সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
সিইএ ব্যাপারটিকে ‘আন্ডার হিটিং’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তার অর্থ চাহিদা উধাও হয়ে গিয়েছে এবং সরকারের তথাকথিত স্টিমুলাস প্যাকেজগুলিও (যা নগণ্য ও দিশাহীন) অন্তত চাহিদা বাড়িয়ে পূর্বের জায়গায় নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছে। চাহিদা পরিমাপের একটি ভালো দিক হল তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলির প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর। শক্তিমন্ত্রীর মতে, ২০২০-২১ সালে এটি মাত্র ৫৬.৫ শতাংশ স্পর্শ করবে। ‘আন্ডার হিটিং’ সত্ত্বেও মূল্য সূচকের পরিবর্তন (রিটেল ইনফ্লেশন) ৭.৬১ শতাংশে পৌঁছেছিল এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের পাইকারি মূল্য সূচক (ফুড ইনফ্লেশন) বেড়ে হয়েছিল ১১.০৭ শতাংশ, যার ফলে গরিব মানুষের ঘাড়ে ভয়ানক আর্থিক বোঝা চেপে গিয়েছিল।
চ্যালেঞ্জের মুখে চাকরি
কৃষি হল আশার আলো। ২০২০-তে রবি শস্যের ব্যাপক ফলন হয়েছে। খাদ্যশস্য উঠেছে ১৪৮ মিলিয়ন টন। এবছর খারিফ শস্যও ফলেছে প্রচুর—১৪৪ মিলিয়ন টন। এবছর ট্রাক্টরের বিক্রি বেড়েছে ৯ শতাংশ। ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস কোম্পানিজ (এফএমসিজি) অনুসারে জানানো যায় যে, শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে চাহিদা ভালো রয়েছে। তবু গ্রামাঞ্চলে মজুরি হার বৃদ্ধির কোনও লক্ষণ নেই।
সুতরাং অর্থনীতির ছবিটা যা দেখা যাচ্ছে তা ভালো-মন্দ মিশিয়ে। তার মধ্যে ভালোর চেয়ে খারাপটাই বেশি। বৃহত্তর দিক থেকে অর্থনীতির মূল্যায়নে বিকৃতি কিন্তু কাম্য নয়। সার্বিক দিক থেকে অর্থনীতির হাল খারাপ। নীতি নির্ধারণে দিশার অভাব রয়েছে। অর্থনীতির হাল ফেরানোর ব্যাপারে যেসব দাবি করা হচ্ছে, সোজা কথায়, তা অতিরঞ্জিত। মূল দু’টি লক্ষণ হল—মানুষের চাকরি এবং মজুরি/আয়ের হালচাল কী।
সরকারি পরিসংখ্যান যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ সিএমআইই-র তথ্যের উপরেই নজর রাখতে হচ্ছে। সিএমআইই-র হিসেবে, হালফিল বেকারত্বের হার হল ৬.৬৮ শতাংশ। একই সঙ্গে দেখে নেওয়া যাক ‘লেবার পার্টিসিপেশন রেট’ (১৬-৬৪ বছরের ভিতরে যাঁরা তাঁদেরকে কর্মক্ষম জনসংখ্যার মধ্যে ধরা হয়। এই জনসংখ্যার প্রতি ১০০ জনের মধ্যে যাঁরা চাকরি করছেন বা চাকরি খুঁজছেন তাঁদেরকে ধরা হয় এলপিআর) কেমন? মাত্র ৪১ শতাংশ, যা হতাশ করে। আর ফিমেল লেবার পার্টিসিপেশন রেট আরও হতাশাজনক—২৫ শতাংশ। প্রতি ১০০ জন চাকুরের মধ্যে মহিলা মাত্র ১১ জন। কিন্তু কাজ হারানো প্রতি ১১ জনের মধ্যে ৪ জন হলেন নারী। সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২০-র মধ্যে ভারতের ১১-১২ মিলিয়ন মানুষ লেবার ফোর্স থেকে ছিটকে গিয়েছেন।
ধনীদের প্রতি পক্ষপাত
অর্থনীতির ‘আন্ডার-হিটিং’ পরিস্থিতি ‘ওভার-হিটিং’-এর মতোই খারাপ। যখন ওভার-হিটিং ঘটে তখন ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। সুদের হার বেড়ে যায়। তাতে চাহিদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিল্প-বাণিজ্য সংস্থাগুলো উৎপাদন বাড়াতে আগ্রহী হয়। এইসময় যদি বাজারগুলো ঠিকঠাক চলে এবং সংশোধনের উপায়গুলো নেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ‘আন্ডার হিটিং’ ভারতের সামনে একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। এটা এমন একটা বিষয়, যেটা মোকাবিলা করার পক্ষে মোদি সরকারকে অক্ষম বলেই মনে হয়। তার কারণ এই সরকারের গরিবদের পাশে দাঁড়ানোর থেকে কর্পোরেটদের লাই দেওয়ার ঝোঁকটা বেশি। এই প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দিতে পারি যে, কর ছাড়ের নামে কর্পোরেটদেরকে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকার ‘বোনানজা’ দেওয়া হয়েছে। অথচ এই টাকাটা গরিবদের বিনামূল্যে রেশনের জন্য খরচ করা উচিত ছিল, অথবা তাঁদের মধ্যে ক্যাশ ট্রান্সফার বা নগদ হস্তান্তর করা যেত। কর্পোরেটরা এই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা দিয়ে তাদের ধারদেনা মিটিয়েছে এবং ‘ক্যাশ হোল্ডিং’টাকে মজবুত করে নিয়েছে। তারা এর দরুন নতুন কোনও বিনিয়োগ করেনি। কিন্তু টাকা পেলে গরিব মানুষগুলোকে অনাহারের জ্বালা সইতে হতো না—তিন মাস যাবৎ প্রতি সপ্তাহের কয়েক দিন করে তাদের যে কষ্টটা করতে হয়েছিল। এই টাকা পেলে তারা খাবার, দুধ, ওষুধ এবং অন্যকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস এবং পরিষেবা কিনতে পারত। তাতে করে সামগ্রিকভাবে চাহিদা অনেকটা বেড়ে যেত।
কারেন্ট অ্যাকাউন্টে সারপ্লাস ঘটার কারণ রপ্তানির অঙ্কটা আমদানিকে ছাপিয়ে গিয়েছে, যদিও ওই দু’টোই অতীতের মানদণ্ডে কমই। বাণিজ্য হ্রাসের ফল, কারেন্ট অ্যাকাউন্টে উদ্বৃত্ত এবং টাকা দামি হয়ে যাওয়ার (অ্যাপ্রিসিয়েটিং রুপি, অর্থাৎ মার্কিন ডলার কিনতে আগের চেয়ে কম পরিমাণ ভারতীয় মুদ্রার প্রয়োজন হলে) পরিণাম অর্থনীতির পক্ষে ভয়ানক হতে পারে। এই ঘটনার প্রধান বলি হয় চাকরি বা কাজের বাজার। এতে যে অদৃশ্য ‘ম্যাক্রো ইকনমিক এফেক্ট’ ঘটবে তার ফলে ভারতের সামান্য পুঁজিটাও বিদেশে লগ্নি হয়ে যাবে। ভাবুন কী ভয়ানক ব্যাপার—পুঁজি জোগাড়ের জন্য মরিয়া একটি উন্নয়নশীল দেশই, অন্য দেশে লগ্নির জন্য পুঁজি রপ্তানি করছে! এর ফলে, আমেরিকার ব্যবসায়ীরা অবশ্যই অতি সহজে প্রয়োজনীয় টাকা পেয়ে যাবে।
আত্মনির্ভরতা অথবা অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা
আমার গভীর বিশ্বাস যে ‘আত্মনির্ভর’-এর মস্তিষ্করা এই ধরনের ফলাফলের কথা ভাবেননি। যদি আত্মনির্ভর মানে হয় আত্মনির্ভরতার একটি মাত্রা, আমরা অবশ্যই সেটাকে স্বাগত জানাব। কিন্তু, পলিসি এবং প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে আত্মনির্ভর-এর অর্থ যদি হয় প্রোটেকশনইজম বা সংরক্ষণবাদ, মুক্ত বাণিজ্যের বিরুদ্ধাচারণ, উচ্চ হারে বাণিজ্য শুল্ক, অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতার নীতিগ্রহণ এবং লাইসেন্সপ্রথা, নিয়ন্ত্রণ, সালিশি ও বিবেচনার কানুন ফিরিয়ে আনা—তাহলে নিশ্চিতরূপে বিপর্যয় ডেকে আনা হবে। আমি আশা করব যে মোদিজি ট্রাম্পের থেকে বড় ট্রাম্প হবেন না।
আমরা আজ এক অবাক পৃথিবীতে বাস করছি। এখানে কমিউনিস্ট চীনের প্রেসিডেন্ট মুক্ত বাণিজ্য ও বিশ্বায়নের পক্ষে উদ্বাহু হয়ে কীর্তন করছেন। অন্যদিকে, ধনতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাণিজ্য চুক্তি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লুটিও), মুক্ত বাণিজ্য, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং প্যারিস চুক্তি নিয়ে তির্যক ভাষায় কথা বলছেন! পৃথিবীটাতে কি উলট-পুরাণে প্রবেশ করল?
অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রাজ কৃষ্ণ যেটাকে ‘হিন্দু রেট অফ গ্রোথ’ নাম দিয়েছিলেন তা থেকে বেরিয়ে আসতে ভারত তিরিশ বছর সময় নিয়েছিল। যদিও আমি মনে করি, প্রাচীন চোল এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের হিন্দু রাজারা ছিলেন অনেক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, বহির্বিশ্বের দিকে তাকাতেন তাঁরা এবং তাঁরা চীন, ইন্দোনেশিয়া ও রোম পর্যন্ত অর্থনীতির বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন সত্যিকার বিশ্বায়নবাদী। তাঁদের আমলে বিশ্বের মোট উৎপাদনের (ওয়ার্ল্ড’স জিডিপি) ২৫ শতাংশ পর্যন্ত একা ভারতের ছিল। সেই রাজতন্ত্রের যুগে, যখন কোনও প্রশিক্ষিত অর্থনীতিবিদ ছিলেন না—ভারত কিন্তু তখন মুক্ত বাণিজ্যকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছিল, নতুন নতুন বাজার দখল করেছিল এবং ভারতের ভিতরেই অনেক জাতির সম্পদের বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল। আমরা আমাদের সেই সমৃদ্ধ উত্তরাধিকারের যুগে ফিরে যেতে পারি। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি এই ভেবে যে, গৃহীত নীতি লো গ্রোথ বা নিম্ন বৃদ্ধির দিনগুলিতে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
অক্সফোর্ড অর্থনীতি আমাদের হুঁশিয়ার করেছে যে, আগামী পাঁচ বছরে ভারতের ক্ষেত্রে গড় বৃদ্ধির হার ৪.৫ শতাংশ হতে পারে। এটা একটা ‘ওয়েক আপ কল’।