সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
এটাই যে শেষ কথা! রাজনৈতিক দল, রাজনীতির মুখ—কেউ ভোট দেয় আদর্শে, পারিবারিক পরম্পরায়। কেউ আবার স্রোতে ভেসে। আর বেশিরভাগই ইভিএমের বোতামে চাপ দেয় ভরসায়। ভোটের দিন পেরিয়ে গেলেও এঁকে পাওয়া যাবে। দরকারে-অদরকারে পাশে দাঁড়াবে। কাজ পাব। পেটের ভাতে টান পড়বে না। মানুষের স্বার্থবিরোধী কোনও নীতির জন্য পরে হাত কামড়াতে হবে না। এগুলোই ভোটদানের সাধারণ নিয়ম-নীতি। বাঙালি ভোটাররা আবার একটু অন্যরকম। তাঁরা ভরসাটা একটু বেশিই করেন। ভালোবাসেন সময় দিতে... আহা, আর একটা টার্ম না হয় থাকল। টাইম দিলে তবে তো কাজ করবে! বঙ্গবাসী ভোটাররা তাই সিপিএমকে ৩৪ বছর সময় দিয়েছিল। ভরসার খাতিরে। এই এবার ভালো কিছু হবে... আশার শেষ নাই! কিন্তু মানুষ আশাহত হল। না হলে বাঙালি ভোটারদের কনভিন্স করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কুর্সিতে বসতে পারতেন না। আর আজ, নতুন করে চলছে কনভিন্স করার প্রয়াস। বিজেপি ইস্যু খুঁজছে... ভোটারকে প্রভাবিত করার। মরিয়া চেষ্টা চলছে মূল বিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রমাণের। সম্বল, লোকসভা ভোটের ফল। আর দল ভাঙানোর খেলা। বছর দুয়েক ধরে বিজেপি হাঁকডাক চালিয়ে যাচ্ছে, শাসক দলের বহু সাংসদ-বিধায়ক নাকি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার জন্য বসে আছে। ভাবটা এমন, যেন গোটা তৃণমূল দলটাই লাইনে দাঁড়িয়ে। আজ যোগ না দিলেও, কাল অবশ্যই দেবে। শত চেষ্টাতেও কিন্তু মুকুল রায় ছাড়া তেমন একটা বড় নাম বিজেপি বাজারে আনতে পারেনি। যদিও হাওয়ায় গুজবের কমতি নেই। শুভেন্দু অধিকারীর নামটাও বেশ কয়েক মাস ধরে পাবলিককে খাইয়ে রেখেছে বিজেপি। এই নাকি তিনি বিজেপিতে যোগ দিলেন বলে! কিছু কিছু বিষয়ে দলের প্রতি শুভেন্দুবাবুর অভিমানটাকে এনক্যাশ করেছে গেরুয়া শিবির। আর ‘দাদার অনুগামী’রাও তাতে নেচে উঠেছে। শুভেন্দুবাবু মন্ত্রিত্ব ছেড়েছেন। তাঁর গড় বলে পরিচিত হলদিয়ার ডেভেলপমেন্ট অথরিটির দায়িত্বেও আর নেই। কিন্তু বিধায়ক পদ বা তৃণমূলের সদস্যপদ ছাড়েননি তিনি। হয়তো ছাড়বেন... হয়তো এর মধ্যেই বিজেপিতে যোগ দেবেন। বা আলাদা মঞ্চ গঠন করবেন। কিন্তু এখনও কোনওটাই তো হয়নি! তাহলে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণীর এত ব্যস্ততা কীসের? তবু হুড়োহুড়ি চলছে। সবাই এখন ‘দাদা’র ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছেন। তারিখ দিচ্ছেন... ১০, ২০, ২২, ২৩, ৩০। নভেম্বরের ক্যালেন্ডার ফুরিয়ে গেল, শুভেন্দুবাবু বিজেপিতে যোগ দিলেন না। তারিখ পে তারিখ, তারিখ পে তারিখ... সব ফেল। রাজ্য রাজনীতি তোলপাড়। নিঃসন্দেহে তৃণমূল কংগ্রেসে শুভেন্দু অধিকারী একটা বড় নাম। তিনি বিজেপিতে গেলে অবশ্যই খাল কেটে কুমির আনার সম্ভাবনা দেখা দেবে। এরপরও একটা কথা বলতে হয়, শুভেন্দুবাবুর যতই দাপট থাকুক না কেন, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন। সেটা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও তাঁর রাজনৈতিক পরিকল্পনা দর কষাকষিতে সীমাবদ্ধ থাকত না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, কী ছিল তাঁর সঙ্গে? শুধু একটা স্বপ্ন—সিপিএমকে রাইটার্স থেকে উৎখাত করার। বছরের পর বছর সংগ্রাম করেছেন তিনি। জনসভার ভিড় ভোটবাক্স পর্যন্ত এসে পৌঁছয়নি। জিতেছেন তিনি... দল পারেনি। মানুষের বুঝতে সময় লেগেছে, পাহাড় থেকে সমুদ্র ‘প্রার্থী’ একজনই—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁকে দেখে তৃণমূলে এসেছেন শুভেন্দু অধিকারীও। দলের জন্মলগ্নে নয়, অনেক পরে। এই ধারা কিন্তু আজও বদলায়নি। শুধু খানিকটা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া গায়ে এসে লাগছে... তাও বছর দশেক ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাফেরার পর। সেটা খুব স্বাভাবিক। হাতের পাঁচটা আঙুল একরকম হয় না। অভিযোগ উঠেছে, উঠবেও। কিন্তু প্রশ্নটা হল, বিজেপি কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প? বা আদৌ অদূর ভবিষ্যতে তেমন কিছু হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে? এককথায় উত্তর, না। দূর দূরান্ত পর্যন্ত তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই। কেন্দ্রে না হয় গেরুয়া পার্টির একটা মুখ আছে—নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু তিনি তো আর বাংলায় এসে সরকার চালাবেন না! তাহলে এখানে মুখটা কে? দিলীপ ঘোষ? রাজ্যের কতজন মানুষ তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান? লজ্জার চোটেই বিজেপি সেই সমীক্ষা করাবে না। তাহলে কে? অনুগামীদের অনেকের মনে হতে পারে, শুভেন্দুবাবু বিজেপিতে গেলে তিনিই হবেন মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী। তেমন কোনও সম্ভাবনা কয়েকশো মাইলের মধ্যে নজরে আসছে না। এবার প্রশ্নটা হল, কীসের আশায় তাহলে শুভেন্দু অধিকারী এই বিদ্রোহটি করলেন? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া তৃণমূল কংগ্রেসে যে গুটিকয় নেতা প্রথম শ্রেণীর গুরুত্ব পেয়ে থাকেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শুভেন্দুবাবু। সেটা তিনিও বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু তিনি এটা জানেন না, একা ভোটের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর খুব একটা নেই। কয়েকটি জেলায় তিনি অবশ্যই ভোটে প্রভাব ফেলবেন। সেই অনুগামী তাঁর রয়েছে। কত আসনে? ৩০টি আসন? ৪০টি? এই সংখ্যাটাও অলীক। তাও তর্কের খাতিরে না হয় এমনই কিছু কল্পনা করে নেওয়া যাক। এর মধ্যে একটি আসন হয়তো তিনি জিতবেন—শুভেন্দু অধিকারী নিজে যে কেন্দ্রে দাঁড়াবেন। বাকিগুলি? এখানেও দু’টি সম্ভাবনা রয়েছে। শুভেন্দুবাবু যদি বিজেপির হয়ে বিধানসভা ভোটের ময়দানে নামেন, তাহলে তিনি বিজেপির ভাগের ভোটটাই পাবেন। তৃণমূলের থেকে ভাঙানো ভোট তিনি পাবেন, কিন্তু তা নির্ণায়ক হবে না। আর যদি আলাদা মঞ্চ করেন, তখন বড়সড় হাত পড়বে তৃণমূলের ভোটে। সুবিধা হবে বিজেপির। আর তাঁর নিজের অবস্থা কী হবে? উদাহরণ তো খুব সামনেই আছে—চিরাগ পাসোয়ান। নীতীশের কোমর ভাঙতে গিয়ে চিরাগ নিজেই প্রায় নিভে গিয়েছেন। আমও গিয়েছে, ছালাও। চিরাগের না হয় বয়স কম, ব্যাকগ্রাউন্ডে রামবিলাস পাসোয়ানের মতো একটা নাম আছে। আজ না হয় কাল কোনও না কোনও জোটসঙ্গী খুঁজে আবার নতুন করে শুরু করতে পারবেন। কিন্তু শুভেন্দুবাবু? বিজেপিতে গেলেও তিনি কতটা গুরুত্ব পাবেন, সেটাই সংশয়। ধীরে ধীরে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে উধাও হয়ে যাবেন তিনি। ব্র্যান্ড বলতে আর কিছু থাকবে না। থাকবে ব্যাগেজ—হতাশার। শুভেন্দু অধিকারীর পরিচিতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে ছাতার জন্য। জার্সির জন্য। সেই জার্সিটা খুলে ফেললে কী হবে, তার জন্য পরীক্ষা প্রার্থনীয়। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুব বেশি মানুষ কিন্তু নিজের জার্সি গায়ে চাপিয়ে সফল হতে পারেননি।
প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। যার নেপথ্যে রয়েছে সংগ্রামী অতীত। তাকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। শুভেন্দুবাবু যদি সত্যিই দল ছেড়ে যান, তাহলে আসন্ন বিধানসভা ভোটে কিছুটা হলেও কষ্ট হবে মমতার। কিন্তু এরপরও যদি তিনি জিতে ফেরেন, সেই জয় হবে নিষ্কণ্টক। তিনি জানবেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামটার প্রতি বাংলার মানুষের ভরসা এখনও অটুট। সেই জয় পায়ের নীচের জমিটাকে আরও জমাট করবে। বিজেপির ভ্রান্ত নীতির বিরুদ্ধে তিনি নতুন উদ্যমে সুর চড়াতে পারবেন। দেশের মানচিত্র গেরুয়াকরণের প্রয়াস আরও একবার ধাক্কা খাবে।
কিন্তু শুভেন্দুবাবু যদি তৃণমূল না ছাড়েন? আপাতত তিনি রাজনৈতিক বানপ্রস্থে চলে গিয়েছেন। সেটা কাটিয়ে বেরনো কঠিন হবে। এখন যাঁরা তাঁর অনুগামী হয়ে ইন্ধন জোগাচ্ছেন, তাঁরাও ধীরে ধীরে সরে যাবেন। তখন ছাতা হয়ে আবার আশ্রয় দিতে পারেন একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি এখন থেকেই আসরে নেমে পড়েছেন। বলে দিয়েছেন, প্রতিটা ব্লকে অবজার্ভার তিনিই। প্রত্যেকের সমস্যার সমাধানও তিনিই করবেন। যেভাবে গত দশ বছর করে এসেছেন। স্কুলছুটদের ফেরাতে কন্যাশ্রীর ব্যবস্থা করেছেন। দরিদ্র বাবা যখন মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না, এগিয়ে এসেছে তাঁর রূপশ্রী। দাবি উঠেছে কলেজের, বিশ্ববিদ্যালয়ের... পূরণ করেছেন তিনি। প্রশাসক হয়েও মানুষের থেকে দূরে চলে যাননি তিনি। এটাই যে তাঁর ইউএসপি।
বাঁকুড়ার শুনুকপাহাড়ীতে সভা করছেন মমতা। মাঠের মধ্যে আট থেকে আশি, সবাই। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে তাঁরা... যুবতী, প্রৌঢ়া, বৃদ্ধা... হাত জোড় করে। এটাই যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি বাংলার মানুষের ভক্তি, ভালোবাসা। তাঁরা জানেন, এই নেত্রী যতদিন আছেন, তাঁদের সন্তানরা দুধে-ভাতে না থাকুক... না খেয়ে মরবে না।
রাজনীতির মধ্যে থেকেও যা একেবারে রাজনীতি নয়। শুধুই ভরসা।