সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
দিল্লির শাসকদের নয়া নির্দেশ, নয়া ছক। সঙ্গে নয়া নাটক। ঝাঁপাও পাচার নিয়ে। মওকা বুঝে ছেটাও কালি। লালা আর এনামুল। যেন মানিকজোড়। সদ্য খোঁজ মিলল। আসল কারণ তো, ভোট আসছে বলেই গোরু পাচার, কয়লা পাচার সিন্ডিকেটের উপর চোখ পড়েছে। নাহলে এমন তো কতই হয় চোখের উপর। বলুন তো, গত সাড়ে চারবছর কি গোরু পাচার ছিল না? আলবাত ছিল। দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে। বিএসএফের কর্তাদের যোগসাজশে বুক ফুলিয়ে। কনসাইনমেন্ট পিছু ৩৫-৪০ লক্ষ টাকার হাত বিনিময়। এত বড় লেনদেন সব গোপনে হয়েছে! ওই পরিমাণ টাকা হজম করা এতই সোজা। এর একচুল দায় কেন্দ্র অস্বীকার করতে পারে? বিএসএফ কার, ইসিএল কার নিয়ন্ত্রণে, মানুষ জানে না। এখন একতরফা রাজ্যের শাসক দলের উপর দায় চাপালে ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু লাগতে পারে বলেই বিএসএফের কমান্ড্যান্ট সতীশ কুমারকে গ্রেপ্তারের নাটক। এর থেকেই প্রমাণ হয়, আগাগোড়া পুরো বিষয়টাই দিল্লির গোচরে ছিল।
আর কয়লা পাচার? বেআইনি কয়লা খাদানের কারবার? সে সিন্ডিকেটের জট তো আরও গভীরে। শুধু এরাজ্য নয়, রাজ্যের বাইরেও অনেক লোক এই খেলায় জড়িত। পুরোটাই বছরের পর বছর চলে আসছে কেন্দ্রের ইসিএল সংস্থার কিছু অফিসারের সঙ্গে গোপন বোঝাপড়ায়। ইসিএল জানে না, অথচ খনিমুখ থেকে অসৎ কারবারিরা কয়লা তুলে চড়া দামে বিক্রি করছে, এই সহজ সরলীকরণ মেনে নেওয়া কতটা সম্ভব। দেড় হাজার টাকার জিনিসটা বিক্রি হচ্ছে পাঁচ হাজারে। ভোটের ছ’মাস আগে জানা গেল সার সত্যটা। এসবই ভোটের আগে পাচার নিয়ে রাজ্য-রাজনীতিকে সরগরম করার অপচেষ্টা। সবকিছু এলোমেলো করে দেওয়ার প্রয়াস। এতেই প্রমাণ হয়, এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সোজাসুজি লড়তে বিরোধী শক্তি ভয় পাচ্ছে। তাঁর জনসমর্থনের তল খুঁজে পাচ্ছে না। তাই অশান্তি, অস্বস্তি তৈরির বেপরোয়া চেষ্টা। একদিকে তৃণমূলের লোভী বিশ্বাসঘাতক নেতাদের চিহ্নিত করে দল ভাঙার বর্ণাঢ্য আয়োজন। অন্যদিকে, পাচারকারী ‘লালু–ভুলু’কে সামনে এনে শীর্ষ নেতৃত্বের ভাবমূর্তিতে কালি ছেটানোর নোংরা অপচেষ্টা।
এসবের আড়ালে আবার চলছে গেরুয়া নেতাদের ফাঁকা হুঙ্কার, শাসক দলের নেতাদের লুকনো
সম্পত্তি খুঁজে বার করে জেলের ভাত খাওয়াব। ভাবটা এমন, গেরুয়া নেতারা বুঝি সব সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। মাটিতে ভাত খান। সব ছেড়ে দিলাম।
শুধু গত পাঁচবছরে অমিত-পুত্র জয় শাহের
ক্ষমতা ও ব্যবসার বহুগুণ বৃদ্ধির হিসেবটা কি
একবার দেবেন বঙ্গের বিজেপি নেতারা?
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের কথা মনে আছে। সারদা আর নারদ দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে ফেলার চেষ্টা সেবারও কম হয়নি। সঙ্গে মিলেছিল মধ্য কলকাতার বুকে দিনে-দুপুরে নির্মীয়মাণ সেতু ভেঙে পড়ার সাতকাহন। আখেরে লাভের লাভ কিছুই হয়নি। পুরো প্ল্যানটাই ফ্লপ করেছিল। সব অভিযোগ উড়িয়ে ২০৮ আসনে জিতেছিলেন মমতা। হ্যাঁ, জয়টা একান্তভাবে তাঁরই ছিল। কারণ ২৯৪টি আসনে তিনিই প্রার্থী ছিলেন। সেবারও কেন্দ্রের একতরফা প্রচার তাঁর ভাবমূর্তিকে ছোট করতে পারেনি। ফল বেরতেই দেখা গেল, একইসঙ্গে কংগ্রেস, সিপিএম ও বিজেপি কার্যত ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে।
মোদি সরকার দিল্লির তখতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ঠিক কী হয়েছিল সেবার একটু মনে করাই। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরেই সারদা মামলায় মদন মিত্রকে গ্রেপ্তার করে রাজ্য-রাজনীতিতে ঝড় তোলার চেষ্টা হয়েছিল। গোটা ঘটনায় ক্ষিপ্ত মমতা চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন, পারলে আমায় গ্রেপ্তার করুন। তারপর কোথাকার জল কোথায় গড়িয়েছে আজ ছ’বছর পর তা কারও অজানা নয়। মদনবাবু কিছুদিনের মধ্যেই মুক্ত। রোজভ্যালি মামলায় বেশিদিন আটকে রাখা যায়নি সুদীপবাবুকেও। মামলা তারপর আর খুব একটা এগয়নি। আর দুর্নীতির সঙ্গে তৃণমূলের যে নেতার নাম জড়িয়ে বঙ্গের বিজেপি নেতারা সেদিন স্লোগান আর হুঙ্কারে রাতদিন এক করে ফেলেছিলেন, তাঁকেই আজ সর্বভারতীয় সহসভাপতির আসন দিয়েছে। সংগঠনের মাথায় তুলেছে। এরাজ্যে গদি দখলের অন্যতম মুখ করেছে। এ কেমন নীতিহীন সমঝোতা! এটাই তাহলে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াইয়ের আদর্শ নমুনা!
দিলীপবাবুরা এরপর কী বলবেন, নিশ্চয় সর্বভারতীয় সহসভাপতিকে এ যাত্রায় জেলের ভাত খাওয়াবেন না। প্রয়োজনে তাঁকে গঙ্গাজলে ধুয়ে নেবেন! বিজেপিতে যোগ দিলেই বুঝি দুর্নীতির, টাকা কামানোর অভিযোগ রাতারাতি মুছে যায়! আর পরিবারতন্ত্র? মমতার দয়ায় কারও ছেলে এমএলএ তো অন্যজনের স্ত্রী, ভাই—কেউ বাদ নেই। নিদেনপক্ষে একটা কাউন্সিলর। এভাবেই মমতাকে আশ্রয় করে গোটা পরিবারটাকে গুছিয়ে নেওয়ার দু’শো আয়োজন। আর এখন বঞ্চনা আর অবহেলার অভিযোগ তুলে জননেত্রীর দিকে আঙুল তুলে দল বদলালেই কলঙ্কমুক্ত? ভাবমূর্তি সফেদ? মানুষের আদালতে এর কোনও বিচার হবে না? পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে এত বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই। সব হিসেব ঠিক সময় তাঁরা চুকিয়ে দেবেন।
আসলে এরাজ্যে গেরুয়া দলটা এখনও হাওয়ায় ভাসছে। অর্ধেক বুথে এবারও এজেন্ট দিতে কালঘাম ছুটবে। এত বড় বড় কথা বলার পরও জেলায় জেলায় সংগঠন বলে কিছু নেই। ক্ষীণবল হলেও দূর গ্রামে এখনও বামেদের কর্মসূচি কিন্তু গেরুয়া দলের থেকে বেশি। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবারের প্রচারযন্ত্র অত্যন্ত শক্তিশালী। নয়কে হয়, আর হয়কে নয় করতে তারা ওস্তাদ। সেই সুবাদেই হাওয়া তোলার বেপরোয়া চেষ্টা চলছে। সুকৌশলে বারবার বলা হচ্ছে, তারা ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। শুধু ফলটুকুর অপেক্ষা। এটাকেই ইংরেজিতে বলে ‘পারসেপশন ব্যাটল’। এই যুদ্ধে আরএসএসের প্রচারকরা সিদ্ধহস্ত। বঙ্গ নেতারা বিলক্ষণ জানেন, এতকিছু করেও বাংলা দখল এখনও দূর অস্ত। তার ওপর ক্ষমতায় আসার আগেই জেলায় জেলায় দলটার ভিতরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের নগ্ন চেহারা কতটা তীব্র হয়েছে, তা দিল্লির নেতারা টের পেয়ে গিয়েছেন। নীচের তলায় টাকা তোলাও শুরু হয়ে গিয়েছে। ক্ষমতায় আসার আগেই এত দূর! বঙ্গের গেরুয়া শক্তিকে প্রশ্ন করি, গোটা রাজ্যটাতেই যখন আপনারা জাঁকিয়ে বসেছেন তাহলে ভিন রাজ্য থেকে পাঁচজন পর্যবেক্ষক আনতে হচ্ছে কেন? বাংলায় আপনাদের লোক নেই, না কি আপনাদের উপর দিল্লির নেতৃত্বের এখনও আস্থা নেই? এখন থেকেই পদ দখল নিয়ে দলের নেতা ও কর্মীদের ঝগড়া যেভাবে চরমে পৌঁছেছে তা তো ভয়ঙ্কর। এরা ক্ষমতায় এলে সঙ্কীর্ণ স্বার্থের মারামারি যে আরও কদর্য চেহারা নেবে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ আছে নাকি?
বাস্তবে দিলীপবাবুরা জানেন, সোজা পথে এখনও পশ্চিমবঙ্গ দখল কোনওভাবেই সম্ভব নয়। আর তা বুঝেই একদিকে পুরোদমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি কাজ করছে তৃণমূলকেই ছলে বলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার কৌশল। এভাবেই অবিশ্বাসের বীজ বুনে ভাঙনের নোংরা খেলায় উসকানি দেওয়া। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে, প্রতিপক্ষের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে পেরে না উঠলে কী করি? আঙুলটা একটু বাঁকাই। ঘুরপথে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার চেষ্টা করি। দল ভাঙানো। মিথ্যে মামলা। সিবিআই-ইডিকে যুগপৎ লাগিয়ে নেতাদের টানা হ্যাঁচড়া। জেরার পর জেরা, গ্রেপ্তার—এসবই এই চেনা খেলার অঙ্গ।
এতদিনে সবাই আসল ধান্দাটা ধরে ফেলেছে। এসবই ভোটের আগের পাঁচ ছ’মাসের কাহানি।
ভোট ফুরলেই তদন্তের নটেগাছটাও কখন মুড়িয়ে যাবে, কেউ টের পাবে না। বুক ফুলিয়ে পাচার চলবে। দেদার জাল নোট চলবে। বেআইনি কয়লা সিন্ডিকেটের বাড়বাড়ন্ত দেখেও কেন্দ্রীয় এজেন্সি চুপ করে থাকবে। যাবতীয় তৎপরতা তোলা থাকবে আবার পরের ভোটের জন্য! সেই ট্র্যাডিশন চলতেই থাকে বিরামহীন।