শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহ বৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে ... বিশদ
নরেন্দ্র মোদির সবথেকে বড় সঙ্কট হল, তিনি বুঝতেই পারছেন না যে, তাঁর উপদেষ্টা অথবা পরামর্শদাতারা তাঁকে অত্যন্ত যত্ন সহকারে এবং একনিষ্ঠভাবে ভুল পথে চালিত করছে। কারণটা সহজ। ওই উপদেষ্টামণ্ডলী আসলে এই সরকারের দুই প্রধান চালিকাশক্তির ভাবগতিক বুঝে গিয়েছেন। তাঁরা জানেন যে, এই দু’জন ঠিক সরকার অথবা দেশ কীভাবে চলছে সেটা নিয়ে ভাবিত নন। তাঁদের প্রধান আনন্দ হল, আমাদের সবাই একটু ভয় ভয় পাচ্ছে তো? আমাদের নিয়ে সকলে অনিশ্চিত আশঙ্কায় ভুগছে তো? দৈনন্দিন দিনযাপনে আমাদের দেশবাসী ভুলে থাকছে না তো? সর্বদাই তাঁরা সংবাদের শিরোনামে থাকতে পছন্দ করেন। কোনও না কোনও ইস্যুতে তাঁদের নিয়ে সবর্ক্ষণ আলোচনা হোক, এটা তাঁরা এনজয় করেন। ঠিক এই কারণেই এই দু’জন ঠিক যেসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পছন্দ করবেন, সেগুলোই তাঁদের উপদেষ্টারা অথবা বিভিন্ন মন্ত্রকের অফিসাররা সুপারিশ করেন। তাঁদের একটাই লক্ষ্য থাকে। সেই সিদ্ধান্তগুলি যেন দেখতে বেশ সাহসী সাহসী হয়। ওগুলোর আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে কিনা সেটা উপেক্ষণীয়। আসল কথা হল, আগ্রাসী, কঠোর, প্রচণ্ড শক্ত মনোভাব, সাংঘাতিক কঠিন ব্যক্তিত্বপূর্ণ, এরকম একটা ফিলিংস আসছে কি না মানুষের মধ্যে! সেটা হলেই এই সরকার বেশ আত্মতুষ্ট হয়। সেই সিদ্ধান্তগুলি নিয়েই সবথেকে বেশি আগ্রহী তাঁরা, যেগুলি নিয়ে বেশ হইচই পড়ে যাবে। বিক্ষোভ হবে, আন্দোলন হবে, প্রতিবাদ হবে। এই যেমন ৩৭০, সিএএ, এনআরসি, নোটবাতিল। ১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি, তথ্য জানার অধিকার এরকম নিরীহ দেখতে সিদ্ধান্ত চালু করেছিলেন নিরীহ ও কম কথা বলা প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং। ওগুলো ভালো না মন্দ, সেটা ভারতবাসীই ঠিক করুক।
তাঁর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের আক্রমণাত্মক অবস্থানে আলাপনবাবু বাংলার একটি বৃহৎ অংশের সমর্থন ও সহানুভূতি পাচ্ছেন। এমনকী ভারতের আইএএস মহল প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। বঙ্গ বিজেপির কাছেও বিষয়টি কি খুব প্রীতিকর হচ্ছে? এসব বোঝা কিন্তু কোনও কঠিন ব্যাপার নয়। সমস্যা হল, যুক্তি আর ইগোর লড়াইয়ে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই ইগোর জয় হয়। বুদ্ধিমানদের ইগো থাকে না। থাকলেও কন্ট্রোল করতে জানে তারা। কারণ, বুদ্ধিমান হলে পরাজয়ের আভাস পাওয়া যায়। মাত্রাজ্ঞান ও যুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া যায়। পক্ষান্তরে বুদ্ধিমান হয়েও অতিরিক্ত ইগোসেন্ট্রিকদের ধারণা, তাঁরা অপরাজেয়। যাঁদের জীবনের ধ্রুবপদ শুধুই ‘আমাকে দেখুন’, তাঁদের পক্ষে এই সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব বোঝা সম্ভব নয়। তাঁরা চান, বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী। কিন্তু বুঝতে হয় যুদ্ধটা কার সঙ্গে? একজন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একজন রাজ্যের মুখ্যসচিবের। এই যুদ্ধে কার স্ট্যাটাস বাড়ে? কার কমে? আমরা তো প্রধানমন্ত্রীকে অনেক লার্জার দ্যান লাইফ এক বৃহৎ রাষ্ট্রনায়ক ভেবে এসেছিলাম এতদিন? এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর এতটা আগ্রাসী মনোভাব কি সেই বৃহৎ ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করছে না?
আমরা ২০১৪ সালের পর দেখেছিলাম নরেন্দ্র মোদির প্রধান প্রতিপক্ষের নাম কালো টাকা। আমরা তড়িঘড়ি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম। কারণ, আমাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল কালো টাকা বিদেশ থেকে নিয়ে এসে ১৫ লক্ষ টাকা করে প্রতিটি ভারতবাসীর অ্যাকাউন্টে দেওয়া হবে। সাত বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি! এরপর ২০১৬ সালে আমরা বুঝতে পারলাম নরেন্দ্র মোদির নতুন প্রতিপক্ষের নাম পুরনো টাকা। আমরা তৎক্ষণাৎ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে জলের বোতল, বিস্কুট নিয়ে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। অথচ টাকা বদলের পর দেখলাম লাভ তো দূরের কথা, অর্থনীতি আরও ডুবে গেল। ২০২০ সালে চীন হয়ে গেল নরেন্দ্র মোদির প্রতিপক্ষ। কারণ তারা আমাদের লাদাখে ঢুকে পড়েছে। আমরা চীনকে বয়কটের ডাক দিলাম। ২০২১ সালে অক্সিজেনের লাইনে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম, চীন আমাদের অক্সিজেন কনসেনট্রেটর পাঠাচ্ছে।
নরেন্দ্র মোদির সবথেকে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ আসলে কে? একটি গল্প শুনলে বোঝা যাবে। বিহারের আরারিয়া জেলার রানিগঞ্জ ব্লকের বিষ্ণুপুর পঞ্চায়েতের সোনি কুমারী ১৮ বছরের এক তরুণী। ১২ বছরের বোন আর ১৪ বছরের ভাইকে নিয়ে এই কিছুদিন আগে সে সম্পূর্ণ অনাথ হয়ে গেল। প্রথমে বাবা মারা গেলেন কোভিডে। তারপর মা। বাবার চিকিৎসা করাতে দু’টি ছাগল বিক্রি করতে হয়েছিল। ১১ হাজার টাকায়। মায়েরও কোভিড হল। গুরুতর। রানিগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি। চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার। এবার একমাত্র সম্পত্তি গোরুও বিক্রি করতে হল। ১০ হাজার টাকায়। কিন্তু মায়ের চিকিৎসা শেষ হওয়ার আগেই ফুরিয়ে গেল সব টাকা। তাই এই তিন ভাইবোন বাধ্য হয়ে বাড়িতে মাকে নিয়ে এল। স্বাভাবিকভাবেই অর্ধেক চিকিৎসায় মা সুস্থ হলেন না। মারা গেলেন। এই তিন ভাইবোনের আপাতত কোনও আয় নেই। ঋণের টাকা শোধ করতে হবে। দু’বেলা খাবার সংস্থান করতে হবে। বিহার সরকার এককালীন কিছু টাকা দিয়েছে সহায়তা হিসেবে। কিন্তু সেই টাকা কতদিন? তারপর কী হবে? অতএব পাটনা থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রামের তিনটি ভাইবোন চরম সঙ্কটে।
ভারতের উজ্জ্বলতার পথে প্রধান প্রতিপক্ষ আসলে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এরকম অসংখ্য কাহিনি! তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নয়, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় নয়, বিরোধী দল নয়, অনুগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রী এই কাহিনিগুলিকে তাঁর প্রকৃত প্রতিপক্ষ বিবেচনা করুন। ৮০ কোটি মানুষের চরম দারিদ্র, একটি ভয়ঙ্কর মারণরোগ এবং স্বাধীনতার পর এই প্রথম মাইনাস সেভেন পয়েন্ট থ্রি পারসেন্টের আর্থিক মন্দা, এই তিন শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করুন! তাহলেই কিন্তু আপনি চিরস্থায়ী জয়ী হবেন। জগৎসভায় জয়ী হবে ভারতও!