শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
গত ১৫ মাসে যে ভুলগুলো করা হয়েছে, এই প্রসঙ্গে গুরুত্বসহকারে সেগুলোর দিকে নজর রাখব:
ভুলচুকগুলো
১. কেন্দ্রীয় সরকারের বিশ্বাস ছিল যে, ভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ের পর আর কোনও ঢেউ আসবে না। অতএব টিকা পরে সময়-সুযোগে নেওয়া যাবে এবং তার জন্য দেশীয় সরবরাহই যথেষ্ট হবে। সেকেন্ড ওয়েভের হুঁশিয়ারিটা সরকার অগ্রাহ্য করেছিল। সরকার এটাও মানেনি যে, সকলের জন্য দ্রুততার সঙ্গে টিকাকরণটা জরুরি।
২. দু’টো দেশি সংস্থার নিরপত্তা এবং মুনাফার নিশ্চয়তা নিয়ে সরকার অতি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। অন্যদের টিকার ইমার্জেন্সি ইয়্যুজ অ্যাপ্রুভাল (ইইউএ) দেওয়া নিয়ে অনাবশ্যক টালবাহানা করে গিয়েছে। এমনও হতে পারে, অন্য টিকা উৎপাদকদের ভীষণভাবে নিরুৎসাহই করা হয়েছিল, যাতে তাঁরা ভারতে ইইউএ-র জন্য আবদেন না করেন। এই প্রসঙ্গে ফাইজারের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে।
৩. সিরাম ইনস্টিটিউটকে ভারত সরকার তাদের প্রথম অর্ডার দিয়েছিল ২০২১-এর ১১ জানুয়ারি। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউরোপের অন্যান্য দেশ এবং জাপান অর্ডার দিয়েছিল তার বহু আগে—২০২০ সালর মে-জুনের দিকে। আরও উল্লেখ করতে হয় যে, ভারত অর্ডার দিয়েছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লক্ষ ডোজের জন্য! আর ভারত বায়োটেকের কাছে ভারতের অর্ডার জমা পড়েছে আরও পরে। তার তারিখ ও পরিমাণটা অবশ্য জানা নেই।
৪. সিরাম ইনস্টিটিউট মূলধনী অনুদান বা ভর্তুকির জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু টিকার সাপ্লাই নিশ্চিত করার জন্য সরকার সেই সময় সামান্য অগ্রিমও দুই ভারতীয় টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থাকে দেয়নি। অ্যাডভান্স কিছু অনুমোদন করা হয়েছে অনেক পরে—১৯ এপ্রিল, ২০২১ তারিখে—সিরাম ইনস্টিটিউটের জন্য তিন হাজার কোটি টাকা এবং ভারত বায়োটেকের জন্য দেড় হাজার কোটি টাকা।
৫. সরকার এই অ্যাসেসমেন্টটাও করেনি, গত বছর এবং চলতি বছরের কোন মাসে দু’টো ভারতীয় সংস্থার টিকা উৎপাদন কতটা হতে পারে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তাদের উপর সরকারের তরফে কোনও চাপও ছিল না। এমনকী, ওই দুই সংস্থার প্রকৃত উৎপাদন ও সাপ্লাই কত, মাস ধরে ধরে সেই তথ্যটাও সরকার প্রকাশ করেনি।
নীতিহীন পরামর্শ
৬. রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে কোনওরকম আলোচনা করার বা পরামর্শ গ্রহণের ধার ধারেনি। ভ্যাকসিনেশন বা টিকাকরণের পুরো ব্যাপারটাই কেন্দ্রীয় সরকার একতরফাভাবে ঠিক করেছে। সুপ্রিম কোর্টের মনে হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের টিকাকরণ নীতি হল একটা ‘স্বেচ্ছাচার এবং অযৌক্তিক’ ব্যাপার।
৭. কেন্দ্রীয় সরকার ভ্যাকসিন সংগ্রহের ব্যবস্থাটা বিকেন্দ্রিত করল এবং ১৮-৪৪ বর্ষীয়দের টিকাকরণের দায়টা ঝেড়ে ফেলল রাজ্য সরকারগুলোর ঘাড়ে। ভ্যাকসিন সংগ্রহের ব্যবস্থাটা যে কারণে এবং যারই বুদ্ধিতে বিকেন্দ্রিত হয়ে থাক, এটা ছিল একটা মস্ত বড় ভুল। পূর্ব সিদ্ধান্ত মতো, রাজ্য সরকারগুলোর টেন্ডার নিয়ে কোনও প্রতিযোগিতা ছিল না। সব মিলিয়ে ভ্যাকসিন প্রোকিয়োরমেন্ট বা টিকা সংগ্রহের ব্যাপারটাকে একটা ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে দেওয়া হয়।
৮. কেন্দ্র, রাজ্য সরকার এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য ভ্যাকসিন সরবরাহের ভিন্ন ভিন্ন দাম নির্ধারণ করে দিয়ে মোদি সরকার একটা মারাত্মক ভুল করেছে। দামের ভিন্নতার ফলে কী হয়েছে— প্রসস্তুতকারকরা বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে বেশি পরিমাণে সাপ্লাই করেছে। পরিণামে সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনমতো টিকা পৌঁছয়নি, সেখানে তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে এবং কিছু রাজ্যে সাময়িকভাবে টিকাকরণ বন্ধও রাখতে হয়। বিতর্কটা আরও চড়ে গিয়েছে এই কারণে যে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে প্রতি ডোজ কোভিশিল্ড, স্পুটনিক ভি এবং কোভ্যাকসিনের দাম যথাক্রমে ৭৮০ টাকা, ১১৪৫ টাকা এবং ১৪১০ টাকা নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
৯. কোউইন অ্যাপে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে টিকাকরণের নিয়মের গেরোও একটা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা। ব্যাপারটাকে সুপ্রিম কোর্টও ভালোভাবে নেয়নি। শীর্ষ আদালত মনে করে, এতে ডিজিটাল ব্যবস্থায় বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে এবং এটা বৈষম্যমূলক।
এই ত্রুটিগুলোকে সরিয়ে রাখা যাক। ভ্যাকসিনের উৎপাদন এবং সাপ্লাই দু’টোরই উন্নতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। রাশিয়ার স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিনের আমদানিতে আমাদের সুবিধা হয়েছে। ৬ জুন যে সপ্তাহের সূচনা হল, সেখান থেকে দৈনিক টিকাকরণের গড় সংখ্যাটা ৩০-৩৪ লক্ষ ডোজে উঠে এসেছে। কিন্তু এই গতিতেও যদি টিকাকরণ এগতে থাকে তবে এবছরের বাকি দিনগুলোতে (২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ৬০ কোটি ডোজের মতো টিকা দেওয়া সম্ভব হবে। লক্ষ্যমাত্রা যেখানে ৯০-১০০ কোটি পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের প্রত্যেককে দু’টো করে ডোজ টিকা দেওয়া, সেখানে টিকাকরণের এই ছবিটা অত্যন্ত পরিতাপের। (উল্লেখ্য, যে ৫ কোটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের দু’টো করে ডোজ টিকা নেওয়া হয়ে গিয়েছে, এই হিসেবের মধ্যে তাঁদেরকে রাখা হয়নি।)
রকেট বিজ্ঞান নয়
এটা পরিষ্কার যে, পরবর্তী পদক্ষেপগুলো জুন, ২০২১-এর আগেই সম্পন্ন করে ফেলতে হবে। এর একটা তালিকা এইরকম:
১. প্রতিটা দেশীয় উৎপাদকের (দুই, তিন বা তারও বেশি) জন্য একটা বিশ্বাসযোগ্য উৎপাদন সূচি—জুলাই-ডিসেম্বর, ২০২১ সময়ের, মাস ধরে ধরে তৈরি করা হোক। তার সঙ্গে যোগ করা হোক স্পুটনিক ভি আমদানির পরিমাণ। আরও যোগ করা হোক মাস ধরে ধরে তার উৎপাদনের পরিমাণ। তারা ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকের যে-কোনও ধরনের লাইসেন্সি হতে পারে।
২. ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসন এবং সিনোফার্মের মতো যারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) অনুমোদিত, অবিলম্বে তাদের কাছে ভ্যাকসিনের অর্ডার দিতে হবে। তাদের অগ্রিম পেমেন্ট করে দিয়ে সরবরাহের সূচি নিয়ে চুক্তি করা হোক। মোট সরবরাহের হিসেবের মধ্যে এইগুলোকেও ধরা হোক।
৩. ভ্যাকসিন সংগ্রহের (৭ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৭৫ শতাংশ ভ্যাকসিন সংগ্রহের দায়িত্ব স্বীকার করেছেন) এবং রাজ্যগুলোকে তাদের প্রয়োজন অনুসারে বণ্টনের পুরো দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারকে নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে ভ্যাকসিন বণ্টনে রাজ্যগুলোও যেন কোনওরকম বৈষম্য না করে।
৪. প্রয়োজন অনুযায়ী ভ্যাকসিন সংগ্রহের সমস্যা হবে বলেই আশঙ্কা হয়। তাই সরকারের প্রকাশ্যে জানিয়ে দেওয়া উচিত, এই ‘গ্যাপ’ বা ফাঁকটা তারা কীভাবে পূরণ করবে। গ্যাপটা যদি ডিসেম্বর, ২০২১-এর আগে পূরণ করা যাবে না বলে মনে হয়, তবে সরকার টিকাদানের অগ্রাধিকার অবশ্যই নতুন করে ঠিক করুক। আর এই সিদ্ধান্ত তারা যেন একতরফাভাবে না নেয়, অবশ্যই রাজ্য সরকারগুলোর পরমর্শ নিক।
৫. কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলোকে আরও দু’টো জিনিসের উপর অবশ্য করে জোর দিতে হবে—স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বজায় রাখা এবং তার উন্নতি বিধান। এর মধ্যে হাসপাতালগুলোতে বেড সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যবস্থাও করতে হবে।
উপর্যুক্ত পাঁচটা ব্যবস্থা অবশ্য রকেট সায়েন্স নয়। এসব করার জন্য উপযুক্ত প্ল্যানিং বা পরিকল্পনা জরুরি। প্ল্যানিং কমিশনের অবলুপ্তির কারণে মোদি সরকারের কাছে এর কিছু কিছু বাইরের ব্যাপার বলেই মনে হবে। কিন্তু, অন্য দেশগুলো এসব রুটিন মাফিক করেই থাকে। প্ল্যানিং করার ব্যাপারে এই সরকারের মধ্যে একটা যে বিদ্বেষভাব রয়েছে, সেটা অবশ্যই ঝেড়ে ফেলতে হবে। ওইসঙ্গে একটা ‘ডেডিকেটেড গ্রুপ’ তৈরি করা দরকার, যারা অচিন্তনীয় ঘটনাগুলো সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করবে এবং প্রতিটা সম্ভাব্য অঘটন মোকাবিলার জন্য প্ল্যান রেডি রাখবে।
দেখা যাক, এটার আগে কেন্দ্রীয় সরকার চ্যালেঞ্জিং কাজটা কীভাবে উতরোয়।