শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
মুকুল অপারেশনের শুরু ২ জুন, সন্ধ্যায়। বিধানসভা ভোটের ফল বেরনোর ঠিক একমাস পরই আচমকা মাস্টারস্ট্রোকটা খেলে দেন অভিষেক। দলনেত্রীর পরামর্শে ছুটে যান দলের একদা সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক, অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুকুলবাবুর অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে। ভোটের ফল বেরনো ইস্তক দু’তরফে বরফটা গলছিলই। হাসপাতালে অভিষেকের যাওয়ায় তা যেন মুহূর্তে জল হয়ে গেল। অভিষেকের সৌজন্যে সেদিন আপ্লুত হয়ে পড়েন মুকুল পুত্র শুভ্রাংশু। যন্ত্রণায় মন ভারী হয়ে ওঠে একদা ছায়াসঙ্গী মুকুলেরও। সংগঠনের এত কাজ যে কোনও বিজেপি নেতা তখনও দলের সর্বভারতীয় সহসভাপতির স্ত্রীর খবরটা নিয়েই উঠতে পারেননি! অথচ ৪৪ মাস আগে প্রাক্তন রেল ও জাহাজ মন্ত্রী মুকুল রায়কে ভাঙিয়েই বাংলায় ডালপালা বিস্তারের ছক কষেছিল বিজেপি। ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর। ভাঙনের সেই শুরু। মোদি-অমিত শাহের সেই স্বপ্ন (দুঃস্বপ্ন পড়ুন!) ধূলিসাৎ করে দিয়েছে বাংলার মানুষ। দলবদলুরা ক্রমশ ছত্রখান। শুধু কাঁচরাপাড়াই নয়, ডোমজুড়, উত্তরপাড়া থেকে বাংলার অলিগলি সর্বত্র আজ ঘরে ফেরার গান। প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, বিজেপি আদ্যন্ত একটা বাংলা ও বাঙালি বিরোধী দল। তবু, একুশের ভোটযুদ্ধে আকাশছোঁয়া সাফল্যের পরও ঘরের পুরনো সৈনিককে দুর্দিনে ভুলে যাননি মমতা। এই মুহূর্তে মুকুলকে না ফেরালেও তেমন কিছু যেত আসত না। মহাভারত অশুদ্ধও হতো না। তবু সম্মান দিয়েই তাঁকে তৃণমূল পরিবারে ঠাঁই দিয়ে বড় মনেরই পরিচয় দিয়েছেন মমতা, অভিষেক দু’জনেই।
শুক্রবার বিকেলে যখন তৃণমূল ভবনে দলের বর্তমান সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক যত্ন করে অগ্রজপ্রতিম প্রাক্তনকে উত্তরীয় পরিয়ে দলে ফিরিয়ে নিচ্ছেন, তখন যেন একটা অদ্ভুত রাজনৈতিক সমাপতনের সাক্ষী থাকলাম আমরা। দক্ষ সংগঠক মুকুল রায়ের ‘ঘর ওয়াপসির’ চেয়েও অভিষেকের এই উত্থান ও বাংলার রাজনীতিতে নিজেকে দাপটের সঙ্গে মেলে ধরা আমার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মাত্র এক সপ্তাহ আগে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েই তিনি বাংলার বাইরে তৃণমূলের বিস্তারে কাজ করার শপথ নিয়েছেন। সেই সঙ্কল্প থেকেই গড়ে তুলেছেন নিজের ইয়ং ব্রিগেড। কাজ শুরুর আগে আশীর্বাদ নিতে ছুটে গিয়েছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সী, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৌগত রায়ের মতো প্রবীণদের কাছে। এই পটভূমিতেই দক্ষ সংগঠক মুকুলের প্রত্যাবর্তন জাতীয় আঙিনায় দলের প্রসারে সহায়ক হতে পারে। বিশেষত এখন থেকেই মমতা ও অভিষেক দু’জনেই যখন পাখির চোখ করছেন আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে। এবং সেই লক্ষ্যে একটি সর্বভারতীয় জোট বা বৃহত্তর মঞ্চ গড়ে নরেন্দ্র মোদিকে হারানোই যখন দলের প্রধান অভিমুখ। মমতাকে বিরোধী মুখ করে সর্বভারতীয় স্তরের আসন্ন সেই লড়াইয়ে অভিষেকই হতে চলেছেন নেত্রীর প্রধান সারথি। সঙ্গে মুকুল রায়ের অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের মিশেলে এই খেলা হবে দিল্লিতে বিজেপি-বিরোধী শক্তিকে একজোট করে গেরুয়া শিবিরে কাঁপন ধরানোর লক্ষ্যে।
আর ঠিক এই কারণেই পালাবদলের নির্বাচন না হওয়া সত্ত্বেও সদ্য সমাপ্ত একুশের ভোটের ফলের এত বিরাট তাৎপর্য। দেশের বিরোধীদের যা পুনরায় চাঙ্গা করেছে, লড়াইয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছে। অভিধানে উত্তরাধিকার তো কোনও নিষিদ্ধ শব্দ নয়। তাকে সূর্যের আলোয় প্রতিষ্ঠিত করাও কোনও অপরাধ নয়। বরং যে দল সময়মতো ভবিষ্যতের নেতা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়,তারাই ইতিহাস থেকে মুছে যায়। ভারতীয় রাজনীতিতে দশকের পর দশক ধরে তা সসম্মানে চলে আসছে। কংগ্রেস তো বটেই একাধিক বিজেপি নেতার ভাই ভাতিজা ছেলেও আজ গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। তাহলে এক বাঙালি যুবকের ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠায় এত অশালীন আক্রমণ কেন? রাহুল গান্ধী থেকে অখিলেশ, সুপ্রিয়া সুলে, জগন্মোহন রেড্ডি সবাই তো উত্তরাধিকারেরই ফসল। আর যাঁদের নিয়ে সম্প্রতি বিজেপির আদিখ্যেতা চরমে পৌঁছেছে সেই জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, জিতিন প্রসাদরা কিংবা রাজস্থানের দোদুল্যমান শচীন পাইলট কি পরিবারতন্ত্রের প্রতিনিধি নন? কিংবা অমিত শাহের ছেলে না হলে এত সহজে জয় শাহ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অন্যতম নিয়ন্ত্রক হতে পারতেন! ক’টা আর্ন্তজাতিক খেলায় অংশ নিয়েছেন তিনি? আর সিপিএমের অবস্থাটা দেখুন—৩৪টা বসন্ত ক্ষমতায় থেকেও একটা গ্রহণযোগ্য বিকল্প মুখ খাড়া করতে পারেনি। জোতি বসু ও বুদ্ধদেবের পর আর কোনও গ্রহণযোগ্য মুখ নেই। ফলে বার্ধক্য ও অসুস্থতার ভারে নুইয়ে পড়ে দলটা আজ অস্তিত্ব সঙ্কটে দিশাহারা। এখন যখন সব শেষ তখন ছাত্র-যুবদের এগিয়ে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করছে। এসব জেনেও খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন মঞ্চে নাটকীয় ঢঙে বাংলার জননেত্রীকে ‘দিদি ও দিদি’ বলে অমার্জনীয় অসভ্যতা করেন। ‘ভাইপো’ বলে অশ্লীল নাটুকে আক্রমণ করেন তখন গোটা বাঙালির আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে। আর প্রধানমন্ত্রীর ওই সীমাহীন নষ্টামির জবাব দিতেই আত্মপ্রকাশ ঘটে এক সংযত মার্জিত নেতার। এখানেই অভিষেকের সাফল্য। এখানেই ৩৪ বছরের যুবকের ঠান্ডা মাথার জয়।
ওই যে বললাম, যতই বিজেপির আক্রমণ ধেয়ে আসুক কতই বা বয়স তাঁর। জন্ম ১৯৮৭তে। এরাজ্যে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার দশ বছর পরে। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল প্রতিষ্ঠার ১১ বছর আগে। আজ তিনিই রাজ্য-রাজনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। মাথার উপর অভিবাবক ৬৫ বছরের হার না মানা অগ্নিকন্যা। নিজেকে সাধারণ কর্মী বলে এড়িয়ে গেলেও তৃণমূলের ক্ষমতার অলিন্দে নাম্বার টু। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। এই অসামান্য উত্তরণ এত কম সময়ে! পরপর দু’বারের এমপি। সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা ভোটে এই শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী নেত্রীর হ্যাটট্রিকের পাশাপাশি তাঁর এই জেট গতির উত্থানটাই বা কম কীসে? পিসি-ভাইপোকে একসূত্রে গেঁথে বিজেপির ছোট-বড় নেতারা যতই কুৎসিত ব্যক্তিগত আক্রমণের রাস্তায় হেঁটেছেন, তিনি মনে মনে ততই আরও সঙ্ঘবদ্ধ ও সংযত হয়েছেন। মাথা ঠান্ডা রেখে প্রতিটি আক্রমণের জবাব দিয়েছেন। যার অভিঘাতে ভেঙে পড়েছে দলবদলু বেইমানদের মিথ্যে দিয়ে সাজানো গড়। বলতেই হবে, জননেত্রীর ছায়ায় আটকে না থেকে নিজের একটা ধীর স্থির পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তিও তৈরি করেছেন। লড়াইয়ের সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির হৃদসম্পন্দনকে একসূত্রে জড়িয়ে নিতে মমতার কোনও জুড়ি নেই। এটা পরীক্ষিত সত্য। নেত্রী এখনও বাংলা তথা জাতীয় রাজনীতির মধ্যগগনে। সূর্যের মতো আলো আর উত্তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছেন। সেই উত্তাপে হালে পানি পাননি প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। তাঁদের ডেলি প্যাসেঞ্জারি বিফলে গিয়েছে। কিন্তু মমতার ছত্রছায়া থেকেই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো এক নেতার আত্মপ্রকাশও এই একুশের নির্বাচনের অসামান্য প্রাপ্তি, যা দলের সাফল্যকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।