা— আর তো কিছু চোখে পড়ছে না।’
‘ভালো করে দেখো, দুটি পোড়া বাহুর অস্থির আসনের ওপর পিশাচ বসে আছেন। ও-ই সব!’
শতরঞ্চি থেকে ঝাড়া মেরে উঠে দাঁড়াল সহজ। এত কাছে অথচ এটা তার চোখে পড়েনি। সে কয়েক পা এগিয়ে গেল। বালির বিছানায় দুটো লম্বা লম্বা হাড় গুণচিহ্নের মতো করে রাখা। তার ওপর একটা করোটি। সহজ পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। একদম সামনে। ওদিকে গিয়ে মাটির মেঝের সামনে উবু হয়ে বসল। হাড় ও করোটি দুটোই কালি পড়ে গেছে। হোমযজ্ঞের কালি। ধোঁয়া-কালির ওপর সিঁদুর মাখানোর জন্য ভয়ঙ্কর একটা রূপ নিয়েছে করোটিটা।
‘এসো, এখানে চলে এসো। অত সামনে গিয়ে বেশি দাঁড়িও না।’ বঁড়শি ডাকল। সহজ শতরঞ্চির ওপর ফিরে এল। ‘চা খাও।’ সহজ চায়ের কাপ হাতে নিল। বঁড়শি বলল, ‘ভয় করছে?’
‘ভয়? কেন?’ সহজ হেসে বলল।
‘তবে যে আসছিলে না, দরজার সামনে থেকে ফিরে যাচ্ছিলে? আমি তো ভাবলাম তুমি খুব ভয় পেয়েছ?’
সহজ স্থির চোখে তাকাল বঁড়শির দিকে। বঁড়শি করোটির কথা বলছে না, নিজের কথা বলছে। সহজ চুপ করে আছে। সত্যিই সে বঁড়শির আহ্বানে ভয় পেয়েছিল! ভয় বা অস্বস্তি যাই হোক তার কিছু একটা হয়েছিল। বঁড়শির মতো মেয়ে সহজ দেখেনি। এককথায় বলা যায়, বুনো!
বঁড়শি বলল, ‘কী গো উত্তর দিচ্ছ না! আমি বলব— তুমি ভয় পেয়েছিলে।’
সহজ বলল, ‘না, আমি ভয় পাইনি। তবে হ্যাঁ, উনি নেই আমি ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু—।’
‘আমি তোমাকে ছাগলছানার মতো টেনে নিয়ে এসেছি, তাই তো।’
ছাগলছানা! সহজ অবাক হয়ে বঁড়শির দিকে তাকাল।
‘তুমি কিন্তু হাড়িকাঠে গলা দিয়েছ বাছা। আর তোমার মুক্তি নেই!’ কথাটা বলেই বঁড়শি খিলখিল করে হেসে উঠল। ‘এবার তোমার ঘাড়ে আমি গঙ্গাজল দেব, জবা ফুল চড়াব!’ বঁড়শি হাসছে। ‘আর তোমার মুক্তি নেই!’ হঠাৎ বঁড়শি হাসি থামায়, ফিসফিস করে বলে, ‘তুমি নও গো, তুমি নও। আসলে হাড়িকাঠে গলা দিয়েছি আমি। আমার মুক্তি নেই!’
‘কেন, আমি যা জানি, তুমি তো স্বেচ্ছায় এখানে এসেছ, বিয়ে করেছ?’
‘স্বেচ্ছায়!’
‘হ্যাঁ, আমি তাই শুনেছি। উনি বলেছেন—।’
‘ওই আশ্রম ছেড়ে চলে না এসে আমার উপায় ছিল না। ওই আশ্রমে তখন খুনোখুনি! গোলমাল! থানা পুলিসও হবে। তাই চলে এসেছিলাম। কিন্তু এখানেও ঠাঁই পেলাম কই? আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।’ বঁড়শি বিড়বিড় করে, ‘আমার কপালটাই মন্দ, বাবা মরে গেলে আশ্রমে এলাম। আশ্রমেই গুরুবাবার কাছে ছিলাম মেয়ের মতো, সেই বাবাও মরে গেল। যাই কোথায় বলো—।’
‘এখানে তো খারাপ নেই।’ সহজ খুব শান্ত গলায় বলল।
‘ভালো নেই। সবসময় কারও এত চোখে চোখে থাকা যায়! একদিন ওই পিশাচটার মাথা ফাটিয়ে পালিয়ে যাব।’
সহজের মনে হল বঁড়শি যেন কথার কথা বলছে না, সত্যি সত্যি বলছে। সর্বনাশ! বঁড়শি বলল, ‘আমার ওই আশ্রম থেকে আসা উচিত হয়নি। ওই আশ্রমের মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেই হতো। আমাকে কী করত পুলিস, আমি শুধু শুধু ভয় পেলাম। ও এমন করে ভয় দেখাল, মনে হল পুলিস এসে আমার গলা কাটবে।’
সহজ খুব নিচু স্বরে বলল, ‘উনি নিয়ে এসে তোমাকে বিয়ে করেছেন, স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন। সেটা তুমিও স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েছ।’
‘কে? উনি কেন আমাকে বিয়ে করবেন? উনি আমাকে বিয়ে করলে আমার বলার কিছু ছিল না। আমি তো হ্যাঁ-ই বলেছিলাম। কিন্তু উনি আমাকে ওই পিশাচের সঙ্গে বিয়ে দিলেন—।’
‘পিশাচের সঙ্গে মানে?’ সহজ সোজা হয়ে বসল।
‘ওই যে, ওই পিশাচ! ওর সঙ্গে আমাকে বিয়ে দিয়েছেন।’ বঁড়শি আঙুল তুলে ঘরের কোণে যজ্ঞের কালিমাখা করোটিকে দেখাল। ‘আমি সেই থেকে ওই পিশাচের সঙ্গে ঘর করছি, দেখছো না কেমন দিনরাত ওর চোখে চোখে থাকি!’
‘তাহলে উনি তোমাকে বিয়ে করেননি, ওই করোটির সঙ্গে তোমার বিয়ে দিয়েছেন!’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওটাই পিশাচ! ১০৮ মড়া পোড়ানো অপঘাতে মরা এক শ্মশান ডোমের মাথা। উনি এটাকে জাগিয়েছেন। তাকেই তিনি বিয়ে দিয়ে এই সংসারে বেঁধে রেখেছেন। সেখানে আমি হলাম ওঁর টোপ! আমি বিঁধে আছি পিশাচের আলজিবে!’