সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
পর্ব- ৪৮
ছায়া দেবীর বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত মা কালী ছিল। তিনি জাঁকজমক করে কালীপুজো করতেন। নিমন্ত্রিত অতিথিদের নিজের হাতে ভোগ রান্না করে খাওয়াতেন। কাউকে হাত লাগাতে দিতেন না। হাঁটুর ব্যথায় হয়তো কাতর, তবু বারান্দায় বসে রান্না করেও খাইয়েছেন। জেদ ছিল প্রচুর। কোনও কিছুকেই তোয়াক্কা করতেন না ছায়া দেবী। মুম্বইয়ে অভিনেত্রী রামেশ্বরী দেবীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার গল্প বলছিলেন দেবশ্রী। ‘আমাকে ওঁর সামনে নিয়ে গিয়ে কনক বলেছিল, এ হল মাহেশ্বরী। আমি কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, কী বলছ কী, ও তো রামেশ্বরী। তাতেও নির্বিকারভাবে বলল, ওহ! ওই একই হল।’
অশোককুমারদের গঙ্গোপাধ্যায় পরিবার যেমন ছিল ছায়া দেবীর বাপের বাড়ির দিকের আত্মীয়, মুম্বইয়ের শশধর মুখোপাধ্যায়দের সঙ্গেও একটা পারিবারিক সম্পর্ক ছিল তাঁর। শশধরের বড়দা রবীন্দ্রমোহনের ছেলে রাম মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল দেবশ্রীর মেজদি কৃষ্ণার। গায়িকা হিসেবে তখন কৃষ্ণার বেশ নাম। পরবর্তীকালে তিনি পরিচিত হন অভিনেত্রী রানি মুখোপাধ্যায়ের মা হিসেবে। ছায়া দেবী ছিলেন রামের পিসিমা। দেবশ্রী রায়ের যেমন প্রথম ছবি ছায়া দেবীর সঙ্গে, তেমনই আবার ছায়া দেবীর শেষ ছবির নায়িকাও ছিলেন দেবশ্রী। ‘তোমার রক্তে আমার সোহাগ’। সেটা ১৯৯৩। পরিচালক রাম মুখোপাধ্যায়। ছায়া দেবীর কাছে তিনি আদরের রামু। সেই সময় অভিনয় প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। হাঁটুর ব্যথায় তখন ভালো করে দাঁড়াতেও পারেন না। তবু রামুর ছবি শুনেই করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। ছবির আউটডোর ছিল হলদিয়ায়। ভোরবেলায় ওঠার অভ্যাস ছিল তাঁর। সকাল হতেই বটুয়া নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। তারপর চানাচুরের প্যাকেট নিয়ে হয়তো ফিরলেন। রামু যে চানাচুর ভালোবাসে। আউটডোরে যে ক’দিন ছিলেন প্রতিদিনই সকালে গেস্ট হাউসের কাছের একটা দোকান থেকে রামুর জন্য কিছু না কিছু খাবার কিনে আনতেন। ইউনিটের কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘রামুর জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছি। সহ্য হচ্ছে না বুঝি!’
রান্না করতে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনই খেতেও ভালোবাসতেন খুব। উত্তর কলকাতার শিঙাড়া, কচুরি, আলুর চপ, জিলিপি ছিল ভীষণ প্রিয়। মিষ্টির মধ্যে ভালোবাসতেন কালাকাদ। ‘মনে পড়ে হেদুয়ায় কনকের বাড়ি গিয়ে বটুয়া থেকে পয়সা বের করে জিলিপি-কচুরি খাওয়া আর আড্ডা। কত যে মজার কথা, কী বলব! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই কনককে একটু উস্কে দিতাম। ব্যস শুরু হয়ে যেত মজার মজার সব কথা। কত গল্প। আসলে মানুষটাই ছিল আদ্যোপান্ত উন্মুক্তমনা। কমেডি সেন্সও ছিল অসাধারণ। সে এমনি গল্প করাই হোক বা অভিনয়। ওঁর কথা শুনে আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম,’ এখনও অমলিন দেবশ্রীর স্মৃতি। ফ্লোরে অভিনেত্রী ছায়া দেবীকে দেখে দেবশ্রী মাঝে মাঝে জানতে চাইতেন যে, তিনি এত ন্যাচারাল অ্যাক্টিং করেন কী করে? উত্তরে বলতেন, ‘ওটা হয়ে যায় বুঝলি। অভিনয়কে ভালোবাসতে পারলে গোটা ব্যাপারটাই বেশ সহজ হয়ে যায়।’ শিল্প নির্দেশক সূর্য চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল ছায়া দেবীর। ‘সূর্য বেইমানি করেছে। শিগগির আয়,’ ফোন করে দেবশ্রীকে ডেকে পাঠালেন। দেবশ্রী সাত তাড়াতাড়ি পৌঁছতেই তিনি বলেন, ‘ওদের বাড়ির একটা বিয়েতে গিয়েছিলুম। মেনুতে যা যা লেখা ছিল, সবই খাওয়াল। কিন্তু জানিস আমাকে চাটনি আর পাঁপড় দেয়নি। এটা বেইমানি নয়!’ এই হাসিখুশি মানুষটাই শেষদিকে কেমন বদলে গিয়েছিলেন। ‘দেখতাম, মাঝে মাঝেই চুপ করে বসে আছে। কিন্তু কোনওদিন একাকিত্বের কথা, দুঃখ, আক্ষেপ করতে শুনিনি। আমাকে বলত, জীবনে কখনও হার মানবি না। যাই আসুক মেনে নিবি,’ এখনও তাঁর পরামর্শ স্মরণে রয়েছে দেবশ্রীর।
আশি সালের মাঝামাঝি অভিনয় জীবনের পঞ্চাশ বছর উদযাপন করবেন আঁচ করে সাংবাদিকরা ছায়া দেবীর বাড়িতে গিয়েছিলেন। দেখাই করেননি তিনি। দাঁত-কিড়মিড় করে উঠেছিলেন, ‘ওরা কোত্থেকে জানল পঞ্চাশ হল না, একশো! দূর হ।’ পাবলিক লাইফ পছন্দ করতেন না, তাই বলে নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছিলেন এমন নয়। ওঁকে যখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ডি-লিট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন যাওয়ার ইচ্ছেপ্রকাশ করেছিলেন। জোড়াসাঁকোয় ছিল অনুষ্ঠান। কিন্তু সেই ডি-লিট আর তাঁর নেওয়া হয়নি। ২০০১-এ অ্যাটাকটা হল। দেবশ্রী তখন ‘শিল্পান্তর’ ছবির আউটডোর শ্যুটিংয়ে পুরুলিয়ায়। ছায়া দেবী শ্যামবাজারের ড্রিমল্যান্ড নার্সিংহোমে ভর্তি হলেন। শ্যুটিংয়ে দেবশ্রীর মুখে র্যাশ বেরয়। তাঁকে কলকাতায় আসতে হয় দু’দিনের জন্য। একেই বোধহয় বলে আত্মার টান। তবে মন না চাইলেও আবার শ্যুটিংয়ে যেতে হল দেবশ্রীকে। যাওয়ার আগে মুখে গঙ্গাজল দিয়েছিলেন তিনিই। পুরুলিয়া থেকে ফিরে আর কনককে দেখতে পাননি তাঁর আদরের চুমকি।
২৫ এপ্রিল ২০০১। সব শেষ। তবে একলা নারী মানেই সে অবলা নয় বা সমাজে করুণার পাত্রী নয়, অতদিন আগেও নিজের জীবনবৈচিত্র্যে প্রমাণ দিয়েছিলেন ছায়া দেবী। প্রায় ষাট বছরের অভিনয় জীবন। তাঁর জীবনটাই যেন একটা সিনেমা। একটা সেলিব্রেশন। ব্যক্তিগত জীবনে মা হতে না পারলেও বাংলা ছবির ইতিহাসে তাঁর থেকে উজ্জ্বল মা আর কোথায়!
অলঙ্করণ: চন্দন পাল