সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
সাপ খোলস ছেড়ে গর্তে ঢুকলেই নিশ্চিন্ত। গর্তই সাপের নিরাপদ আশ্রয়। তখন সাপের ছেড়ে যাওয়া খোলসকে ঘিরেই যত আতঙ্ক। এরাজ্যে সাপকে নয়, তার ছেড়ে যাওয়া খোলসকেই বিপজ্জনক বলে দেখানোর মরিয়া চেষ্টা শুরু হয়েছে। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, বহু মানুষ খোলসকেই মূল বিপদ ভাবছেন। সাপ থেকে যাচ্ছে চোখের আড়ালে।
‘রাম নাম জপ করে দস্যু রত্নাকর বাল্মীকি হয়েছিলেন। তাই পঞ্চায়েত প্রধানকে শুধরে নেওয়ার দায়িত্ব নিশ্চয়ই দল নেবে। তবে, শুদ্ধিকরণের প্রয়োজন আছে, এটা নিশ্চিত।’ কথাগুলি বিজেপির পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সহ সভাপতি প্রলয় পালের। নন্দীগ্রামের বয়লা ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের অভিযুক্ত প্রধান পবিত্র করের বিজেপিতে যোগদান ঘিরে
অস্বস্তি এড়াতেই তাঁর এই মন্তব্য। এই পবিত্রবাবুর বিরুদ্ধেই ক্যানেল সংস্কারের মাটি লক্ষ লক্ষ টাকায় ইটভাটায় বিক্রি করার অভিযোগ জানিয়েছিলেন প্রলয়বাবু। ‘মাটি মাফিয়া’র তকমা লাগিয়ে যাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল, তাঁকেই কলকাতায় ঘটা করে বিজেপিতে যোগদান করানো হয়েছে। আর তাতেই ফের কাঠগড়ায় বিজেপির ‘স্বচ্ছতার রাজনীতি’। প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপি কি তাহলে গঙ্গাজল? যার ছোঁয়ায় মুছে যায় দুর্নীতির দাগ!
রাজ্যের পরিবর্তনে নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনের ভূমিকা সকলেই স্বীকার করেন। সেই নন্দীগ্রামের তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধান এবং উপ-প্রধানকে দলে যোগদান করিয়ে শাসক শিবিরে ভাঙন ধরিয়েছে বলে দাবি করছে বিজেপি। তবে প্রধানের এই দলবদল বিজেপিকে যতটা না গৌরবান্বিত করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি অস্বস্তির মুখে দাঁড় করিয়েছে। কারণ তারাই এই পবিত্রবাবুর বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে বিচার চেয়েছিল। যদিও দলত্যাগী প্রধানের দাবি, তিনি ১০০ টাকার দুর্নীতিও করেননি। সমস্ত অভিযোগই মিথ্যে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি বহুদিন সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত। বিজেপিই তাঁর ‘প্রাণের দল’।
প্রলয়বাবু অবশ্য মাটি বিক্রি ও দুর্নীতির অভিযোগ থেকে সরতে নারাজ। তবে তাঁর মতে, বিজেপিতে থাকলে দুর্নীতির কালো দাগ উঠে যাবে। কারণ রাম নামেই রত্নাকর দস্যু থেকে বাল্মীকি হয়েছিলেন। দুর্নীতিমুক্ত করার উপায় ও পদ্ধতি তাঁদের জানা আছে।
অভিযোগকারী এবং অভিযুক্তের এমন সহাবস্থান বিজেপিতে অবশ্য নতুন কিছু নয়। বরং ঘটনার পরম্পরা বলছে, গেরুয়া শিবিরে এটাই ‘কালচার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৫ সালে ‘ভাগ মুকুল ভাগ’ স্লোগান দিয়ে তৃণমূল বিরোধী লোকজনের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিং। এরাজ্যের দলীয় পর্যবেক্ষক হিসেবে যখনই তিনি কোনও সভায় বা সমাবেশে ভাষণ দিতেন তখন মুকুলবাবুকেই বেশি আক্রমণ করতেন। আর যখনই তিনি ‘ভাগ মুকুল ভাগ’ বলতেন, করতালিতে ফেটে পড়ত সভাস্থল। সেই মুকুলবাবুই এখন বিজেপির সর্বভারতীয় সহ সভাপতি।
২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাকমুহূর্তে বিজেপি অফিস থেকে স্ট্রিং অপারেশেনের ভিডিও দেখানো হয়েছিল। তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। ভিডিওতে তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক নেতা মন্ত্রীর সঙ্গে তৎকালীন কলকাতা পুরসভার মেয়র তথা মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়কেও টাকার বান্ডিল হস্তগত করতে দেখা গিয়েছিল। তারপর সেই টাকা তোয়ালে ঢেকে ফেলার দৃশ্য লক্ষ লক্ষ মানুষের হাসির খোরাক জুগিয়েছিল। শোভনবাবু এখন গেরুয়া শিবিরের শোভাবর্ধনকারীদের অন্যতম। নতুন দলে যোগদানের পর ১৪ মাস অতিক্রান্ত হলেও তিনি বিজেপির হয়ে মাঠে নামেননি। ফলে চিন্তায় পড়েছে গেরুয়া শিবির। নির্বাচন কড়া নাড়ায় তাঁর মান ভাঙাতে ময়দানে নেমেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। শোনা যাচ্ছে, তাঁর বাড়িতে দিলীপবাবু মধ্যাহ্নভোজন সারবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় বরফ নাকি আপাতত গলেছে। তবে, না আঁচালে বিশ্বাস নেই!
একটা সময় পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিস সুপার ভারতী ঘোষের বিরুদ্ধে বিজেপির অভিযোগের অন্ত ছিল না। খোদ দিলীপবাবু বহুবার তাঁকে ‘তৃণমূলের জেলা সভাপতি’ বলে কটাক্ষ করেছেন। সেই সময় বিজেপি কর্মীদের যতটা না তৃণমূল নেতাদের উপর রাগ ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষোভ ছিল ভারতী ঘোষের উপর। কারণ বিজেপি মনে করত, ভারতী ঘোষের গেম প্ল্যানেই তৃণমূল কংগ্রেস খড়্গপুর পুরসভার ক্ষমতা দখল করেছিল। কিন্তু ভাগ্যের এমনই ফের, সেই ভারতী ঘোষই এখন বিজেপির নেত্রী।
এসব দেখে অনেকেই ঠাট্টা করে বলছেন, যার সঙ্গে চটে তার সঙ্গেই পটে, কথাটা বোধহয় বিজেপির জন্যই খাটে। যাঁদের সঙ্গে খটাখটি হয়েছে তাঁদেরই বিজেপি দলে টেনে নিয়েছে। একসময় আসানসোল থেকে কোচবিহার, নন্দীগ্রাম থেকে ঝাড়গ্রাম যাঁদের মাটি মাফিয়া, কয়লা মাফিয়া বলেছে, তাঁদেরই বিজেপিতে নিয়েছে অথবা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। ক্ষমতা দখলের জন্য দল বাড়াতে গিয়ে বারে বারে হোঁচট খাচ্ছে বিজেপির ‘স্বচ্ছতার রাজনীতি’র স্লোগান।
এখন দিলীপবাবুর টার্গেট ছাত্রধর মাহাত। জনসাধারণের কমিটির এই নেতা জেল থেকে বের হয়ে তৃণমূলে যোগ দিতেই ফুঁসে উঠেছিল বিজেপি নেতৃত্ব। ছত্রধরবাবুকে মাওবাদী আখ্যা দিয়ে রাজ্যে শাসক দলের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছিল। সেই ছত্রধর মাহাতকে পাশে পাওয়ার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি। প্রথমে গরম, তারপর নরম। কেস রিওপেন করে কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে ডেকে পাঠিয়ে দমিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু, ছাত্রধর মাহাত ঘাড় ঝোঁকাননি। তারপরই গোপীবল্লভপুরে এক জনসভায় দিলীপ ঘোষের গলায় শোনা গিয়েছে একেবারে উল্টো সুর।
দিলীপবাবু উদাত্ত কণ্ঠে ছত্রধরবাবুকে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি ছত্রধর মাহাতকেও বলছি, আপনি যে লড়াই করেছেন, তা মানুষের জন্য করেছেন। কিন্তু যার জন্য করেছেন সে আপনাকে জেলে পাঠিয়েছে। আপনি আমাদের প্রতিনিধি ছিলেন। আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। এটা জঙ্গলমহলের মানুষ মানবে না। পাহাড়ে বিমল গুরুংয়ের বিরুদ্ধে, জঙ্গলমহলে আপনার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা দেওয়া হয়েছিল। মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। তাই পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোটে তৃণমূলকে গোহারা হারিয়ে বিজেপিকে জিতিয়েছিল। যাঁরা অত্যাচারিত, প্রতারিত হয়েছেন, তাঁরা আসুন। আমি আহ্বান করছি, ভারতীয় জনতা পার্টি আপনাদের সম্মান দেবে, অধিকার দেবে। আমরা যা বলি, তাই করি।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যাঁর গায়ে মাওবাদী তকমা
এঁটে দিয়েছিল, সেই ছত্রধর মাহাতকে বিজেপি দলে টানতে চাইছে কেন?
রাজনৈতিক মহল মনে করছে, এর পিছনে তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিমল গুরুং সমর্থন জানাতেই পাহাড় সহ উত্তরবঙ্গে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বিজেপি। দ্বিতীয়ত, শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিনা পয়সার রেশন এবং মাওবাদীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে মুখ্যমন্ত্রী চাকরি ও টাকা দেওয়ায় জঙ্গলমহলের ক্ষোভ দূর হচ্ছে। বাড়ছে সমর্থন। তৃতীয়ত, ছত্রধর মাহাত তৃণমূলের হয়ে ময়দানে নামায় জঙ্গলমহলে আদিবাসী জনজাতি গোষ্ঠীর অভিমুখও একটু একটু করে বদলাতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় বিজেপি বুঝেছে, ছাত্রধরকে জেলে ভরতে অথবা কাছে টানতে না পারলে জঙ্গলমহলে ভালো ফল একপ্রকার অসম্ভব। দিলীপবাবু জঙ্গলমহলের সন্তান হওয়ায় সম্ভবত সেটা আগাম টের পাচ্ছেন।
ছত্রধরের কথায়, ‘আমার জেলে থাকার বিষয়টি সামনে রেখে বিজেপি আদিবাসী জনজাতি
গোষ্ঠীকে ভুল বুঝিয়ে লোকসভা ভোটে ফায়দা তুলেছে। আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে সেই ভুল ভাঙানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। তাই সিবিআইকে দিয়ে বিজেপি আমাকে জেলে ভরার ভয় দেখাচ্ছে। তবে এসব করে আমাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করা যাবে না।’
বিরোধীদের দলে টানার কৌশল হিসেবে বিজেপির ‘রাবরি’ থিওরি বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। রাবরি তৈরির সময় আগুনের গনগনে আঁচে দুধ ফোটানো হয়, আর উপরে দেওয়া হয় পাখার বাতাস। বহু ক্ষেত্রেই এই থিওরি কাজে লাগিয়ে বিজেপি ফলও পেয়েছে। জেলযাত্রার ভয়ে অনেক মান্যিগণ্যিই আত্মসমর্পণ করেছেন। তবে, ছত্রধরের ক্ষেত্রে এই কৌশল খাটা কঠিন। কারণ জেলে যাওয়ার ভয় তাঁরাই পান, যাঁরা জেল খাটেননি কখনও। আট বছর জেলে থাকায় ছত্রধর সেই ভয় থেকে মুক্ত। উল্টে তাঁর সামনে এসেছে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ। সেই সুযোগ তিনি কিছুতেই হাতছাড়া করবেন না।