সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
ভোটার তো রাতারাতি তৈরি হয় না। কিন্তু এক দলের ভোট অতি সহজেই পরের নির্বাচনে শত্রু শিবিরে চলে যায়। এ রাজ্যেও সেই অদ্ভুত রসায়নের দিকেই তাকিয়ে বিজেপি। এ খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে গত লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকে। বামের ভোট রামে। সঙ্গে লাল পার্টির অন্দরে অদ্ভুত ফিসফিসানি, একুশে রাম, ছাব্বিশে ফের বাম। সেই অলীক স্বপ্নকে সামনে রেখেই লাল পতাকা নিয়ে হাঁটা মানুষের ভোট পড়ছে রামে। নাহলে এ রাজ্যে সিপিএমের ভোট ৬.৩ শতাংশ আর বিজেপির ভোট ৪০ শতাংশের বেশি, এই উলটপুরাণের পরিসংখ্যান আলিমুদ্দিনের কর্তারা সহজে হজম করতে পারতেন না। অথচ ৩৪ বছর টানা বাংলাজুড়ে একচেটিয়া কর্তৃত্ব করার পর ২০১১ সালে মমতার হাতে ভরাডুবির নির্বাচনেও এ রাজ্যে ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল সিপিএম। ৬ মাসেই ঘুরে দাঁড়ানোর শপথও নিয়েছিল। ব্রিগেডে যখনই সভা হয়েছে, তখনই মাঠ উপচে গিয়েছে। শ্রদ্ধেয় বিমানবাবুরা আহ্লাদিত হয়েছেন। কিন্তু কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষের ভোট আর ফেরেনি। পক্বকেশ নেতৃত্বের উপর কমরেডরা আস্থা রাখতে পারেননি। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে বামেদের ভোট কমে দাঁড়ায় ২০ শতাংশ। বাম ও কংগ্রেস জোট করেও চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়। পার্ক সার্কাস ময়দানে বুদ্ধদেববাবু ও রাহুল গান্ধী একে অপরকে মালা পরিয়ে উষ্ণ আলিঙ্গন করলেও তার কোনও প্রতিফলন দেখা যায়নি ভোটযন্ত্রে। এরপর থেকেই রাজ্য রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে গেরুয়া শিবিরে যাওয়ার ঝোঁক বেড়েছে। ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের ফল সেই ভয়ঙ্কর পরিণতির ইঙ্গিতই বহন করছে।
কিন্তু নিজের নাক কেটে তৃণমূলের যাত্রা ভঙ্গ করার এই চোরাগোপ্তা খেলায় সিপিএমের লাভ? এই ভাবের ঘরে চুরি আর কতদিন চলবে! কমরেডরা বুঝতে পারছেন না, এই সর্বনাশা খেলা দলটার আরও বারোটা বাজিয়ে দেবে। শেষে অস্তিত্বটাই বিপন্ন হবে। সর্বনাশ হয়ে যাবে রাজ্যটার। এই উপলব্ধি এখনই না হলে ফ্যাসিস্ট শক্তি যে আলিমুদ্দিনের একটা ইটও আস্ত রাখবে না সে কথা বোঝাবে কে? এবং ইতিহাসে সিপিএম যত বড় বড় ভুল করেছে তার সব রেকর্ড ছাপিয়ে যাবে। কারণ অবশিষ্ট ৬ শতাংশ ভোটও যদি নীতির ভুলে অবাঙালি প্রধান বহিরাগত নেতায় ভরা দলের ঝুলিতে চলে যায় তার সম্পূর্ণ দায়ভার বর্তাবে বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্রদের উপর। ছাব্বিশ কেন, ছত্রিশেও সেই ভুল সংশোধন করে ফেরার সুযোগ পাবে না বামপন্থীরা। আর একটা কথা বলি, সিপিএম অতীতে যাই করে থাকুক, আদ্যন্ত বাংলার মাটিতে মিশে থাকা দল। কোনও ভিনদেশি বর্গি, শাহ, নাড্ডা এই বাংলায় এ দলের নিয়ন্ত্রক নন। দলের সুর ও কৌশল বেঁধে দেওয়ার জন্য কখনও ডাকতে হয়নি কোনও কিশোরকুমারকেও। আর গত ৮-৯ মাসের লকডাউন পর্বে হীনবল হয়েও সাম্প্রদায়িক বিষ না ছড়িয়ে বামেরা যেভাবে কলকাতা থেকে দূর জেলায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাও অত্যন্ত প্রশংসাযোগ্য।
১৯৯৬ সালে মাত্র ৩২ জন এমপি নিয়ে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন ভোটাভুটিতেই ভেস্তে দিয়েছিল দল। ওই পদক্ষেপ কত বড় ভুল ছিল, তা নিয়ে আজ এই দুর্দিনেও দল আড়াআড়ি বিভক্ত। এখনও তিনজন বামপন্থী একজায়গায় বসলে তা নিয়ে ঝড় ওঠে। কিন্তু তখন দল অস্তিত্ব সঙ্কটের মধ্যে ছিল না। তারপরও দীর্ঘ ১৫ বছর বামেরা পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে হেসেখেলে। ত্রিপুরায় লাল পতাকা উড়েছে। কেরলে ক্ষমতায় এসেছে গেছে। মাঝে ২০০৪ সালে ৫৯ জন এমপি নিয়ে মনমোহন সরকারের প্রাণভোমরার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল বামেরা। কেউ কেউ বলেন, মনমোহনের মন্ত্রিসভায় যোগ না দিলেও ২০০৪ থেকে ২০০৮, ওই চারবছরই ছিল এদেশে বামপন্থীদের স্বর্ণযুগ। কিন্তু ওই যে বললাম, সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। পাঁচবছর যেতে না যেতেই পরমাণু চুক্তি ইস্যুতে সমর্থন প্রত্যাহার করে প্রথম দলের পায়ে কুড়ুল মারলেন প্রকাশ কারাত সাহেব। তার আগেই অবশ্য ২৩৫-এর অহঙ্কারে বুদ্ধদেববাবু সিঙ্গুরের কৃষকদের খেপিয়ে বসে আছেন। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নন্দীগ্রাম আন্দোলন। পার্টি ল্যাজে গোবরে। কিন্তু ২০০৮ থেকে ২০২০— দীর্ঘ এক যুগ ধরে সিপিএমের এই ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ কি শুধুই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির কাছে পরাজয়, নাকি পদে পদে ভুল সিদ্ধান্ত, বিভ্রান্তিকর পদক্ষেপ? কে বড় শত্রু তা চিনতে ভুল করা? সেই আত্মসমীক্ষা কি বামদলগুলি করেছে? ২০০৪ সালে যে সিপিএম রাজ্যে ২৬টি আসন জিতে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল (আর বামফ্রন্ট সেবার পেয়েছিল সবমিলিয়ে ৩৫ টি), সেই দলই ২০০৯ সালে কেন মাত্র ৯টি আসন পেল? আর মমতার দল ১৯টি জিতে বাংলার চালকের আসন দখল করে নিল। কোথায় ভুল ছিল। দায়ী কে? বামেদের রক্তক্ষরণের তো সেই শুরু, যা আজও শেষ হয়নি। এখন একটাই অপেক্ষা, আগামী বিধানসভা ভোটে বামেরা শুধু নিজেদের ভোটটা নিজেদের প্রতীকে দিন। রাগে অভিমানে হতাশায় অন্যরকম কিছু করলে মুছে যেতে হবে। ইতিহাস তখন ক্ষমা করবে না।
গত লোকসভা ভোটে সারা দেশে ৭০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে সিপিএম মাত্র তিনটি আসন জিতেছে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় দলের প্রাপ্তি শূন্য। এই বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় কারণ হল কে বড় শত্রু তা চিহ্নিত করতেই একযুগ কেটে যাওয়া। বিজেপি ও কংগ্রেস থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখার রাজনীতি করতে গিয়ে গেরুয়া শক্তির বাড়বৃদ্ধিকেই ঘুরিয়ে ত্বরান্বিত করেছে দেশীয় বামপন্থীরা। সেই প্রক্রিয়ারই আজ নগ্নরূপ দেখছে পশ্চিমবঙ্গ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে না পেরে তলে তলে দলের নীচের তলা বিজেপিকে সাহায্য করছে। এর বিষময় পরিণামটা এখনও টের পাচ্ছে না। তৃণমূলকে শিক্ষা দেওয়ার নামে বিজেপিকে জমি ছেড়ে দেওয়ার অর্থ বিরোধী শক্তিকেই দুর্বল করা। তৃণমূল ও বিজেপির থেকে সমদূরত্বের রাজনীতির অর্থ আখেরে মোদি, অমিত শাহ তথা সঙ্ঘ পরিবারকেই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে অক্সিজেন দেওয়া। নির্ণায়ক নির্বাচনে দুই প্রধান শত্রু থেকে সমদূরত্বের অবস্থান আদতে সোনার পাথরবাটি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ভুল না ভাঙলে বঙ্গের বামপন্থীরা অচিরেই ফসিল হয়ে যাবেন!
কংগ্রেসমুক্ত ভারতের ডাক দিয়ে নরেন্দ্র মোদি তাঁর দিল্লি যাত্রা শুরু করেছিলেন বটে, এখন কিন্তু অভিমুখ আরও ধারালো। আরও সুনির্দিষ্ট। শুধু আর কংগ্রেসমুক্ত ভারত নয়, এবার লক্ষ্য বিরোধীশূন্য রাষ্ট্র। আর সেই লক্ষ্যেই যেন তেন প্রকারে মমতাকে দুর্বল করার কাজে বামেরা যদি সঙ্গ দেয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। জয়ললিতা নেই। মায়াবতীর রাজনৈতিক অবস্থান বিজেপির পক্ষে। মুলায়মের বয়স হয়েছে। অখিলেশ অনেকটাই ক্ষীণবল। বিজেপির পক্ষে থাকলেও বিহারে নীতীশ কুমারের এতদিন একটা স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। বিহারের সাম্প্রতিক
নির্বাচনে তিনি ফের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন বটে কিন্তু তাঁর সরকারের পুরো নিয়ন্ত্রণ অমিত শাহের হাতে। সরকারে জুনিয়র পার্টনার নীতীশ আজ কার্যত বিজেপির হাতের পুতুল। নবীনবাবু কিংবা কেসিআর খুব বেশি মোদিজিকে চটাবেন না। তাহলে রইল বাকি কে? তাই আগামী ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ দেওয়ার মতো
অবস্থায় একমাত্র বাংলার অবিসংবাদিত নেত্রী মমতা। তাই বামেদের ক্রমে ক্ষয়ে যাওয়া ভোট ব্যাঙ্ক থেকে আরও তিন-চার শতাংশ যদি কৌশলে টেনে নেওয়া যায় তাহলেই তো গেরুয়া পার্টির কেল্লা ফতে! সিপিএমের মিছিলে হাঁটা কমরেডরা বাংলায় পদ্মফুল ফোটালে লাভ কার?
কিন্তু মমতাকে দুর্বল করতে ফ্যাসিস্ট আরএসএসের তালে তাল মেলালে ইতিহাস কি বামপন্থীদের ক্ষমা করবে? বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় দেশীয় বাম নেতৃত্বের নেতিবাচক ভূমিকা কিংবা নেতাজিকে বিশ্বাসঘাতক বলে দেগে দেওয়ার কলঙ্ক আজও ইতিহাস থেকে মোছেনি। ঠিক তেমনি বামপন্থী মিছিলে হাঁটা লোক যদি পদ্মফুলে বোতাম টেপে তাহলে বাংলার মানুষ ক্ষমা করবে না। আর যাঁরা ভাবছেন এতে করে আখেরে লাভ হবে, তাঁদের সম্মান দিয়েই বলি, এতে জাত যাবে পেটও ভরবে না। সঙ্ঘ পরিবার আষ্টেপৃষ্ঠে রাজ্যটাকে ঘিরে ফেলবে। সঙ্ঘ পরিবারের শৃঙ্খলে বাংলা ও বাংলার মানুষ বন্দি হয়ে যাবে। বামপন্থীদের ঘুরে দাঁড়ানো তখন চিরতরে দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে।