সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
ঘটনাটা আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের। তখন যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি। নির্ভরতা ছিল ভারতীয় ডাক ব্যবস্থার ওপর। সাধারণ মানুষের মধ্যে খবর আদান-প্রদানে ছিল একমাত্র অশোকস্তম্ভ ছাপ মারা পোস্টকার্ড। এই নিয়ে কত যে গল্প আছে। অতদিন আগে গ্রামগঞ্জ কিংবা আধা শহরে অক্ষর পরিচয় হওয়া মানুষের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল নিশিকান্ত কাকার বাড়ি। বাঁকুড়ার গ্রাম থেকে এই শহরে এসেছিল চটকলে কাজ করতে। নিরক্ষর মানুষ। বাঁকুড়ায় বড় একটা যাওয়াও হতো না। মাঝে মাঝে গ্রাম থেকে চিঠি আসত। সেই চিঠি আবার আমাকেই পড়ে শোনাতে হতো। গ্রামের একমাত্র স্কুলের একমাত্র শিক্ষককে দিয়ে লেখানো চিঠি, মায়ের জবানিতে...
‘পরম কল্যাণীয় বাবা নিশিকান্ত। অনেকদিন তোমার কোন খবর নেই। আশা করি ঈশ্বরেচ্ছায় তুমি কুশলে আছো। এ বছর উত্তর মাঠে ধান ভালো হইয়াছে। এবার পূজায় অবশ্য অবশ্য এক মাসের ছুটি লইয়া আসিবে। পত্র পাঠ মাত্র উত্তর দিবে...’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
চিঠির জবাবটি নিশিকান্ত কাকার জবানিতে আমাকেই লিখতে হতো। কিন্তু ‘এবার পুজোয় তার বাড়িতে না যেতে পারার কষ্ট, মাকে বোনকে বহুদিন দেখা হয় নাই বলিয়া মন খারাপ—এইসব আমাকেই লিখে পাঠাতে হতো বাঁকুড়ায়। নিশিকান্ত কাকা হয়ে আমি তার মাকে শতকোটি প্রণাম জানাতাম।
সেসব দিনে পোস্ট কার্ডে এমন কত যে কথার আদান-প্রদান হতো। বুক ভরা আশীর্বাদ, শতকোটি প্রণাম, স্বজনের মৃত্যু সংবাদ, বুধির একটা নৈ বাছুর হওয়ার খবর— এরকম কত মন কেমন করা স্মৃতি সকলেরই কমবেশি জমা হয়ে আছে মনে। এর সঙ্গে কিছু মজার স্মৃতি নেই যে তা নয়।
সব সময় চিঠি লেখার জন্য যে প্রাথমিক ইস্কুলের শিক্ষক পাওয়া যেত তা নয়। তেমন তেমন সময় অনেক ক্ষেত্রে চিঠির বিষয়বস্তু উদ্ধার করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হতো। এই প্রসঙ্গে হস্তাক্ষর নিয়ে কিছু বলার কথা মাথায় আসে। ভালো হস্তাক্ষরের কদর চিরকালই বেশি। আবার ভালো সুছাঁদ লেখা পাওয়াই ছিল বেশ দুষ্কর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যেত দুর্বোধ্য হস্তাক্ষর। সেসব লেখার মর্মোদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব হতো। আসলে তখন লেখালেখির ঢল ছিল না বললেই চলে। আলেকালে এক-আধখানা পোস্টকার্ড— তার ফলে হতো কী, চর্চা না থাকার ফলে সে লেখায় না থাকত ছিরি না থাকত ছাঁদ। মর্মোদ্ধার করার জন্য পত্র প্রাপকের উদ্ভাবনী শক্তির খুব দরকার হতো। এমন কালপর্বেই একটি ঘটনা।
আমার মা ছিলেন চিররুগ্ন। বড় একটা বাড়ি থেকে বেরবার সুযোগ হতো না। একবার প্রায় জোর করেই মেয়ের বাড়ি ক’টা দিনের জন্য গিয়েছিলেন। জায়গাটা খুব বেশি দূরে নয়। চন্দননগর থেকে বাঁশবেড়িয়া। দূরত্ব মোটে দশ-এগারো মাইল। ঘটনার শুরু সেখানেই। দিদির দেওর মহাদেবদা বেশ করিৎকর্মা মানুষ। বাঁশবেড়িয়া জুটমিলে মিল মেকানিক ডিপার্টমেন্ট মিস্ত্রি। আট ঘণ্টার বাঁধা কাজ। বাকি সময়ে তিনি একজন তান্ত্রিক। এই কাজে তাঁর বেশ নামডাক তখন। সেই কাজ পাকাপোক্ত করতেই বাড়িতে মন্দির করে শুরু করেছিলেন কালীপুজো। ভয়ের সঙ্গে ভক্তির মিশেলে মহাদেব মানুষটি তখন এলাকায় বেশ বিখ্যাত। হস্তরেখা বিচার, বশীকরণ, বাস্তুদোষ কাটানো ছাড়াও দুরারোগ্য ব্যাধিতে জড়ি-বুটি, তাগা-তাবিজ এমনকী রত্ন শুদ্ধি করে ধারণ করার নিদান দিতেন। এমন একজন নিকট আত্মীয় বাড়িতে থাকতে বিনা চিকিৎসায় মা কষ্ট পাবেন তা কী করে হয়।
সব শুনে-টুনে মহাদেবদা দুটি শুকনো লঙ্কা মায়ের হাতে দিয়ে বলেছিলেন। সামনের অমাবস্যার রাতে এই লঙ্কা দুটো পোড়াবেন। তারপর তার গন্ধ পেলেন কি না সেটা সঙ্গে সঙ্গে চিঠিতে জানাবেন।
এই পর্যন্ত ছিল ঘটনা। এরপর যেটা হয়েছিল সেটা দুর্ঘটনা। চারদিন বাদেই ছিল অমাবস্যা। ওই চারটে দিন বেশ উত্তেজনায় কেটেছিল আমাদের। লঙ্কা পোড়ার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে হাঁচি, কাশি, চোখে জল আসার ঘটনা স্বাভাবিক। চারদিন বাদে এই স্বাভাবিক ঘটনাটাই ঘটেছিল। অলৌকিক কিছু হয়নি। মা লঙ্কা পোড়ার গন্ধ পেলেন। ব্যাপারটা এত স্বাভাবিক, উত্তেজনা যেটা ছিল সেটাও থিতিয়ে গেল। তাই চিঠি দেওয়ার কথা ভুলে গেল সবাই। বেশ কিছুদিন বাদে এক দুপুরে কথাটা মনে পড়েছিল মায়ের। মহাদেবকে কথাটা জানানো হয়নি।
দুপুরবেলা আমরা সকলেই কাজেকর্মে। ছোটরা স্কুল-কলেজে আর বড়রা অফিস বা অন্য কাজে বাড়ির বাইরে। তখনই মনে পড়েছিল হরেনদাকে। মানুষটি কাজে কর্মে বেশ চৌখস। হাতে ফর্দ ধরিয়ে দিলে ঠিক ঠিক মুদিখানা চলে আসত বাড়িতে। অবেলায় কুটুম এসেছে এদিকে ঘরে মাছ নেই। তখন অগতির গতি ছিল হরেনদা। এহেন মানুষটিকে দিয়ে পাড়ার মা-মাসিরা চিঠিও লেখাত। হরেনদা না বলতেন না। তবে একটাই অসুবিধা হরেনদার হাতের লেখা। হস্তাক্ষর ছিল এমন বিখ্যাত যে তার মর্মোদ্ধার করার জন্য হরেনদাকেই প্রয়োজন হতো।
এদিকে পল্লির মা, মাসিরা সেদিন ছিলেন প্রায় অসহায়। এমন একটা কাজ স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের মোটেই পছন্দের নয়। কাজের মানুষদের আরও ব্যস্ততা। অতএব তখন নিরুপায় হয়ে অগতির গতি ছিল হরেনদাই। অনেক চিঠির লেখার অভিজ্ঞতায় হয়েছিল কী সূচনা আর উপসংহার মুখস্থ ছিল তার। শুধু মধ্যপর্বে লেখার ছিল মূল কথা। তো সেখানে হরেনদা লিখলেন, ‘মা গন্ধ পাইয়াছে।’
এরপর চ্যাপ্টার ক্লোজ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি। দিন দশেক বাদে বেলা আটটা নাগাদ অফিস বেরচ্ছি সাইকেলে। দূর থেকে দেখি হন্তদন্ত হয়ে বড়দি আসছে। কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত চেহারা, চোখের কোল যেন ভিজে। সাইকেল থেকে নেমে অবাক গলায় বললাম, কী খবর বড়দি! সব ভালো তো?
জবাব না দিয়ে বড়দি বলল, ‘তোরা কেমন আছিস।’ আমরা ভালো আছি। ঠিক আছে বাড়ি যাও। সন্ধ্যায় ফিরে কথা হবে! ট্রেন ধরতে হবে তাই আবার সাইকেলে উঠে পড়েছি। কিন্তু মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা দ্বিধা।
সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে অবাক। সকাল থেকে শুরু হওয়া হাসির রেশ তখনও কাটেনি। আমাকে দেখে সেটা যেন আবার উথলে উঠল। তখনই জানা গেল হরেনদার লেখা পোস্টকার্ডে এবার মিসটেকটা ‘সিলি’ নয় ‘মেজর’। চিঠিতে ‘গন্ধ’ শব্দটি হরেনদার হস্তাক্ষরের দৌলতে গঙ্গা হয়ে গেছে। তার ফলে লেখা হয়েছে, ‘মা গঙ্গা পাইয়াছে।’