শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
সেলিব্রেটি থেকে রাজনীতিক হওয়ার চলটা শুরু হয়েছিল দক্ষিণ ভারতে। এব্যাপারে দু’জনের নাম প্রায় একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়। প্রথমজন তামিল ছবির জনপ্রিয় অভিনেতা এমজি রামচন্দ্রন, অন্যজন ‘তেলুগু সিনেমার ভগবান’ এনটি রামারাও। অভিনেতা থেকে ‘জনতার নেতা’। দু’জনই হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রামচন্দ্রনের ‘ভাবশিষ্যা’ জয়ললিতাও ছিলেন অভিনেত্রী। ‘গ্ল্যামার গার্ল’ থেকে ‘আম্মা’। সুদীর্ঘ এই যাত্রাপথের মাঝে ছ’ ছ’বার মুখ্যমন্ত্রী যেমন হয়েছেন, তেমনই বন্দি হয়েছেন কারাগারে। বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। সেলুলয়েডের পর্দা থেকেই এই বর্ণময় জীবনের অভিষেক ঘটেছিল।
তবে, ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন এনটিআর। সূচনালগ্নেই তাঁর প্রচারের অভিনবত্ব গোটা দেশকে আলোড়িত করেছিল। যে রথযাত্রার জোরে দেশজুড়ে বিজেপির উত্থান, তার পথপ্রদর্শক ছিলেন এনটিআর। সিনেমার জগৎ থেকে ১৯৮৩ সালে রাজনীতিতে পা রেখেই হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। অন্ধ্রপ্রদেশের প্রথম অকংগ্রেসি সরকার গঠনের কৃতিত্ব তাঁরই। তিন, তিনবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। তারপর থেকেই দেশজুড়ে ‘সেলিব্রেটি পলিটিশিয়ান’দের রমরমা। অমিতাভ বচ্চনের মতো ‘জীবন্ত কিংবদন্তি’ও সেই জুতোয় পা গলাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেলিব্রেটিদের প্রার্থী করায় বামেদের অনেকেই নাক সিঁটকাতে শুরু করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, দলের নেতা-কর্মীদের দাঁড় করালে হেরে যাবে বলেই সিনেমার নায়ক, নায়িকাদের দাঁড় করিয়েছে তৃণমূল। এতে নাকি তৃণমূল দলের হাঁড়ির হাল প্রকট হচ্ছে। অথচ এই বঙ্গে সেলিব্রেটিকে প্রার্থী করার পথ দেখিয়ে ছিল এই সিপিএমই।
কলকাতার চৌরঙ্গী আসনটি বরাবর দক্ষিণপন্থীদের। রাজ্যের ক্ষমতা দখলের পরেও একের পর এক নির্বাচনে বাম প্রার্থীরা হারছিলেন। ১৯৯৩ সালে এই কেন্দ্রের উপনির্বাচনে সেলিব্রেটি প্রার্থী দিয়েছিল সিপিএম। অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়কে বাম সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে জয় হাসিল করেছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও কলকাতার কাশীপুরে অভিনেতা অনুপ কুমারকে প্রার্থী করেছিল সিপিএম। কিন্তু অনুপবাবু জিততে পারেননি।
তাপস পালই ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রথম ‘সেলিব্রেটি প্রার্থী’। ২০০১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের চরম দুর্দিনে কলকাতার আলিপুর কেন্দ্রে ঘাসফুলের প্রার্থী হয়েছিলেন ‘দাদার কীর্তি’র নায়ক। জিতেও ছিলেন। তার পরের নির্বাচনে সিপিএম ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’র নীতি নিয়েছিল। তাপস পালের বিরুদ্ধে সিপিএমের প্রার্থী হয়েছিলেন অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু, সেবারও সিনেমার ‘নায়ক’ এর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন ‘খলনায়ক’। তারপর একে একে দেবশ্রী রায়, চিরজিৎ চক্রবর্তী, সন্ধ্যা রায়, মুনমুন সেন, শতাব্দী রায় সহ বহু সেলিব্রেটি তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কেরিয়ারের মধ্যগগনে বিরাজমান দেবকে প্রার্থী করে রাজ্যবাসীকে চমকে দিয়েছিলেন মমতা।
নির্বাচনে সেলুলয়েডের নায়ক, নায়িকাদের যে একটা আলাদা কদর আছে, তা বারেবারে প্রমাণিত। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে জনপ্রিয় নায়িকা শতাব্দী রায়কে প্রার্থী করাটা ছিল মমতার মাস্টারস্ট্রোক। বীরভূমের লাল কাঁকুড়ে মাটিতেও যে ঘাসফুলের চাষ সম্ভব, সেটা শতাব্দী প্রমাণ করেছিলেন। একই ফর্মুলায় ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাঁকুড়ায় অঘটন ঘটিয়েছিলেন সুচিত্রা-তনয়া মুনমুন সেন। বাসুদেব আচারিয়ার মতো পোড়খাওয়া সাংসদকে হারিয়ে দিয়েছিলেন বলতে গেলে রাজনীতির অআকখ না জানা মুনমুন সেন। গ্ল্যামার জগৎ যতই মেকি হোক না কেন, তার প্রতি মানুষের মোহ ছিল, আছে এবং থাকবে।
ভোটের পর প্রার্থীদের টিকি দেখা যায় না, এমন অভিযোগ শোনার জন্য কান পেতে অপেক্ষার প্রয়োজন হয় না। তারপর প্রার্থী যদি হন সেলিব্রেটি কিংবা বহিরাগত, তাহলে তো কথাই নেই। কারণ তাঁদের বেশিরভাগই হয়ে যান ‘ডুমুরের ফুল’। তার ফল ভোগ করতে হয় পরের নির্বাচনের প্রার্থীকে।
সাংসদ হিসেবে মুনমুন সেনের ভূমিকায় খুশি ছিলেন না বাঁকুড়ার মানুষ। তার জন্য সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে ভুগতে হয়েছিল। রুখাশুখা বাঁকুড়ায় ঘরে ঘরে জল পৌঁছে দিয়েও সেই ক্ষোভ দূর করতে পারেননি সুব্রতবাবু। তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। আবার মানুষের পাশে থাকলে যে চরম প্রতিকূলতার মধ্যে সেলিব্রেটিরাও হাসতে হাসতে বারবার জেতেন, তার প্রমাণ শতাব্দী রায়। প্রথমবার তিনি নায়িকা হিসেবে বাজিমাত করলেও জয়ের হ্যাটট্রিক এসেছে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার কারণে।
রাজ্যে ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকলেও বাম জমানায় বিনোদন জগৎ ছিল উপেক্ষিত। তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের মন্ত্রী ও পরবর্তী সময়ে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ‘সংস্কৃতি চর্চা’ ছিল নন্দন কেন্দ্রিক। সেখানে কিছু উন্নাসিক ও এলিট গোষ্ঠীর আধিপত্য সযত্নে লালিত পালিত হতো। তার বাইরে বুদ্ধদেববাবু বেরতে পারেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে টেলিউড থেকে টলিউড, সকলেই সুস্বাগতম। কলাকুশলীদের জন্য একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি শুধু শিল্পীদেরই গুরুত্ব দেন না, শিল্পটাকেও বাঁচিয়ে রাখতে চান। তাই তাঁকে ঘিরে শিল্পীদের ভিড় ও উচ্ছ্বাস, দুই-ই বেড়েছে।
নির্বাচনে হারলে ঘরে ঢুকে যাওয়াটাই প্রথা। তার মূলে কুঠারাঘাত করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। তাঁর নির্দেশে জয়ীদের পাশাপাশি পরাজিত তৃণমূল প্রার্থীরাও করোনায় মানুষের পাশে থাকছেন। সায়নী, সায়ন্তিকার প্রমাণ করতে চাইছেন, নির্বাচনে জয় পরাজয়টাই শেষ কথা নয়, মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার রক্ষাই পবিত্র কর্তব্য।
অনেকেই বলে থাকেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতদিন, তৃণমূল ততদিন। তারপর পার্টিটাই আর থাকবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার জবাবও দিয়েছেন। তিনি বহুবার বলেছেন, ‘যাঁরা ভাবছেন, আমি চলে গেলে দলটা উঠে যাবে, তাঁরা ভুল ভাবছেন। তৃণমূলের পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি।’ এতদিন তিনি যে কথা মুখে বলতেন, এবার সেটা করে দেখাচ্ছেন।
সিপিএমের এই করুণ পরিণতির কারণ কী? উত্তর একটাই, তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে না পারা। সিপিএম ‘বৃদ্ধতন্ত্রে’র বাইরে বেরতে পারল না। অসুস্থ না হলে সাধারণত কেউ পদ ছাড়তে চান না। ফলে ময়দানে নেমে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতা তৈরি হচ্ছে না। সঙ্কটটা এখানেই।
একুশের নির্বাচনে প্রবল আক্রমণের মুখেও সিনা উঁচু করে বিজেপি নেতাদের পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘ধমকে লাভ হবে না। যদি ক্ষমতা থাকে আমাকে গ্রেপ্তার করে দেখাক।’ বিজেপি পারেনি। আক্রমণকারী প্রবল পরাক্রমশালী হওয়া সত্ত্বেও অভিষেক ভয়ে কুঁকড়ে যাননি। উল্টে বিজেপি নেতাদের চোখে চোখ রেখে তাঁদের কীর্তি ফাঁস করে দিয়েছিলেন। বুনো ওল বাঘা তেঁতুলেই জব্দ হয়। তার পুরস্কার অভিষেক পেয়েছেন। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। ‘ভাইপো’ হিসেবে কোনও অনুগ্রহ বা অনুকম্পা নয়, এটা যুবনেতার যোগ্য নেতৃত্বের অর্জিত সম্মান।
সায়নী ঘোষ জিততে পারেননি। তবুও তাঁর লড়াই প্রতিটি লড়াকু মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। ঝড়ের সঙ্গে পাঙ্গা নিয়ে তাঁর প্রচার, আসানসোলের বস্তিতে খেটেখাওয়া মানুষকে বুকে টেনে নেওয়ার আন্তরিক ছবি ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সায়নীর লড়াই রবীন্দ্রনাথের ‘সবুজের অভিযান’ এর লাইনগুলিকে মনে করিয়ে দেয়, ‘রক্ত আলোয় মদে মাতাল ভোরে/ আজকে যে যা বলে বলুক তোরে/ সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ করে/ পুচ্ছটি তোর ঊর্ধ্বে তুলে নাচা/ আয় দূরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা’।
সায়নীর লড়াই প্রমাণ করেছে, তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া। মমতার জহুরির চোখের নজর এড়ায়নি তাঁর লড়াই। তাই ‘রিলের নায়িকা’কে ঠেলে দিয়েছেন ‘রিয়েল লাইফে’র লড়াইয়ে। উত্তরণের একটাই রাস্তা, লড়াই। মতি নন্দীর খিদ্দাও কোনিকে শিখিয়েছিলেন, ফাইট, ফাইট অ্যান্ড ফাইট।