শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
চিঠিটা নিয়ে সিঁড়িতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল সহজ। চিঠিটা এসেছে ‘স্বদেশ’ পত্রিকা থেকে। ‘স্বদেশ’ পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হবে! তার গল্প! গল্পের নাম ‘দারোগাবাড়ির ছোটবউ’। এই গল্পটা সহজ লিখে পড়তে দিয়েছিল বনিকে আর পরমেশ্বরদাকে। ওদের কেউ সে গল্প পাঠিয়ে দিয়েছে পত্রিকা অফিসে। বনি নয়, পরমেশ্বরই হবে। কিন্তু তাকে জানানোর কোনও উপায় নেই। সে এলাকায় নেই। রোববার সকালে সে পরমেশ্বরের অফিসে গেল। দেখল গম্ভীর মুখে দু’হাত টেবিলে রেখে সুরজিৎ বসে। সামনে অ্যাসট্রে, চায়ের একটা খালি গ্লাস।
সুরজিৎ ওকে দেখে বেশ খুশি হল। বলল, ‘এসো তোমার কথাই ভাবছিলাম।’
সুজির কথা শুনে চমকে উঠল সহজ। বলল, ‘আমার কথা?’
‘হ্যাঁ, তোমার কথাই ভাবছিল— আজ দাদা নেই তুমি কি আর আসবে এদিকে? তোমার কেসটা কাল শুনলাম। পরম আমাকে কাল বিকেলে বেরনোর আগে খবর দিল। বলল, ক্যাপ্টেন ফ্লপ!’ কথাটা বলে সুরজিৎ আত্মপ্রসাদের হাসি হাসল। সহজ হ্যাঁ না কিছু বলতে পারল না। সে আলটাগরায় কথা নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে।
‘আরে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বসো বসো। চা খাবে?’ সুজি নিজেই উঠে দোতলার জানলা দিয়ে নীচে চায়ের অর্ডার দিল। বলল, ‘শোনো, ওই ক্যাপ্টেনের আর আগের পাওয়ার নেই। আগের পাওয়ার থাকলে আমি একটু ভাবতাম। সেদিন আমি জানতাম ও তোমাকে নিয়ে বড্ড বেশি হাঁক ডাক করছে, ওর কথা ফলবে না।’
চা এল। চায়ে চুমুক মেরে সুজি বলল, ‘আমি কিন্তু মালটাকে পাত্তা দিই না। এই তোমাদের গডফাদার পরমেশ্বরদাদা ওকে নিয়ে মাতামাতি করে। আর তোমার দাদার লেজুড় শঙ্কর, উনি তো ঠাকুরের সিংহাসনে ক্যাপ্টেনের মূর্তি স্থাপন করবে। না করে উপায় নেই। তোমাদের শঙ্করদা একশো একটা মেয়েলি কেসে ফেঁসে আছে। গুলটুর বোন রাধা শঙ্করের বিয়ে করা বউ। খুব ভালো মেয়ে। ওদের দুটো মেয়েও আছে। কিন্তু শঙ্কর সংসার করে রোবটকালীর সঙ্গে। তারও আবার দুটো মেয়ে। একটা শঙ্করের, আর একটা প্রথম পক্ষের। মানে হল, শঙ্করের ছ’কোণে ছ’টি নারী। ফলে, শঙ্করকে ওই ক্যাপ্টেনের শরণাপন্ন হয়ে থাকতেই হচ্ছে। ও ফেঁসে গিয়েছে। ক্যাপ্টেন কিন্তু আমাকে ফাঁসাতে পারেনি।
আমাকে তো এত বছর ওই ক্যাপ্টেন দেখছে— আমার সম্পর্কে একটাও ভবিষ্যদ্বাণী করেনি। করতে পারেনি। আমি চান্স দিইনি, উনি স্কোপ পাননি। আমি স্পেস দিই না। তুমি যেই হও তোমার জায়গায় থাকো বাবা। আমি এইসব ঢপের মানুষকে ঠাকুর বানাতে পারব না।’ সুজি টেবিলে চাপড় মারে। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে এসে সুজি থামল। তলানির চাটুকুও চকাৎ করে টেনে ঠক করে গ্লাসটা টেবিলে রাখে। বলল, ‘তুমি আমার সঙ্গে বিকেলে চলো। ওর বাড়ি গিয়ে ওকে খিস্তি দিয়ে আসব। তোমার সামনে খিস্তি দেব, দেখবে আমি কত বড় বাপের বেটা।’
কথা শেষ করে সুজি বুক চিতিয়ে টানটান হয়ে বসল। বলল, ‘সেদিন খেল দেখলে—অন্তত এক কিলো মাংস খেল। আমি আপত্তি করিনি। তুমি কী ভাবছ আমি কিছু বুঝিনি। ওকে শঙ্কর খবর নিতে পাঠিয়েছে। হয়তো দেখো, আমার হয়ে বউ নিয়ে আসার জন্য নেমন্তন্নই করে দিয়েছে। ওই রকম একটা সুন্দরী বাচ্চা মেয়েকে ফাঁসিয়েছে বুড়োটা। কীভাবে ফাঁসাল? দু’দিন যাক আমি ঠিক বের করে ফেলব।’
‘কবে যাবে সুজিদা?’
‘কবে যেতে চাও?’
‘আজ।’
‘আজই? আজ তো হবে না ভাই, কাল চলো। তোমার বাইক নিয়ে আসবে, আমাকে তুলে নেবে। আটটা -ন’টা।’
‘সকাল না রাত?’
‘না, না, রাতে নয়, রাতে নয়। সকাল।’ সুজি আঁতকে উঠে বলে, ‘রাতের বেলা ও শালা কী সব পুজো টুজো করে। বিশ্বাস নেই কোনও চক্করে ফেলে দেবে। মালটার বদনাম আছে।’
‘কী বদনাম?’ খুব আলতো গলায় সহজ প্রশ্ন করে।
ঘাড় নাড়ায় সুজি, ‘ওসব তুমি বুঝবে না বাবু। অনেক চক্কর! যদিও ওসব বুজরুকি আমি বিশ্বাস করি না। যত্ত ফালতু কথা।’ কথাটা বলে সুজি চুপ করে থাকে। সময় নেয়। যেন ভাবে বলবে কি বলবে না। ‘তুমি তো সায়েন্সের স্টুডেন্ট তুমি বিশ্বাস করবে কেন? আমি মাধ্যমিক ফেল—আমিই করি না।’
‘তুমি বলোই না, শুনি।’ সহজ আশ্বস্ত করে।
‘এটা ঠিক কথা, সবকিছু শুনে রাখতে হয়। নইলে হট করে কেউ কিছু বললে ঠকে যাবে। কিন্তু তুমি যদি শুনে টুনে তৈরি থাকো, তাহলে কোনটা খেলা বুঝতে পারবে।’ হালকা গলা খাকারি দেয় সুজি, ‘দাঁড়াও একটা সিগারেট ধরাই।’ সিগারেট ধরিয়ে খুব আয়েশ করে বসে সুজি, যেন কত গল্প বলবে। ‘শোনো, এটা আমি কার থেকে শুনেছি তার নাম বলব না। সে ক্যাপ্টেনকে মারাত্মক ডরায়। এটা দেখার পর, মানে জানার পর ক্যাপ্টেন নাকি তাকে বলেছিল— কাউকে বলিস নে। বললে তোর ক্ষতি হবে। পরিষ্কার ভয় দেখিয়েছিল। কিন্তু সে যে কোনও কারণেই হোক আমাকে বলে ফেলেছে। বলেছে, মানে নেশার ঝোঁকে বলেছে। সে আর ক্যাপ্টেন নাকি একদিন মাল খাচ্ছিল। সে-ই কিনেছিল। খাবারও কিনেছে। দু’জনে বসেছে ক্যাপ্টেনের ঠেকে। সাধু সন্ন্যাসীদের আশ্রম থাকে, এই মালটার আছে ওই ঠেক। বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া বড় একটা হলঘর। হলঘরটার মাথায় টালি চাপানো। পরমেশ্বর কতবার বলেছে— ক্যাপ্টেন ক’টা পিলার তুলে ছাদটা ঢেলে দিচ্ছি। ক্যাপ্টেন রাজি হয়নি। লোকটার এটা কিন্তু একটা মহৎ গুণ, অন্যের টাকায় কোনও লোভ নেই। লোভ আছে খাওয়ার আর সঙ্গের—। ওর যদি কাউকে পছন্দ হয়, ঠিক তাকে কিছু একটা করে ম্যানেজ করে ফেলে। আর সে-ও ক্যাপ্টেনের পিছন পিছন ঘরে। অথচ অনেকে আছে তারা ক্যাপ্টেনের সঙ্গ পাওয়ার জন্য বার বার যায়, নানা ফলমূল দেয়। ভেট চড়ায়। ক্যাপ্টেন তাদের এমন বেইজ্জত করে, তা সহ্য করা যায় না। ক্যাপ্টেনের ওই ঠেকে আমিও দু’-দুবার মাল খেয়েছি। কিন্তু বিষয়টা আমি কোনওদিন দেখিনি। সে বলেছে, ব্যাপারটার মধ্যে নাকি তিথি নক্ষত্রের যোগ আছে। সে ওই তিথি নক্ষত্রের খোপে পড়ে গিয়েছিল। ওই যোগ ছিল সেইদিন। সেদিন তারা দু’জনেই ছিল। ক্যাপ্টেনের কি পুজো টুজো ছিল। সারাদিন উপোস করে পুজো টুজো সেরে উঠে ফল প্রসাদ আর তেলেভাজা মুড়ি খাচ্ছিল। উপোস করে তেলে ভাজা মুড়ি— সত্যিই ও পিচাশ! নিজেকে ও ঠিকই বলে। তো যার কথা বলছি সে আর ক্যাপ্টেন বসেছে। সে-ই সব নিয়ে গিয়েছে, সে কোনও একটা ব্যাপারে ক্যাপ্টেনকে ম্যানেজ করতে চাইছিল। সেটা কী ভেঙে বলেনি। তবে আন্দাজ করতে পেরেছিলাম, সে ক্যাপ্টেনের মন জুগিয়ে শঙ্করকে ধরতে চাইছিল। শঙ্করের প্রজেক্টে মাল সাপ্লাই করবে আর কী! বেশ ঘটা করে আয়োজন করেছে। কাবাব, চিকেন ফ্রাই নিয়ে গিয়েছে। গ্লাসে মাল ঢালা হয়েছে। দু’জন লোক তিনটে গ্লাস। দুটো কাচের, একটা প্লাস্টিকের। সে ভেবেছে, ক্যাপ্টেনের বুঝি দুটোই কাচের গ্লাস আছে। তাই তৃতীয়জনের গ্লাস প্লাস্টিক। তবে সে এখনও আসেনি।
ক্যাপ্টেন কিন্তু তিনটে গ্লাসই রেডি করে বসল। তারপর প্লাস্টিকের গ্লাসটা নিয়ে গিয়ে ঘরের এক কোণে রেখে এল। রেডি করা পাক্কা এক গেলাস মাল। সে বলল, ক্যাপ্টেন ওখানে রাখছ কেন? ক্যাপ্টেন বলেছিল, থাক শালার ভাগের জিনিস, যখন মনে হবে এসে খেয়ে যাবে। তো খাওয়া শুরু হল। কিন্তু তৃতীয়জন আর এল না। এদিকে খাওয়া চলছে। এক সময় বোতল খতম। তখনও তৃতীয়জন এল না। সে বলল, ক্যাপ্টেন তোমার লোক আর আসবে না। ওই গ্লাসটা নিয়ে আসি। ভাগ করে খাওয়া যাবে। ক্যাপ্টেন বলল, ও কি আর আছে রে? ঠিক খেয়ে গিয়েছে। দেখ যদি পড়ে থাকে নিয়ে আয়, খাই। শুনে সে ঘরের কোণ থেকে গ্লাসটা আনতে যায়। গিয়ে দেখে অবাক কাণ্ড, গ্লাসটা শুকনো খটখটে, এক ফোঁটা মাল নেই। সে চিৎকার করে— ক্যাপ্টেন মাল কোথায় গেল? ক্যাপ্টেন বলল, তাহলে ওই শালা কখন এসে খেয়ে গিয়েছে।’ সুজি থামল, কিছুক্ষণ সহজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। বলল, ‘তুমি কি আমার গল্পের মানে বুঝলে? অনেককে মাল খাওয়ার সময় দেখবে, গ্লাস থেকে ক’ফোঁটা নিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। ধরিত্রীকে জলদান করল। আর ওই ক্যাপ্টেন নাকি এক গ্লাস মাল নিয়ে ঘরের কোণে রেখে আসে। কে খায় জানিস— ওটা নাকি পিশাচ খাবে। সে বার বার জিজ্ঞেস করায় ক্যাপ্টেন পিশাচের নামই বলেছে। সেইসঙ্গে এটাও বলেছে, তোর পয়সায় কেনা মাল পিশাচ খেয়েছে, এটা কাউকে বলবি না। বললে তোর ক্ষতি হবে। কিন্তু সে বিষয়টা হজম করতে পারেনি। আমাকে বলেছিল।’
‘তার কোনও ক্ষতি হয়নি? খোঁজ নিয়েছিলে।’ সহজ বলল।
সুজি ঘাড় ফাটায়, ‘শোনো আমাদের ক্ষতি তো সবসময় হচ্ছে। এই যে আকাশদীপের তিনটে ফ্ল্যাট কিছুতেই বুকিং হচ্ছে না। এটাও একটা ক্ষতি। ক্ষতি ধরলে হবে না।’ সুজি গম্ভীর মুখে বলে। ‘তাছাড়া কথাটা আমি একদিন তোমার পরমেশ্বরদাদাকে বলেছিলাম। সে রা-টি কাটল না। চুপচাপ শুনে গোল্ডফিসের মতো মুখ করে বসে থাকল।’
‘তুমি শঙ্করদাকে জিজ্ঞেস করনি?’
‘করেছিলাম। ও একটা ফালতু ছেলে। আমাকে বলল—তুই একটা মালের বোতল আর খাবার কিনে ক্যাপ্টেনের ঠেকে চলে যা। নিজের চোখে দেখে আয়। তিথি নক্ষত্র আমি বলে দেব। যা, যা, তোর টাকায় কোনও মানুষ তো মাল খেতে পারবে না, পিশাচই খাক। এটা একটা উত্তর হল। সেদিন আমার খাওয়াদাওয়া হচ্ছে দেখে শঙ্করই ক্যাপ্টেনকে পাঠিয়েছিল। তবে হ্যাঁ, আমিও ছাড়নেওয়ালা ছেলে নই। আমাদের পার্টির সঙ্গে যুক্ত কিছু সায়েন্সের ছেলেপত্তর আছে। তাদের নাম ধাম গোপন রেখে ফুল কেসটা বললাম। তাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাইলাম— গ্লাসের মদ কোথায় গেল?’
‘তারা কী বলল?’
‘তারা বলল— গ্লাসে ফুটো ছিল।
কিন্তু ফুটো থাকলে তো ঘরের মেঝে ভাসবে। এক গ্লাস জল কম নয়। ওরা বলল, ‘ট্রিকস কিছু আছে। খোঁজ নাও। নইলে চলো একদিন, সামনাসামনি দেখি। কিন্তু কে নিয়ে যাবে? ওরা বলছিল— গ্লাসের তলায় কী ছিল? যে আমাকে বলেছিল, তাকে আমি ধরেছিলাম, সে বলল, ঘরের কোণে বালির তৈরি একটা আসন করা আছে, সেখানে গ্লাস রেখেছিল। তখনই আমার মনে পড়ে গেল— ক্যাপ্টেনের ঘরের মেঝেটা মাটির। বালি মাটি এক গ্লাস মাল শুষে নিয়েছে।’
সহজ বলল, ‘তাহলে তো তোমার হিসেব মিলেই গেল, গ্লাসে ফুটো ছিল। বালির আসন জল খেয়ে নিয়েছে।’
সুজি মুখ গম্ভীর করল, বলল, ‘একটা কথা কি জানো, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। ও বলছে, মেঝে বালি সব শুকনো। কোথাও ভিজেভাবও ছিল না। ও নিজে দেখেছে।’
সহজ বলল, ‘ও নেশার ঘোরে দেখেছে—। ওর কথা কী করে বিশ্বাস করবে?’
সুজি চুপ করে বসে থাকল। তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘এরকম তিথি নক্ষত্রে কিন্তু আর একজন পড়েছিল। সে-ও অদ্ভুত একটা কথা বলেছিল। তার কথা শুনে আমি খিস্তি দিয়েছিলাম। সে-ও এই এক জিনিস দেখেছে। তবে সে কোনও প্রশ্ন করেনি। মাল খেতে বসে দেখেছে ক্যাপ্টেন একটা গ্লাস রেডি করে ঘরের কোণে রেখে দিল। খাওয়া শেষে ক্যাপ্টেন খালি গ্লাস এনে রাখল। সে আরও একটা জিনিস দেখেছে, ক্যাপ্টেন নাকি একটা সিগারেট ধরিয়ে বালির আসনের দিকে ছুড়ে মারল। সিগারেটটা বালির ওপর গিয়ে পড়ল। কিন্তু সেটা নিভে গেল না, ধিকি ধিকি জ্বলতে জ্বলতে পুরো শেষ হল। একদম স্বাভাবিকভাবেই ফিল্টারের কাছে এসে। এমনকী সে দেখেছিল, ঘরের কোণে সিগারেটের ধোঁয়া তালগোল পাকাচ্ছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, কেউ ওখানে বসে স্মোক করছে।’
সহজ হাসল, ‘এই ব্যক্তিও নিশ্চয়ই নেশার ঘোরে ছিল?’
সুজি কঠিন গলায় বলল, ‘ওই তো বললাম, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।’