শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
আর্থ-সামাজিকভাবে শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ সাফল্য বাংলাদেশের নারীদের বিপুল অংশকে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে একটি নীরব বিল্পব সাধন। যাকে বাংলাদেশে ইনক্লুসিভ নারীজাগরণ বলা হচ্ছে। বিগত বছরগুলিতে বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিস অথবা সিকিউরিটি ফোর্স কিংবা আর্মিতে বহু নারীর যোগদান যেমন উল্লেখযোগ্য, ঠিক তেমনই আর্থিকভাবে নিম্নবর্গের মহিলাদের জন্য বিপুল একটি সুযোগ এনে দিয়েছে রেডিমেড গার্মেন্ট সেক্টর, ক্ষুদ্র উৎপাদন শিল্প। লক্ষ লক্ষ মহিলা এখন এইসব ইউনিটে কাজ করেন। স্বনিযুক্তি প্রকল্প একটি সফল কাহিনি নারীদের কাছে। এভাবে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নারীদের সমর্থন নীরবভাবে পাচ্ছেন। ঠিক যেমন বাংলার একুশের ভোট প্রমাণ করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সবথেকে বেশি ভোট দিয়েছেন গ্রাম শহরের মহিলারাই। কারণ তিনিও নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। হাতে পৌঁছে দিয়েছেন টাকা।
শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এরকম একরাশ সাদৃশ্যের পাশাপাশি অমিলও আছে। হাসিনা সরকার সম্পর্কে সবথেকে বড় অভিযোগ হল, নির্বাচনে গরমিল। বাংলাদেশ যে উন্নতি করছে এটা স্বীকার করেও তাই বিশেষ কিছু মহলের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার মডেলকে নাম দেওয়া হয়েছে, ডেভেলপমেন্ট উইদাউট ডেমোক্রেসি। কিন্তু ওই অভ্যন্তরীণ বিতর্কে প্রবেশ না করেও বলা যায় যে, একটি নারীশক্তির নেতৃত্বে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের উত্থানের কাহিনিটি চমকপ্রদ। আর বিশেষভাবে আমাদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, দুই বাংলার বাঙালি জাতি, দুই নারীকে তাদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য বেছে নিয়েছে।
পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যকে হারিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শেখ হাসিনার দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের কাহিনি রূপকথার সঙ্গেই তুলনীয়। অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই সামাজিকভাবে অনেক বেশি জোরদার। কারণ, শেখ হাসিনার একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষপদে বসার প্রক্রিয়াটি ছিল সহজ। যেহেতু তিনি বাংলাদেশের কিংবদন্তি বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের কন্যা। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর দলের সর্বোচ্চ পদে তাঁর অন্যতম জীবিত কন্যাই আসীন হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কালীঘাট ব্রিজের কাছে দুধ বিক্রি করে সংসারে সাহায্য করার মধ্যে দিয়ে উঠে আসতে হয়েছে এলিট এডুকেটেড পুরুষ বাঙালি আধিপত্যের সঙ্গে লড়াই করে আজকের জায়গায়। তাঁর পথটি ছিল কণ্টকাকীর্ণ। আজও। সুতরাং তাঁর জার্নিটি একটি সাধারণ নিম্নবিত্ত মেয়ের জীবন সংগ্রাম থেকে সমাজের শীর্ষস্তরে উত্থানের অনুপ্রেরণার কপিবুক বলা যায়।
ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, মায়ানমার, আফগানিস্তান। এশিয়ার এই গোটা দক্ষিণাংশজুড়ে পুরুষ রাষ্ট্রনায়কদের আধিপত্য। তাদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। মায়ানমারে সু কি ক্ষমতায় আসীন হলেও একদিকে যেমন প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি, তেমনই আবার ক্ষমতচ্যুত হয়েছেন। এই যে চারদিকে শক্তিশালী পুরুষ রাষ্ট্রনায়কদের ভিড়ে একক একটি অস্তিত্ব বজায় রেখে অর্থনীতির উন্নয়ন হারে প্রায় সকলকে ছাপিয়ে যাওয়া, এটাই শেখ হাসিনার বিরল কৃতিত্ব। বিশ্বজুড়ে আজ বাংলাদেশের সাফল্যগাথা আলোচিত হচ্ছে।
প্রায় প্রতিটি দেশ যেখানে মায়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা মুসলিম উদ্বাস্তুদের স্থায়ী আশ্রয় দিতে রাজি নয় এবং আমাদের অজান্তে ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগরে বোটে, গোপন লঞ্চে হাজার হাজার রোহিঙ্গা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সমুদ্রে, খোলা আকাশের নীচে অবর্ণনীয় জীবনযাপমন করছে, কারণ কোনও দেশ তাদের ঢুকতে দিচ্ছে না, সেরকম এক সময়ে বাংলাদেশের এক অভিনব সিদ্ধান্ত। সন্দীপ দ্বীপ থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে ভেসে ওটা একটি নির্জন জনশূন্য নতুন দ্বীপকে একটি জনপদে পরিণত করা হয়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে সরিয়ে আনা চলছে। এই নতুন জনপদের নাম ভাসান চর। ঠিক যেন এক নতুন রাষ্ট্র। যেখানে শুধুই অন্য এক দেশের উদ্বাস্তুরাই থাকবে। যতদিন না তারা দেশে ফিরবে। এই ভাসান চর আবার জলে নিমজ্জিত হবে, সাইক্লোন হবে, এখানে এভাবে আস্ত একটা বাসভূমি গড়ে তোলা উচিত নয়, ইত্যাদি প্রচুর সমালোচনাও শুনতে হচ্ছে শেখ হাসিনাকে। কিন্তু একইভাবে বিশ্বজুড়ে তিনি অভিনন্দিতও হচ্ছেন এই মানবিক মনোভাবে। ভারতও শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছে এরকম একটি সমাধানে। এর নাম আশ্রায়ন প্রজেক্ট। এখনও পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার মানুষ সেখানে বসবাস করছে। আরও পাঠানো হচ্ছে। প্রাথমিক টার্গেট ১ লক্ষ। আমাদের অজান্তে তাই বঙ্গোপসাগরে একটি আশ্চর্য এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। নতুন জনপদ। নতুন জীবন। নতুন দ্বীপ। এই বিপুল এক্সপেরিমেন্টের ঝুঁকিটি নিয়েছেন এক বাঙালি কন্যা। শেখ হাসিনা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন স্বাধীনতার পর বাংলার রাজনীতিতে সবথেকে প্রভাবশালী এবং শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব? কারণ, এরকম অদ্ভুত সাফল্য কেউ পায়নি। তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল সিপিএম। আর তিনি মনে করতেন তাঁর উত্থানের অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিল কংগ্রেস। ২০১১ সাল থেকে তিনি এই দুই শক্তিকেই ক্রমেই নিয়ে গিয়েছেন খাদের কিনারায়। মাত্র ১০ বছরের মধ্যে ২০২১ সালে একটি ১৩৬ বছরের প্রাচীন এবং আর একটি ৫৭ বছরের পুরনো সর্বভারতীয় দলকে পশ্চিমবঙ্গে শূন্যে পরিণত করেছেন। তাঁর প্রবল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিপক্ষ শিবির সর্বদাই শক্তিশালী পুরুষ আধিপত্যপূর্ণ। ভারতে আর একজনও মহিলা মুখ্যমন্ত্রী নেই। এমনকী উঠে আসছেন না কোনও নতুন মহিলা জনপ্রিয় মাসলিডার। ১৯৮৪ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে এমপি হন মাত্র ২৯ বছর বয়সে। তারপর পরাজয়, আবার জয়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, রেলমন্ত্রী, প্রবল রাজনৈতিক আন্দোলন, নিজের দল গঠন ... ইত্যাদি ৩৭ বছরের একটি একক জার্নির অভিজ্ঞতা আর লড়াইকে তাঁর বিরোধীরা মনে রাখে না। আজকের অনভিজ্ঞ নেতানেত্রীরা নিজেদের ওজন না বুঝেই তাঁকে আক্রমণ করেন। বাংলার বর্তমান প্রধান বিরোধী দল বিজেপির এখনই প্রকৃষ্ট সময় সতর্ক হওয়ার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির ধীশক্তিকে সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত। তাঁকে নিয়ে ব্যক্তিগত হাসি-তামাশা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, তাঁর সিদ্ধান্তকে হেসে উড়িয়ে দেওয়া এসব করে পূর্বতন বিরোধীরা জিরো হয়ে গিয়েছে। এবার বিরোধী রাজনীতি একটু ম্যাচিওরড হওয়া দরকার। সবথেকে বড় বার্তা হল, যে নরেন্দ্র মোদি ভারতে একের পর এক নির্বাচনে অপরাজেয়, তাঁর অক্ষ্মৌহিণী বাহিনীকে একা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনায়াসে হারিয়ে দিলেন। তারপরই এই প্রথম গোটা দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রবলভাবে সমীহ করা শুরু হয়েছে। শেখ হাসিনা ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাস্ত করার ফরমুলা আপাতত নেই বিরোধীদের কাছে।
আগামী দিনে ভোটের সমীকরণে এই সাফল্য কতটা প্রভাব ফেলবে অথবা মোদি আবার বিপুলভাবে জনপ্রিয়তা ফিরে পাবেন কি না কিংবা কংগ্রেসই প্রধান চালিকাশক্তি হবে ইত্যাদি নানাবিধ জল্পনা অবশ্যই চলবে এখন থেকে। রাজনীতি সম্ভাব্যতার শিল্প। ঐতিহাসিক পরিস্থিতি নিমেষে অনেক রসায়ন বদলে দিয়েছে এই ভারতে। তবে রাজনীতির হিসেব-নিকেশ বাদ দিয়ে নিছকই জাতিগত আকাঙক্ষার তাগিদে ২০২৪ সালের দিকে আমরা বাঙালিরা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে লক্ষ করব এই জাতিটির জার্নিতে সত্যিই কি একটি নতুন ইতিহাস রচিত হবে? একদা একসঙ্গে থাকা দু’টি পাশাপাশি দেশের দুই প্রধানমন্ত্রীই কি বাঙালি নারী হবেন?