সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
মতপ্রকাশের অধিকার তো বিশ্বজনীন! অন্তত এই ইস্যুতে একজনকে কাঠগড়ায় তোলাটা বৃথা। অনেকে এই বইয়ের জন্য ওবামার বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলেও হুমকি-টুমকি দিচ্ছেন। মামলা হলে ওবামা সামলে নেবেন। প্রশ্নটা অন্যত্র... এই বিশ্লেষণের পিছনে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই তো? বা ভারতের সংস্কৃতিকে হেয় করার চেষ্টা? আপাত দৃষ্টিতে তেমন কিছু অবশ্য নজরে আসছে না। কারণ তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘ভারত মানে আমার কাছে ২ হাজার জনজাতি, আর সাতশোরও বেশি ভাষা। ছেলেবেলার কিছুটা ইন্দোনেশিয়ায় কাটিয়েছিলাম বলেই হয়তো মনের একটা আলাদা ঘরে ভারত সম্পর্কে কল্পনার প্রাসাদ গড়ে উঠেছিল। রামায়ণ, মহাভারত... বা কলেজের সেই বন্ধুরা। তাদের মধ্যে ভারতীয় ছিল, পাকিস্তানিও। ওরা আমাকে ডাল আর কিমা রান্না করতে শিখিয়েছিল। ওদের জন্যই বলতে গেলে বলিউডি মুভির পোকা হয়ে গিয়েছিলাম।’ বিষয়টা খুব পরিষ্কার... ভারত সম্পর্কে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্টের ধারণা, বিশ্বাস বা ব্যাখ্যায় এতটুকু গলদ নেই। আছে কিছু ভারতীয় সম্পর্কে। সিস্টেমকে ব্যবহার করে একের পর এক কেলেঙ্কারি, মারদাঙ্গা, গণতন্ত্রের নামে পরিবারতন্ত্র... আমাদের দেশের এই ‘মহত্ত্ব’কেও ছুঁয়ে গিয়েছেন ওবামা। যখনই সুযোগ পেয়েছেন। আর বলেছেন ডঃ মনমোহন সিংয়ের কথা। দ্বিধাহীন ভাষায় লিখেছেন, নয়ের দশক থেকে উদার অর্থনীতি এবং সাফল্যের যে দৌড় ভারত শুরু করেছে, তার প্রতীক একজনই—মনমোহন সিং। অসাধারণ জ্ঞান আর শিক্ষণীয় সৌজন্য। নির্বিবাদী এই রাষ্ট্রনেতাকে তিনি ঠিক কতটা সম্মান করেন, তা ওবামা লোকাননি। লোকানোর চেষ্টাও করেননি। লিখেছেন নয়াদিল্লিতে মনমোহনের বাড়ির সেই ডিনারের কথাও... ‘টেবলে সোনিয়া গান্ধী এবং রাহুল গান্ধী... সেদিন দু’জনেই ছিলেন। ষাটের ঘরে বয়স, তাও ধাক্কা লাগার মতো ব্যক্তিত্ব। ট্র্যাডিশনাল শাড়ি, শান্ত-রাজকীয় উপস্থিতি, আর দু’টো কালো চোখ... যা সবসময় কাটাছেঁড়া করে যাচ্ছে। বলেছিলেন খুব কম। শুনেছিলেন বেশি। পলিসি সংক্রান্ত কিছু নিয়ে যখনই কথা উঠেছে, খুব বুঝে পা ফেলেছেন। ভেবেচিন্তে ছাড় দিয়েছেন মনমোহন সিংকে... কথা বলার জন্য। আর সব সময় খেয়াল রেখেছেন, রাহুলের সঙ্গে বা রাহুলকে নিয়ে কী কথা হচ্ছে। আর রাহুল... স্মার্ট, আন্তরিক। রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে থেমে অপেক্ষা করছিলেন... কিছু বোঝার চেষ্টা। যেন একটি ছাত্র পড়া করে এসে শিক্ষককে ইমপ্রেস করার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে, বিষয়টাতে তার না আছে বোধ, না আবেগ। স্মার্ট, কিন্তু নার্ভাস, অপরিণত।’
কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্রকে সুকৌশলে বাজারে নামিয়ে এনেছেন ওবামা। প্রমাণ করেছেন, সোনিয়া গান্ধী শুধু তাঁর ছেলের জায়গাটা নিরাপদ রাখার খাতিরে এমন একজন প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচন করেছিলেন, যাঁর মতো যোগ্য কিন্তু নির্বিবাদী মানুষ গোটা ভারতে পাওয়া যাবে না। মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রিত্ব দেশে ‘উদার গণতন্ত্র’ নিয়ে আসেনি। বরং ওটা ছিল একটা ব্যতিক্রম মাত্র। মনমোহন নিজেও সেটা জানতেন। বুঝতেন। আর তাই পদে পদে থমকে যেতেন।
ভারতের রাজনীতিতে ক্ষমতাশালী এবং ‘অসহায়ে’র মধ্যে সরাসরি একটা বিভাজিকা টেনে দিয়েছেন বারাক ওবামা। বিতর্ক হওয়াটা তাই স্বাভাবিক। কিন্তু বই প্রকাশের আগেই এই বিতর্ক কেন? নেগেটিভ পাবলিসিটি কখনও কখনও ইতিবাচক প্রচারকেও ছাপিয়ে চলে যায়। ভারতের মতো শিক্ষিত বাজারে একটা ‘প্রি বুকিং’ বিতর্ক ছড়িয়ে দিতে পারলে তার লাভের গুড় প্রকাশক প্রথম কয়েক দিনেই ঘরে তুলে নেবে। ফলে বিতর্ক ছড়িয়ে দেওয়াটা স্ট্র্যাটেজি হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কী আছে, আর কী নেই... এটা শুধু হাওয়ায় ছড়িয়ে দাও। বাকিটা মার্কেট করে দেবে।
যেমন, শশী থারুর। দিন কয়েক আগে একটি ট্যুইট করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে এক লাইনও লেখেননি ওবামা। ঠিকই... তার একটা কারণও রয়েছে। ওসামা অভিযান... ২০১১ সাল। ওখানেই শেষ হয়েছে ‘আ প্রমিসড ল্যান্ড’-এর সফর। মানে এরপর আরও আসছে। দ্বিতীয় পর্ব। তখন হয়তো নরেন্দ্র মোদি থাকবেন। এবার বলেননি তিনি... কিন্তু বুঝিয়েছেন, ভারত সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। দিকে দিকে ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে মারামারি, জাতের নামে ভোট, হিংসা, দুর্নীতি... এর থেকে ভারত মুক্তি পায়নি। বই প্রকাশের পর ব্যাপারটা এমন হয়েছে, আমার ঘরে হচ্ছে হোক, পড়শি বলতে পারবে না। আমরা নিজেদের শুধরানোর চেষ্টা না করে তাই মার্কিন প্রেসিডেন্টের নামে গাল পাড়ছি। ওবামা নিজেও ধোয়া তুলসিপাতা নন, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই! নরেন্দ্র মোদির একটি শিক্ষিত এবং বিদেশি ব্র্যান্ড তিনি। প্রকৃত অর্থে বেচুবাবু। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। জানেন, কোনটা পাবলিক খাবে, আর কোনটা ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তাই হোয়াইট হাউসে প্রবেশের দিন থেকে তাঁর লক্ষ্য ছিল একজন—ওসামা বিন লাদেন। কারণ ওবামা বুঝেছিলেন, একটা ৯/১১ হামলা প্রত্যেক আমেরিকানের মনে ত্রাস, আর প্রতিশোধের এক বেমানান মিশ্রণ তৈরি করেছে। লাদেনকে খুঁজে বের করতে পারলে গোটা দেশের সেন্টিমেন্ট তাঁর দিকে ধেয়ে আসবে। সেটাই করেছিলেন তিনি। পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদের বাড়িতে ঢুকে নেভি সিল খতম করেছিল লাদেনকে। পাকিস্তান তার আগেও আমেরিকার বন্ধু ছিল। তার পরেও কিন্তু আছে। আল কায়েদা সুপ্রিমোর বিরুদ্ধে অপারেশনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন ওবামা। কিন্তু শুধু লাদেন কেন? পাকিস্তান তো সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর! মাসুদ আজহার, হাফিজ সইদদের তথ্যও নিশ্চয়ই আছে আমেরিকার কাছে। তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান কেন চালায়নি ওবামা প্রশাসন? কারণ ওই জঙ্গিরা তাঁর গায়ে আঁচড় দেয়নি। তাঁর আদর্শ যে অহিংসা! হোক না সে পরিস্থিতি বিশেষে। তাই তিনি লেখেন মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ, তাঁর হার না মানা লড়াই, সাদামাটা জীবনের কথা। তুলে ধরেন মিশেলের সঙ্গে মণি ভবনে যাওয়ার মুহূর্তগুলো। মুম্বইয়ের শহরতলিতে। সেখানকার গেস্টবুকে ওবামা দেখেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সই... ১৯৫৯ সালের। জুতো খুলে ঘরে ঢোকার পর প্রতিটা মুহূর্ত পাতায় এঁকেছেন ওবামা। মাটিতে করা বিছানা, চরকা, ছাদের দরজা বেয়ে নেমে আসা হালকা বাতাস, আর আবছা আলো। লিখেছেন, ‘ভীষণভাবে মনে হয়, যদি ওঁর পাশে বসতে পারতাম... কিছু কথা বলার ছিল... আর কিছু জিজ্ঞাসা... এত কম সামর্থ্যে এত বেশি কিছু করার শক্তি কোথায় পেয়েছিলেন? কীভাবে দেখেছিলেন এই স্বপ্ন?’
মহাত্মা গান্ধী কিন্তু সত্যের পক্ষে বা অনাচারের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইকে ব্যক্তিগত স্তরে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁর আন্দোলন দেশের সীমান্তে আটকে থাকেনি। দক্ষিণ আফ্রিকাতেও বর্ণবিদ্বেষ ও শ্রেণী বিভাজনের বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলন ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। আর ওবামা? সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে গোটা বিশ্বকে এক হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই আহ্বান বক্তৃতাতেই তালাবন্দি থেকে গিয়েছে। হুমকি দিয়েছেন, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেবে আমেরিকা। কিন্তু যুগ যুগ কেটে গেলেও তাতে সিলমোহর পড়েনি। সেদিন ডিনারের আগে কিছুক্ষণ মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছিলেন ওবামা। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকার কেউ ছিল না। কেউ নোট নিচ্ছিল না। মনমোহন তাঁকে বলেছিলেন লস্কর-ই-তোইবার কথা। জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের যোগসাজশের কথা। ওবামা লিখেছেন, ‘হামলার পর পাকিস্তানকে পাল্টা আক্রমণের যে চাপ তৈরি হয়েছিল, তা বহু কষ্টে রুখেছিলেন মনমোহন। কারণ ওটা সমাধান নয়। যার মাশুল তাঁকে দিতে হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে। মনমোহনের ভয় ছিল, মুসলিম বিরোধী আক্রোশ যেভাবে বাড়ছে, তার সুযোগ নেবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী পার্টি বিজেপি। বলেছিলেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট... কখনও কখনও ধর্মীয় জোট সমাজের কাছে বিষাক্ত হয়ে ওঠে। আর রাজনীতিকরা তার সুযোগ নেয়। ভারতে... অন্য দেশেও।’ দূরদর্শী ছিলেন মনমোহন। বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্থান যে তারপরই! পাকিস্তান বিরোধী সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে। ২০১৬ সালে ভারত সফরে এসে বারাক ওবামা সরব হয়েছিলেন ধর্মান্তরকরণ, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে...। মোদির সামনেই। কাজেই এরপরের অধ্যায় নিয়ে তিনি যদি কলম ধরেন, বিজেপিকে স্বস্তিতে রাখার মতো পরিস্থিতি হয়তো তৈরি হবে না।
স্বস্তিতে থাকবেন না নরেন্দ্র মোদিও।