পিশাচ সাধু
জয়ন্ত দে
বর্ণিনীর সঙ্গে বিচিত্রদার বাড়ি গেল সহজ। আর সেখানে গিয়েই গল্প প্রকাশের রহস্যের জট কাটল। আসলে পত্রিকা অফিসে গল্পটি পাঠিয়েছিলেন বিচিত্রদা। কিন্তু সহজের মুখে পিশাচ সাধুর নাম শুনে ভীষণ খেপে গেলেন তিনি। তারপর... লোকটা নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন পিশাচ, কিন্তু লোকটা আসলে কী? পাগল না শেয়ানা? সত্যিই কি লোকটার কোনও পাওয়ার আছে? সবাই বলে, একসময় ছিল। সেই পাওয়ারের খেল অনেকেই দেখেছে। অনেকেই তাঁর কথা মেনে চলে। যদি সত্যি কোনও শক্তি থাকে তাহলে সেই শক্তির ক্ষমতা দেখেছে সহজও। লোকটা তাকে নির্দিষ্ট সময় দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, তেত্রিশ দিনের মধ্যে প্রথম খেপ— সাত মাস পরে উড়ান দিবি। ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন, সাদা পাতায় কালো অক্ষর!
সবাই ভেবেছিল, সহজ চাকরি পাবে। কিন্তু কী হল? তার একটা গল্প ছাপা হল স্বদেশ পত্রিকায়। যে গল্পটি সহজ পাঠায়নি। পাঠিয়েছিলেন বিচিত্র ঘোষাল। এর আগে সহজ বেশ কয়েকবার স্বদেশে গল্প পাঠিয়েছিল। কোনওবারই ছাপা হয়নি। হতাশ হয়ে পড়েছিল। ভেবেছিল, আর পাঠাবে না। তারপরেই এই অদ্ভুতভাবে গল্পটি ছাপা হল। আর সেটা এই লোকটার বেধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে। সবার কাছে এটা তুচ্ছ ঘটনা। এমন কিছু নয়। কিন্তু সহজের কাছে এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর হয় না।
লোকটা সেদিন হাতের তালি মেরে বললেন, ‘এই তো মিলে গিয়েছে!’ কী আনন্দ লোকটার। বার বার বলছিলেন, জীবনে এই প্রথম তিনি ভালো কথা বললেন। আসলে হবে— ভালো কথা মেলালেন। এর আগে তিনি যা মিলিয়েছেন, সব খারাপ কথা।
লোকটার এই কথা মিলিয়ে দেওয়ার জন্য বিচিত্র ঘোষালের মতো মানুষ ভয় পাচ্ছেন। ভেবেই বসেছেন, পিশাচ সাধুর ছকে পড়ে যাবে সহজ।
সহজ ভাবছিল, কেন এমন ভাবছেন বিচিত্র ঘোষাল? কী সেই ছক? পিশাচ সাধুর ভবিষ্যদ্বাণী করা সাত মাসের আওতায় কি সে পড়ে গেল? সে কি সাত মাস ধরে অপেক্ষা করবে? অথচ লোকটা বলছেন, তিনি ভালো কথা বলতে পারেন না। সব খারাপ কথাই বলেন, শুধু তাকেই ভালো কথা বলেছেন। আর শেষ ভালো কথাটা বলেছেন বঁড়শির জন্য—। বঁড়শির নাকি নতুন করে প্রেম হবে। সেই প্রেমের প্রেমিক হবে— সহজ।
এ কথাটা বঁড়শির জন্য ভালো হলেও সহজের জন্য মোটেই নয়। সহজ শঙ্কর নয়। সে শঙ্করের মতো বঁড়শির জন্য ছিপ ফেলে বসে নেই।
সহজের মনে হল, আচ্ছা এই কথাটা ওঁর মনে এল কীভাবে? কেন বললেন, বঁড়শির জন্য ঘুরে ঘুরে তাঁর কাছে গিয়েছে সহজ। তবে কি সুজি বলেছে? সে তো সুজিকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য এমন একটা যুক্তি দিয়েছিল। বলেছিল, এই গল্পটা ছাপা হবে সে জানত। তেত্রিশ দিনের মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে তার গল্প ছাপার বিষয়টা পুরো ধাপ্পা আর কিছু নয়। সহজ আসলে সাধুকে একটু খেলাতে চায়—। তাহলে কি সুজির থেকে পরমেশ্বর, পরমেশ্বরের থেকে পিশাচের কানে কথাগুলো গিয়েছে?
এতখানি ভেবে সহজের মাথার ভেতর কেমন জট পাকিয়ে যায়।
সৃজনী আজও একটা জটিল অঙ্ক খুঁজে রেখেছে। অঙ্কটা সহজের সামনে দিয়ে ভালো মানুষের মতো চুপ বসে আছে। সহজ তাকিয়েছিল অঙ্কটার দিকে, আর সৃজনী তাকিয়েছিল সহজের দিকে, মন দিয়ে নখ খাচ্ছিল। এটা বুঝেই সহজ আবার অঙ্কের ভেতর ঢুকতে চাইল। তখনই সৃজনী বলল, ‘আপনার গল্পটা বেশ ভালো হয়েছে।’
সহজ মুখ না তুলে বলল, ‘ও।’
‘আমি পড়েছি।’
‘বাহ্!’
‘মাও পড়েছে। বাবা বলছিল, বাংলা ভাষায় এই ম্যাগাজিনটা নাকি নম্বর ওয়ান।’
সহজ কোনও উত্তর দিল না।
‘তাহলে সেই জ্যোতিষীর কথা মিলে গেল।’ সৃজনী খুব ধীর স্থিরভাবে বলল।
সহজের মনে হচ্ছে এই পথে অঙ্কটা হবে।
‘ওই জ্যোতিষী আপনাকে বলেছিল না, তেত্রিশ দিনের মধ্যে একটা সুখবর পাবেন। আপনি একবার আমাকে নিয়ে যাবেন—ওই জ্যোতিষীর কাছে?’
সহজ খাতা থেকে মুখ না তুলে বলল, ‘জ্যোতিষী যতই বলুক, না খাটলে জয়েন্টে চান্স পাবে না।’
‘আমি জয়েন্টের কথা জানতে চাইছি না।’
‘তবে’
‘আপনাকে বলে কী লাভ, আপনি কি আমার হাত দেখে বলতে পারবেন? ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন?’
সহজ বলল, ‘অঙ্কটা হয়ে গিয়েছে। এই যে দেখো—’ সহজ অঙ্কটা বোঝাতে শুরু করল। কিন্তু সৃজনী অন্যমনস্ক। সহজ ওর দিকে না তাকিয়ে গড়গড় করে অঙ্কটা বুঝিয়ে থামল।
সৃজনী বলল, ‘আমি আমার রিলেশন নিয়ে প্রশ্ন করতে চাই—দেখি উনি কী বলেন, কী হবে?’
সহজ খাতা থেকে মুখ তুলে বলল, ‘সে তো আমিই তোমাকে বলে দিতে পারি, কী হবে?’
‘তবে বলুন, কী হবে?’
‘ক্লাস টুয়েলভ-এর পরই ব্রেকআপ হয়ে যাবে?’
‘ব্রেকআপ? কেন?’
‘তোমার রেজাল্ট দেখেই সে পালাবে।’
‘না, সে পালাবে না। আমিই তাকে ছেড়ে দেব।’ সৃজনী চাপা গলায় বলল।
‘ওই একই হল।’
‘না, এক হল না। এত বোকা আর ইনসেনসিটিভ ছেলের সঙ্গে আর যাই হোক প্রেম হয় না।’
সহজ খাতার ওপর পেনটা ঠুকল। মানে, অনেক কথা হয়েছে, আবার অঙ্কে ফেরা যাক।
সৃজনী বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই টুয়েলভ-এর পরে আর আমাকে পড়াবেন না?’
‘এখনও অত দূর ভাবিনি। আগে টুয়েলভ কমপ্লিট হোক।’
‘আমি ভেবে রেখেছি—।’
‘কী?’
‘আমিই আপনার শেষ স্টুডেন্ট হয়ে থাকব।’
‘শেষ স্টুডেন্ট, কীভাবে?’ কপাল কুঁচকে সহজ জিজ্ঞাসা করল।
‘কারণ আপনি আর কাউকে পড়াতে পারবেন না। আমিই লাস্ট—।’
‘আমি পড়াব কি পড়াব না, সেটা আমার ওপর নির্ভর করবে।’
‘সে রাস্তা আমি বন্ধ করে দেব।’ সৃজনী চোখ সরু করে হাসল, ‘আপনার নামে মারাত্মক বদনাম করে দেব—আর কেউ আপনার ছায়া মাড়াবে না।’
‘মানে?’ চমকে উঠল সহজ। ‘কী বলবে, আমি অঙ্ক করাতে পারি না?’
‘না, অন্যরকম। যা কখনওই আপনি ভাবতে পারবেন না। সহজ মিত্রকে আমি আর কারও মিত্র হতে দেব না।’
‘কী বলছ কী তুমি?’ সহজ সোজা হয়ে বসল।
‘ঠিক বলছি, বলব আপনি অঙ্ক মেলানোর থেকে স্টুডেন্টের রূপ প্রশংসায় বেশি সময় দেন। আরও অনেক কিছু—’
‘কেন এসব ফালতু কথা বলবে? আর ইউ ম্যাড!’
‘ঠিক আছে বলব না। কিন্তু তার জন্যে আপনি আমাকে ওই জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে যাবেন। নিয়ে গেলে আর বলব না। আপনি আমাকে যা বলেছেন, যা করেছেন সব হজম করে নেব।’
‘আমি তোমাকে কিছুই বলিনি, বা কিছুই করিনি।’
‘কিছু বলেননি, আফশোস হচ্ছে? তাহলে বলুন। আমি তার জন্য কিছু বলব না।’
‘খুব অদ্ভুত মেয়ে তো তুমি!’
সৃজনী হাসল, ‘সবাই তাই বলে। আপনাকে যে অঙ্কটা দিয়েছিলাম, সেটা আমি কাল সলভ করেছি। আমার ঘণ্টাখানেক লেগেছে। আপনার মিনিট কুড়ি। সব অঙ্কই তাই, আমি আগে করি, তারপর আপনাকে দিই। আপনাকে আমি কোনওদিন এটা বলতাম না, আপনি অদ্ভুত মেয়ে বললেন, তাই বললাম।’
‘তাহলে এরপরের দিন থেকে আমার আর আসার প্রয়োজন নেই, তাই তো?’
‘সেটা তো বলিনি। কিন্তু আপনি না এলে এই অদ্ভুত মেয়েটা খুব খারাপ খারাপ কথা আপনার নামে বলবে, আপনি সহ্য করতে পারবেন তো? আপনি কিন্তু ভালো করে কথা বলতে পারেন না, হয় রেগে যান, নয় ইমোশনাল হয়ে পড়েন। আমি কিন্তু খুব গুছিয়ে কথা বলি। বন্ধুরা সবাই আমার প্রশংসা করে। আপনার নামে এমন গল্প বলব, দেখবেন নেক্সট তেত্রিশ দিনে আপনার নৌকোডুবি হয়ে যাচ্ছে।’
‘তেত্রিশ দিন, মানে?’
‘হ্যাঁ, তেত্রিশ দিন এটা আমার ভবিষ্যদ্বাণী। ওই জ্যোতিষী তো আপনাকে তেত্রিশ দিনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। এই সৃজনী জ্যোতিষীও আপনাকে তেত্রিশ দিনের ভবিষ্যদ্বাণী করছে, আমাকে ওই জ্যোতিষীর কাছে না নিয়ে গেলে নেক্সট তেত্রিশ দিনে আপনার নৌকোডুবি হবে।’
সৃজনী হাসে। হাসতে হাসতে বলে, ‘আর নিয়ে গেলে, এসব কিচ্ছু হবে না। আসবেন যাবেন, অঙ্ক করাবেন, বিন্দাস থাকবেন। আমি আপনাকে নিয়ে মাথা ঘামাব না, আপনারও কোনও টেনশন নেই। আপনি কবে আমাকে নিয়ে যাবেন— ঠিক করুন। আপনার বাইকেই আমি যাব।’
সহজ খুব শান্ত গলায় বলল, ‘তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেল করছ সৃজনী!’
‘একদম নয়। মনে করুন না, এটা একটা অঙ্ক। আপনাকে একটা নতুন অঙ্ক দিলাম, যেটা আগেই আমি সলভ করে রেখেছি, আর কিছু নয়।’
সহজ উঠে দাঁড়াল। ‘দেখি, আমি ভেবে দেখি।’
‘ইজি অঙ্ক স্যার, আপনি পারবেন। জাস্ট নিয়ে যাবেন। আমি ওঁকে কটা কথা জিজ্ঞাসা করব। ব্যস। আনসার শুনব, তারপর চলে আসব, এত টেনশনের কিছু নেই। আপনি ভাববেন না, আমি আপনার সঙ্গে প্রেম করতে চাইব। তবে যে কথাগুলো বলেছি সেগুলো কিন্তু সত্যি। এই দেখুন—।’ সৃজনী এগিয়ে এসে সহজকে জড়িয়ে ধরল। হতভম্ব সহজ। বলল, ‘এবার তো আপনি কিছুতেই আর অস্বীকার করতে পারবেন না। বলতে পারবেন না, কিছুই হয়নি, সব বানানো। ওই জ্যোতিষীর অনেক কথা আমি শুনেছি, তাই আমাকে একবার দেখতেই হবে। উনি আমাকে কী বলেন।’
‘তুমি একটা পাগল!’
সৃজনী হাসে। ‘আপনি কিন্তু স্যার, আমাকে একবারও না বলেননি। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেননি। তাই, আমাকে নিয়ে চলুন। বিন্দাস থাকুন।’
‘আমি নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু তোমাকে বলতে হবে কে তোমাকে এই ইনফরমেশনগুলো দিয়েছে?’
‘নাম জানতে চাইছেন? নো প্রবলেম। দেবলীনা। এবার নির্ঘাত জিজ্ঞাসা করবেন, কে দেবলীনা? আমি বলব, তার ডাক নাম রুমলি। আপনি কি চেনেন?’
‘না চিনি না। আমি এই নামও কোনওদিন শুনিনি।’
‘তাহলে, আমাকে জিজ্ঞাসা করুন, কোথায় থাকে? আমি বলব, এই এলাকার মেয়ে। আমার সঙ্গেই পড়ে। তবে সায়েন্স নয়, আর্টস। সেই মেয়েটা প্রচণ্ড কষ্টে আছে, টেনশনে আছে। তার কাছ থেকেই আমি সব জেনেছি।’
সহজ চুপ করে থাকে। কে দেবলীনা, যার ডাক নাম রুমলি।
সৃজনী হাসে, ‘আপনি এখান থেকে বেরিয়ে খোঁজা শুরু করবেন নিশ্চয়ই। এত কষ্ট করবেন না স্যার। আমি অঙ্ক করার সময়ও আপনাকে এত কষ্ট দিই না। আমি এমন কোনও অঙ্ক বাছাই করি না, যেটা আমি সলভ করতে পারব না। আমি সেই অঙ্কই বেছে দিই, যেটা আমি সলভ করতে পারব।’
‘আমার তো কোনও প্রয়োজন নেই, তাহলে তোমরা আমাকে রেখেছ কেন?’
‘নেট প্র্যাকটিস স্যার। আমি বল মারতে পারি, কিন্তু কেউ যদি ব্যাট হাতে আমাকে একটু দেখিয়ে দেন এই আর কী।’
‘খুব সহজ একটা প্রশ্ন করছি, মেয়েটি কে? একবারে আমি তাকে কীভাবে চিনব?’
‘সোজা উত্তর। দেবলীনা বা রুমলি হল নচিকেতা, মানে নচের মেয়ে।’
‘আচ্ছা। আমি তাকে কোনওদিন দেখিনি।’
‘সে আপনাকে চেনে।’
‘সে তোমাকে এসব কথা বলে বাঁদর নাচন করিয়েছে? ছিঃ!’
সৃজনী বলল, ‘সে আমাকে খুব কষ্টে এই কথাগুলো বলেছে স্যার। দেবলীনার বাবাকে ওই জ্যোতিষী নাকি বলে দিয়েছে— অপঘাতে মরবে। একথা শুনে ওর বাবা পুরো লাইফ স্টাইল পাল্টে ফেলেছে। রোজ নাকি এগিয়ে আসা অপঘাতে-মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। ওর বাবা ওকে বলেছে, ওই জ্যোতিষীর কথা মিথ্যে হবার নয়। তিনি নাকি মারাত্মক। যাকে যা বলেন তা-ই হয়। ভিখারিকে রাজা বানান। আগে থেকে বলে দেন কোন জায়গায় গুলি লাগবে। তখনই আপনার কথা বলল— লাস্ট নাকি আপনি। আপনাকে মিলিয়ে দিয়েছে। আমি সেই জ্যোতিষীর কাছে একবার যেতে চাই।’
সহজ মাথা নাড়ে, ‘উনি পাগল— মুখে যা আসে বলেন। লাগলে তুক, নইলে তাক।’
‘আমিও পাগল স্যার। ফুল ম্যাড! কবে আমাকে নিয়ে যাবেন, ঠিক করে ফেলুন।’
সহজ মাথা নাড়াল, ‘তোমার আগে আমাকে দু’জন বলেছে, তুমি তিন নম্বর।’
‘আমি এক নম্বর!’ সৃজনী শান্ত গলায় বলে। ‘তারা যত দরেরই হোক, আমার পিছনে থাকবে।’
(চলবে)
27th June, 2021