সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
২১
তখন কলেজ কাল। একটু-একটু করে এ শহরের এদিক, ওদিক করার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছি। না নিয়ে উপায় কী! আমি কোনওদিনই ঘরমুখো, বইমুখো ভালো মেয়ে ছিলাম না। সারা শহর জুড়ে আমার বন্ধুরা। আর সারাদিন জুড়ে শীতের রোদের মতো বন্ধুত্বের ওম্। এক-একজনের কাছে এক-একরকম প্রয়োজন। এক-একরকম অঙ্গীকার। সেই বয়সের প্রয়োজন মানে আসলে তো শালিকের মতো রোদ খুঁটে খাওয়া। আর অপ্রয়োজনে কিচিরমিচির করা। এখন ফিরে তাকালে মনে হয় মেঘ না করলে বুঝতেই পারতাম না এত রোদ ছিল জীবনে ।
সেই কলেজবেলায় আমার একটি অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। হাতে সময় থাকলেই আমি নির্দিষ্ট গন্তব্যের দু’স্টপ আগে বাস থেকে নেমে পড়তাম। তারপর হাঁটতাম। ওই হাঁটাটা আসলে ছিল আমার নিজস্ব অন্তর-বাহিরকে এক করে নেওয়ার চেষ্টা। কত লোক, কত চরিত্র, কত ভঙ্গিমাকে মনের মধ্যে টুকে নেওয়া। এই দেখার মধ্যে আমার কেমন নেশা ধরে গিয়েছিল। এর ফলে প্রায়শই বাবা-মাকে আত্মীয়-বন্ধুরা বলতেন, ‘সন্ধেবেলা ওইখানে তোমার মেয়ে...’ আত্মীয়- স্বজন প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি আঁশটে গন্ধ খোঁজেন। কাজেই আমার মা- বাবা ওসব বিশেষ ধর্তব্যের মধ্যে নিতেন না। আমিও বিন্দাস ঘুরে বেড়াতাম সারা শহরময়। একদিন তো কলেজেই ঠিক করে সেই রাত্তিরেই রাঁচি রওনা হলাম। বন্ধুর দিদির বাড়ি। সেইসময় টেলিফোন অত সহজলভ্য ছিল না। বৃষ্টি মাথায় করে ছুটলাম ডালহৌসি। বাবার অফিস। পারমিশন নিতে হবে। পেয়েও গেলাম। এখনকার বাবা-মায়েরা এসব ভাবতেই পারেন না। ভাবেন বখে যাবে। ছেলেমেয়েদের সোনার শিকলে বেঁধে রাখেন। আরে বখে যেতে গেলে মস্তিষ্কের একটি বিশেষ প্যাটার্ন লাগে। দমও লাগে। প্রতিভাও লাগে। আমাদের মতো ডাল, ভাত খাওয়া বাঙালি মধ্যবিত্তের বেশিরভাগেরই সে সাহস ছিল না। দিনশেষে বেশিরভাগেরই ‘বাবার হোটেল’টা খুব নিশ্চিন্ত জায়গা ছিল।
এই এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো আমাকে অনেককিছু দিয়েছে। জীবনের প্রতিটি পরতের রং আমাকে চুবিয়ে দিয়েছে। সে পড়ন্ত বিকেলের একা হয়ে যাওয়ার রংই হোক অথবা বন্ধুত্বের, ভালোবাসার দুধে-আলতাই হোক। আমি ডুবে ছিলাম। ডুবুরির মতো। ডুবুরি যেমন ডুব দেয় মুক্তোর খোঁজে। নিজের ভেতরে এক অনন্ত মনোলগ চলত। একবার তারাতলা থেকে বাস ধরে একা, একা চলে গিয়েছিলাম বজবজ। গঙ্গার ধারে। আমার এক বন্ধুর মারফত শুনেছিলাম গঙ্গার ধারটি নাকি স্বর্গীয়। শহরের মধ্যেই শহরের ইটকাঠ ভুলে থাকার এক অবিস্মরণীয় ভুবন। খুব দেখার সাধ হল। বাস থেকে নেমে ভ্যানরিকশ চেপে যখন গঙ্গার ধারে পৌঁছলাম। আহা! তখন পৃথিবীটা এতটা কালো ছিল না। এত অভাব, হিংসে, অকারণ ব্যক্তিজীবনে উঁকিঝুকি ছিল না। কাজেই আমাদের ছেলেবেলায় হাত বাড়ালেই নরম মোমের মতো উষ্ণ ভালোবাসাও ছিল। এইসব মুক্তোর খোঁজেই আমার মুক্তি ছিল। তখন সময়ও মনে হতো অফুরন্ত। সহজে ফুরোবে না। এখনকার মতো কৃপণ হয়ে যায়নি। সবসময় পালাই, পালাই ভাব।
তা একবার হয়েছে কী! আমার ইস্কুলের বন্ধুর বিয়ে। বন্ধুদের বিয়ে শুরু হওয়ার প্রাক্কালে ওই বিয়ে। স্বভাবতই উত্তেজনা একটু বেশি। তার উপর কচি বয়স। বন্ধুর বিয়ে নিয়ে অনাবশ্যক গুজগুজ, ফুসফুস। পরমা শুধু আমার স্কুলেরই বন্ধু নয়। পাড়ারও মেয়ে। সেহেতু নেমতন্ন কবে আসবে ভাবছি। ওমা! সব বন্ধুদের নিমন্ত্রণ হয়ে গেল। আজ পরমার ‘আই বুড়ো ভাত’। বাবা, মাও যারপরনাই বিস্মিত। অপমানিত। আমাকে মা চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঝগড়া করেছিলি নাকি?’ আমি বললাম, ‘না। একবার আমি, স্বর্ণালী, ঈশিতা মিলে গরমের ছুটিতে ফিস্টের জন্য দশ টাকা চাঁদা চাইতে গিয়েছিলাম। অনেকদিন ঘোরানোর পর পরমা বলেছিল, চেক দিলে হবে? তখন হেব্বি মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। বলেছিলাম, দিবি না বললেই হতো!’ মা কী বুঝলেন জানি না। আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য সারদা মায়ের মতো বলেছিলেন, ‘এসব মনে রাখতে নেই। তাহলে জীবনের চলার পথটা ছোট হয়ে যায়।’ মায়ের কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল, মনে হয়তো রাখব না। কারণ পরমা আমার সেরকম প্রাণের বন্ধু কেউ নয়। কিন্তু ওই বয়সে অভিজ্ঞতা কম। তাই ছোট, ছোট ঘটনাই খুব মনে লাগে আর কী! কী আর করা! একটা বন্ধুর কাছে যদি অপ্রত্যাশিত হই। দশটা বন্ধুর কাছে আমার অবারিত দ্বার। আজও। তবু ওই বয়সের মায়া! বন্ধুদের দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ সবই যেন মনে হতো এর চেয়ে সর্বোত্তম আর কিছু নেই। জীবনের কাছে, যাপনের কাছে এর চেয়ে স্বাদু আর কিছু ছিল না তখন। এখনও নেই। যদিও পরতে, পরতে রং বদলে গিয়েছে। আরও দায়, দায়িত্ব, কর্তব্য, সমাজ মান্যতা প্রয়োজন মতো আমাদের মস্তিষ্কের এক-একটি কম্পার্টমেন্টে বসিয়ে নিতে হয়েছে সুবিধা মতো। তখন প্রয়োজনটাই বড় ছিল। সুবিধার মধ্যে কেমন একটা পচা, স্বার্থের গন্ধ ছিল।
আজ পরমার বিয়ে। ওই তো তারাতলার ‘টবের বাড়িতে’। বন্ধুরা সবাই অবাক। এরকম করতে পারল! তখন বিকেল। পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটা। বাড়ি ফিরছি। আমার স্বভাব মতো দু’স্টপ আগে নেমেও পরেছি। যেতে, যেতে রাস্তায় টবের বাড়ি। লোকজনের ব্যস্ততা। গেট সাজানো চলছে। হঠাৎ মাথায় কী ভূত চাপল। সটান ঢুকে পড়লাম। ভাগ্যিস বিয়েবাড়িতে গেটপাস হয় না। গিয়ে একতলার একটি ঘরে দেখলাম পরমাকে ওর আত্মীয়-স্বজন সাজাচ্ছেন। পরমা একটা লাল ভেলভেট দেওয়া ডেকরেটার্সদের বোকা, বোকা চেয়ারে বসে আছে। আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। আমি কোনও কথা না বলে ওর রুজ, পাউডার মাখা গালে একটা আঙুল ছুঁয়ে বললাম, ‘যা! এসব কেউ মাখে!’ ব্যস! তারপরে পরের রাস্তাটা যেন উড়তে, উড়তে গেলাম। এত্ত স্যাটিস হল। কী বলব।
এই গল্পটা শুনে আমার বন্ধুরা হেসে খুন। আমারও সেই বয়সের সব অভিমান, অপমান হেমন্তের আকাশে মিলিয়ে গিয়েছিল।