শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
২০১৩’র ২৫ ডিসেম্বর, নিউ দীঘার ‘অমরাবতী পার্কে’ একদিনে হাজির হয়েছিলেন ৪৮ হাজার পর্যটক। পর্যটন দপ্তরের ২০১০ সালের হিসেবে বলছে, সে বছরে ২৫ লক্ষ ৪৭ হাজার ১৭ জন পর্যটকের পা পড়েছিল দীঘাতে। উত্তরোত্তর সে সংখ্যা বেড়েছে। বন ও পরিবেশ দপ্তরের নথিতে স্পষ্ট—পুরনো ও নতুন দীঘার বহু হোটেল, পার্ক, হাসপাতাল, বাণিজ্য কেন্দ্র ‘কোস্টাল রেগুলেশন জোন’ বা CRZ-II ও CRZ-III-র বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করেই নির্মিত। উপকূলীয় আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে চলেছে যাবতীয় বেআইনি নির্মাণ। সমুদ্র সৈকতেই বালিখাদান। বালুকাবেলায় নিত্যনৈমিত্তিক গজিয়ে উঠেছে হোটেল।
১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন, সমুদ্রে মাছেদের ডিমছাড়ার সময়; যন্ত্রচালিত ট্রলারে মাছধরা নিষিদ্ধ। দাদনপাত্রবারের মাছমারা নিমাইদারা সেইসময় সমুদ্র যান না। মে-জুনের যে কোনও সময়, দাদনপাত্রবারের সমুদ্রসৈকতে দেখা মিলবে অজস্র ছোট ছোট ডিঙি নৌকার। মাছ ধরে ফিরে আসছেন খেপ খাটা হত-দরিদ্র কিছু জেলে। মে-জুনের সেই বিশেষ সময়টাতে মাছের সঙ্গে তাদের জালে উঠে আসে মিষ্টির দোকানের গাঢ় বাদামি রঙের ‘খেজুরের’ মত দেখতে অসংখ্য ‘সমুদ্র-শসা’ বা সি কিউকাম্বার (Acaudina molpadioides)। ১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ২০০১’র ১১ জুলাই থেকে সমুদ্র-শসা বিরল বিপন্ন প্রজাতি হিসাবে ‘তফসিল ১’-এ সংরক্ষিত। ‘সমুদ্র-শসা’র বিলুপ্তি গোটা সামুদ্রিক পরিবেশের পক্ষে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। পেটে জল ভর্তি ছোট সামুদ্রিক প্রাণী ‘সমুদ্র-শসা’কে, জেলেরা জাল ঝেড়ে, সমুদ্রের ধারে উচ্ছিষ্ট হিসাবে ফেলে যায়, বালির চরে নড়তে না পেরে বেঘোরে মারা পড়ে বেচারারা। জলভরা বেলুনের মত ফট ফট করে ‘সমুদ্র-শসা’কে পা দিয়ে টিপে মারাতেই মর্ষকামী পর্যটকদের অনাবিল আনন্দ। পর্যটকরা জানেনই না ‘সমুদ্র-শসা’ একটি সংরক্ষিত প্রাণী, তাকে মারার শাস্তি তিন বছরের জেল বা পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা।
জেলেদের জালে প্রতি বছর ওই সময়েই ধরা পড়ে বিরাট বিরাট ‘হর্স-শু-ক্র্যাব’ বা অশ্বখুর কাঁকড়া। শক্ত বাদামি খোলায় মোড়া, বিকট-দর্শন অশ্বক্ষুরাকৃতি কাঁকড়ার মুখের সামনে অ্যান্টেনার মত লম্বা কাঁটা থাকে। জলে সাঁতারের সময় কাঁটাটি নৌকার হালের কাজ করে। ‘হর্স-শু-ক্র্যাবের’ বিরল তাম্র-ঘটিত নীলরক্ত, ‘হিমোসায়ানিন’, চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভীষণ জরুরি। প্রাণদায়ী। দুর্মূল্যও। ‘ব্যাকটেরিয়াল এন্ডোটক্সিন’ পাকড়াতে এদের রক্ত (লিমুলাস অ্যামিবোসাইট লাইসেট) ছাড়া গতি নেই। জালে ওঠার পর তাদের পরিণতিও অকাল মৃত্যু। গরমের দিনে উল্টে গেলে খুব তাড়াতাড়ি এদের ফুলকা শুকিয়ে গিয়ে অপমৃত্যু ঘটে। প্রাণীটিকে সোজা করেই দিলেই ঢেউয়ের দোলায় আবার সমুদ্রে ভেসে যেতে পারে! অফুরান সামুদ্রিক সম্পদের কি নিদারুণ মর্মন্তুদ অপচয়! এভাবেই পর্যটকদের বিপুল পদভারে অবলুপ্ত সিসিন্ডিলা, সাইলোমাস ও ডিপলোসিলা প্রজাতির ২৫টি কীটপতঙ্গও।
শুধু প্রাণীকুল নয়, বালিয়াড়ি থেকে চিরবিদায়ের পথে ইন্ডিগোফেরা, আইপোমিয়া, লিপ্পিয়া, ইভোভিউলাস, গ্লাইকসমিস, ক্যাসুয়ারিনাস, আলবিজিয়া, অ্যানাকারডিয়াম বা অ্যালোফাইলাসের মত গাছেরাও। সমুদ্রের ধারেকাছে আইপোমিয়া বা শক্ত কাষ্ঠল ঘন কেয়া গাছের ঝোপ কিছুদিন আগেও দেখা যেত। সমুদ্রের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলা বিশাল সুরম্য হোটেল নির্বংশ করেছে কেয়া গাছের বংশ। যশের মত ঘূর্ণিঝড়ের রাক্ষুসে প্রমত্ততার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারত কেয়া গাছের ঝোপ।
বহুবর্ষজীবী ঘাস ‘স্পিনিফেক্স’ বালিয়াড়ি থেকে পর্যটকদের পদচারণায় লুপ্ত। সৈকত থেকে মাত্র ২৫০ মিটার দূরে দীঘায় হোটেল, সৈকতের উপরেই বাঁশের দোতলা হর্ম্যে চলছে সুরাপান। বালিয়াড়ি সমতল করে তৈরি হচ্ছে হোটেল, কড়ি ফেললে ঘর থেকেই মিলবে উচ্ছ্বল সমুদ্রের বিলোল কটাক্ষ। হোটেল ও ভ্রমণার্থীদের প্লাস্টিক/মদের বোতলের বর্জ্যে সমুদ্র ‘কলুষিত ড্রেন’। সমুদ্রসৈকত গা-ঘিনঘিনে ডাস্টবিন।
হ্যালোসিন থেকে প্লেস্টোসিন যুগের মধ্যবর্তী সময়ে দীঘার জন্ম ও যৌবনপ্রাপ্তি। সমুদ্রতীরে বালি-কাদা-পলির গঠনে মেলে ফ্লুভিয়াটাইল ও ইয়োলিয়ান অধঃক্ষেপণ। দীঘা উপকুলের সৈকতে সূক্ষ্ম বালিকনার ভাগ ৬৭ শতাংশ, পলি ১৬.৪ শতাংশ, আর কাদা ৭.৬ শতাংশ। দীঘার ‘অলঙ্কারপুর’ অঞ্চলেই কেবল পলির ভাগ ৭৩ শতাংশ। বালিয়াড়ি ভাঙছে, ডাঙার দিকে প্রতি বছর বিপজ্জনক হারে ৬-১২ মিটার অগ্রসর হচ্ছে। ছোটো ঘাস ‘স্পিনিফেক্স’ এই আগ্রাসী অগ্রগমন রুখতে পারত। কিন্তু তা আর নেই। অদূর ভবিষ্যতে দীঘা-শঙ্করপুর-তাজপুরের বালির নীচে সমাধিস্থ হওয়াই নিয়তি।
দীঘা-শঙ্করপুর উপকূল মেসোটাইডাল। ঢেউয়ের সর্বাধিক উচ্চতা ২-৩ মিটার। আগস্ট মাসে ঢেউয়ের উচ্চতা ও প্রাবল্য দুইই বাড়ে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচদপ্তর ‘ইন্টিগ্রেটেড কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’ তৈরি করেছিল। সমুদ্রের জলতলের উচ্চতার ভীতিপ্রদ হারে বাড়ার ঘটনা সেই প্ল্যানে যথেষ্ট গুরুত্ব-সহকারে উল্লিখিত। সে প্ল্যান বেপাত্তা। সমুদ্রের জলতলের বার্ষিক উচ্চতা বৃদ্ধির হার ৩ মিমি। সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বাড়ছে বছরে ০.০১৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হারে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৃষ্টিপাত। ২০৫০ সালে সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা বেড়ে হতেই পারে ৫০ সেমি।
ভারতে গত ১২০ বছরে ‘সাইক্লোনিক অ্যাক্টিভিটি’ বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬ শতাংশ। বারেবারে সিডার-নার্গিস-বিজলি-আউলা-হুদহুদ-লায়লা-উম-পুন-যশের মতো বঙ্গোপসাগর জাত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত (১৯৭৮ থেকে ২০১৩)। ২০১৮-তেই প্রবল থেকে অতিপ্রবল ৭টা ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত দেশ। একটা যশের লেজের ঝাপটেই মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে যেতে পারে দীঘা উপকূল।
সমুদ্রের ভাঙনহারও অকল্পনীয় দীঘায়। ডাঙার দিকে এগিয়ে আসছে সমুদ্র। হারিয়ে যাচ্ছে সৈকতের স্বাভাবিক স্থিতিস্থাপকতা। পাল্টে যাচ্ছে ঢেউ ভাঙার রসায়ন। প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা দীঘার সৈকতে নিত্যনৈমিত্তিক। দীঘা উপকূলীয় অঞ্চলের ১৩ কিমি বিস্তৃত ন’টা মৌজা থেকে লোকজন ভয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করেছেন। দীঘার হোটেল/রিসর্টের সুরক্ষায় সরকারি তরফে ৪ কিমি ব্যাপী সমুদ্রের পাড় বাঁধানো হল। চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক সমুদ্র-প্রাকার নির্মাণের পর দেখা গেল, বালিয়াড়ির বিস্তার আরও প্রলম্বিত—বছরে ১৬-১৮ মিটার। ১৯৮০-তেও বালিয়াড়ি ১১ মিটারের বেশি ডাঙার দিকে পা বাড়ায়নি।
বোল্ডার ফেলে বৃথা চেষ্টা হচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ নিয়ন্ত্রণের। প্রচুর ছিদ্রযুক্ত ল্যাটেরাইটস, চার্নকাইটস বা অ্যাম্ফিবোলাইটস বোল্ডারের ক্ষমতা নেই ঢেউয়ের উন্মত্ততায় লাগাম পরানোর। বোল্ডারে ধাক্কা খাওয়ার পর ভীমপ্রলয়ী ঢেউ অন্তর্মুখী স্রোতে টুকরো করে ভেঙে ফেলছে বোল্ডারকে। সেই বোল্ডার সৈকত থেকে গড়াতে গড়াতে পাড়ি জমাচ্ছে সমুদ্রে। ভাঙা বোল্ডারের তলায় চাপা পড়ে বিলুপ্ত হতে বসেছে সৈকতের দ্বাররক্ষী সামুদ্রিক গেঁড়ি, গুগলি বা ঝিনুক জাতীয় প্রাণীরা। বেলাভূমিতে প্রমোদভ্রমণে পুলিসের চোখের সামনেই দিবারাত্রি চলছে বাইক বা চারচাকা, মোটরচালিত বিশাল নৌকাকে ডাঙা থেকে অহর্নিশ সমুদ্রে টেনে নিয়ে ফেলছে বিপুলকায় ট্রাক্টর। সৈকতের ভাঙন যেমন তাতে বাড়ছে, তেমনই ট্রাক্টর পিষ্ট লাল কাঁকড়া গুনছে অবলুপ্তির প্রহর।
বালিয়াড়ির ধারেই বিশাল গর্ত খুঁড়ে বসানো হচ্ছে গভীর নলকূপ, সমুদ্রের নোনা জলকে নির্বোধের মত ঘরের উঠোনে ডেকে আনা হচ্ছে। একফসলা কৃষিজমি বালিয়াড়ির তলায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, তারপর পানীয় জল লবণাক্ত হতে থাকলে সোনায় সোহাগা। অচিরেই পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হবে মনুষ্য প্রজাতি। বালিয়াড়ি ধ্বংস করে, উপকূল আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে হোটেল নির্মাণ, ধারণক্ষমতার বেশি পর্যটক আবাহন, সমুদ্রের জীবকুল সম্পর্কে পর্যটকদের সীমাহীন অজ্ঞতা-উদাসীনতা, নির্বিচারে বৃক্ষ-নিধন কেবলমাত্র সমুদ্রকেই আগ্রাসী করে তুলছে না, বাড়াচ্ছে সাইক্লোনের বিপর্যয়ের সম্ভাবনা। প্রকৃতি যে কোনও সময় টোকা মেরে দীঘাকে মানচিত্র থেকে মুছে দিতে পারে। বেওকুফ মানুষ কোন জাহান্নামে তখন ফুর্তির রসদ খুঁজবে?
লেখক প্রখ্যাত এক মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের জাতীয় সমুদ্র গবেষণা কেন্দ্রের তরফে দীঘা উপকূলীয় অঞ্চলে করা গবেষণা প্রকল্পটিতে নিযুক্ত ছিলেন