শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে কেন্দ্রের লেজেগোবরে অবস্থা। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও মোদিজির বিরুদ্ধে বিস্তর লেখালিখি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিজেপির সামনে ‘মুখরক্ষা’র একটা সুযোগ এনে দিয়েছিল ‘যশ’। প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের পর বাংলার জন্য বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করে কিছুটা ‘মানবিক’ হতে পারতেন। তাঁদের কর্মীরা বলতে পারতেন, বিপর্যয়ের সময় বিজেপি রাজনীতি করে না। তাঁরা এও বলতে পারতেন, হেরে গেলেও ‘সুনার বঙ্গাল’ গড়ার প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী ভোলেননি। কিন্তু বিজেপি ‘বিতর্ক সৃষ্টি’র রাজনীতিতেই আটকে থাকল। ফলে সেই সুযোগটাও হাতছাড়া হল।
একুশে বাংলার নির্বাচনে বিজেপির ‘জোড়া ফলা’র সামনে একা বুক চিতিয়ে লড়ে জয় ছিনিয়ে এনেছেন মমতা। তাতে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর গরিমা এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়েছে। লোকসভার ভোটের দেরি থাকলেও মোদি-বিরোধী সলতে পাকানো শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে সেই লড়াইয়ের মুখ মমতা। তাই মোদি-অমিত শাহ জুটি তাঁকে চাপে ফেলতে মরিয়া। অস্ত্র একটাই, বিতর্ক তৈরি। তারজন্য শিষ্টাচার, প্রোটোকল, বিপর্যয় মোকাবিলা আইন, সিবিআই- যা হোক একটা পেলেই হল।
বৈঠকে যোগ দিলে মুখ্যমন্ত্রীকে কথা বলতে দেওয়া হবে না, আবার না থাকলেও সমালোচনা। সমালোচনাতেই শেষ নয়, ‘অপছন্দে’র মুখ্যমন্ত্রীকে শায়েস্তা করতে মুখ্যসচিবকে বদলিও করা হল। হোক না তা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার দিন! তবুও তো ক্ষমতার আস্ফালন দেখানো গেল। ক্ষমতা দেখাতে না পারলে তার আর দাম কী! উঠতি মস্তানদের মধ্যে হাতের গুলি দেখিয়ে লোকজনকে চমকানোর একটা চল আছে। দিল্লির নেতারাও সেই রাস্তাই অনুসরণ করছেন। বারবার নাকখত খেলেও হাল ছাড়ছেন না। কারণ ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’ গানটাই গোঁত্তা খাওয়া বিজেপির ‘থিম সং’।
বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি বলে একটা কথা আছে। কিন্তু বিনাশপ্রাপ্ত হওয়ার চেয়ে কি ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা আরও ভয়ঙ্কর? বিজেপি নেতাদের কাজকর্ম দেখে সেই সন্দেহটাই তীব্র হচ্ছে। তা না হলে অসহায়দের সাহায্যের চেয়ে একজন অফিসারকে শায়েস্তা করা বড় হয় কী করে? মানুষের স্বার্থ অপেক্ষা যাঁদের কাছে ‘প্রোটোকল’, আইন, শিষ্টাচার বড় হয়, তাঁরা জনপ্রতিনিধি হলেও কিছুতেই জনদরদি হতে পারেন না।
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামোয় মোদিজি সমগ্র দেশের অভিভাবক। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে একজন আইএএসকে ‘শায়েস্তা’ করার শরিক হওয়াটা তাঁর জন্য বড়ই বেমানান। অনেকে বলছেন, আরএসএসের প্রাক্তন প্রচারক বুঝিয়ে দিলেন, তিনি আগে বিজেপি নেতা, তারপর প্রধানমন্ত্রী।
আলাপনবাবু প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে না থেকে অন্যায় করেছেন কি না, সেটা ওপরতলার বিচার্য বিষয়। আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খোঁজ রেখে লাভ নেই। তবে, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিবের বিরুদ্ধে এমন খড়্গহস্ত হওয়ার কারণ বোঝা যাচ্ছে।
বলাই বাহুল্য, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে একটি নামমাত্র। বিজেপির আসল টার্গেট মমতা। ২০১৪ সালে দেশের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই বঙ্গ দখল বিজেপির লক্ষ্য। তৃণমূলকে পরাজিত করার জন্য ২০১৬ সালে নারদ-কাণ্ডের ভিডিও প্রকাশের পর থেকে একের পর এক ‘ক্ষেপণাস্ত্র’ বিজেপি নিক্ষেপ করেছে। আর সেই সমস্ত আক্রমণ তৃণমূলনেত্রী বুক দিয়ে প্রতিহত করেছেন। ফলে সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। তাই তাঁকে জব্দ করাই বিজেপির ‘ধ্যানজ্ঞান’।
নোটবন্দি, জিএসটি থেকে এনআরসি, সিএএ-বিজেপির প্রতিটি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একজনই গর্জে উঠেছেন—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নোটবন্দির বিরুদ্ধে তিনি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছিলেন। বিজেপি তাঁকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য বলেছিল, তৃণমূল নেতাদের কালো টাকা সবচেয়ে বেশি। তাই প্রধানমন্ত্রীর ভালো কাজে ওদের এত গায়ের জ্বালা। কিন্তু, বাস্তবে কী দেখা গেল? নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন থেকে বিশ্বের তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদ মোদিজির নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে ‘ভুল’ বলে দাবি করেছেন।
করোনা মোকাবিলার নামে আচমকা দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছিলেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। বাংলাতেও তা নিয়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্ভোগের দায় রাজ্য সরকারের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করেছিলেন অমিতজি। বলেছিলেন, মমতার সরকার ট্রেন চায়নি বলেই এই দুর্ভোগ। বিজেপির সেই চেষ্টাও ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন মমতা।
করোনার প্রথম ঢেউয়ে গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যে যখন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছিল, তখনও পশ্চিমবঙ্গে মারণ ভাইরাস সেভাবে থাবা বসাতে পারেনি। মৃত ও আক্রান্তের বিচারে অনেকটাই ভালো জায়গায় ছিল বাংলা। বিজেপির সেটা সহ্য হয়নি। তাই কেন্দ্রীয় দল পাঠিয়েছিল মমতার রাজ্যে। উদ্দেশ্য, করোনায় মৃত ও আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা খুঁজে বের করা। ঠিক সেই সময় গুজরাতেও কেন্দ্রীয় টিম পাঠানো হয়েছিল। এইমসের প্রধানের নেতৃত্বে গিয়েছিল মেডিক্যাল টিম। উদ্দেশ্য, করোনার হাত থেকে গুজরাতবাসীকে রক্ষা করা। এ থেকেই বোঝা যায়, বাংলার মানুষের স্বার্থরক্ষায় বিজেপি নেতৃত্ব কত আন্তরিক!
করোনার গ্রাফ যখন ঊর্ধ্বমুখী, ঠিক তখনই সিবিআই রাজ্যের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করল। নির্দেশটা যে বিজেপি নেতাদের ছিল, তা বলাই বাহুল্য। উদ্দেশ্য, করোনা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাকে ঘেঁটে দেওয়া। বাংলার মানুষকে বিপদে ফেলা। কারণ বাংলা বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
প্রতিটি পদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সরকারকে অপদস্থ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। কারণ তিনিই দেশের একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী যিনি নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলেন। তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলতে পারেন, যত দিন ক্ষমতায় থাকব, বাংলায় এনআরসি, সিএএ করতে দেব না। সবাই নাগরিক। বিজেপির প্রতিটি ঘোষিত ও গোপন এজেন্ডার পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ান মমতা।
বিজেপির রাগটা এখানেই। মমতা যদি নবীন পট্টনায়কদের মতো বিজেপির তালে তাল মেলাতেন তাহলে কোনও সমস্যাই থাকত না। টি-টোয়েন্টি ম্যাচে দুর্বল ব্যাটসম্যানকে কোনও বুদ্ধিমান বোলারই আউট করতে চান না। কারণ প্রতিপক্ষের স্কোরবোর্ড থেমে থাকে। কিন্তু, চার, ছক্কা হাঁকানোর জন্য কাঁধে ব্যাট তুলে খেলাটাই মমতার স্টাইল। তাই তাঁকে ‘আউট’ করতে বিজেপি অলআউট লড়াইয়ে নেমেছিল।
বঙ্গ দখলের অভিপ্রায়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করাটা বিজেপির জন্য খাল কেটে কুমির ডেকে আনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোদি-অমিত শাহ বাংলা দখলের জন্য জীবন-মরণ পণ না করলে তাঁরা এই পরাজয়ের দায় অনায়াসেই বঙ্গ বিজেপির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু, সে রাস্তা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই বাংলার নির্বাচনের গুরুত্ব বাড়িয়েছেন। মোদি-অমিতের বাউন্সার মমতা কী করে সামলান, তা দেখার জন্য গোটা দেশ তাকিয়ে ছিল বাংলার দিকে। বল যে মাঠের বাইরে, তা আজ বলার অপেক্ষা রাখে না। মমতা ‘ম্যাচ উইনার’। তাই তিনিই এখন বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের ‘অটোমেটিক চয়েস’ লিডার। মমতা উত্তরাধিকার সূত্রে রাজত্ব পাননি, তিনি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। রেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্বও সামলেছেন। দিল্লির রাস্তাঘাটও তাঁর চেনা। বিজেপির ভয় সেখানেই।
২ মে’র আগে পর্যন্ত বিজেপির কাছে লড়াইটা ছিল দখলের, আর এখন গড় বাঁচানোর। কথায় আছে, ‘আক্রমণই আত্মরক্ষার সর্বোত্তম পথ।’ বিজেপি সেই রাস্তায় হাঁটছে। একের পর এক ইস্যু তৈরি করছে। তাই সিবিআই, ইডি, রাষ্ট্রপতি শাসন ইত্যাদি প্রভৃতি চলতেই থাকবে। কিছু না থাকলে, আছেন ‘ট্যুইটারবাবু’। খুঁচিয়ে ঘা করায় যাঁর জুড়ি মেলা ভার। বৃদ্ধ বয়সে কে আর চাকরি খোয়াতে চায়? তাই আলাপনেই শেষ নয়, ফের আসবে নতুন কোনও ইস্যু।