সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
বহুদিন থেকেই মনে ইচ্ছে ছিল একবার বাংলাদেশ যাব। তিন বাঙাল ও এক ঘটি মিলে একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা পৌঁছলাম। শহিদ দিবস নিয়ে আজ আর নতুন করে বলার কিছু নেই। বাঙাল-ঘটি দু’দলের কাছেই এই দিনটি গর্বের।
আমার নিজের ভালো লাগার আলাদা গোপন কারণটি হচ্ছে বহুদিন বাদে প্রাণভরে বাঙাল ভাষা শুনলাম ক’দিন আর নানা ভাষার বিভিন্ন শব্দকে নিজস্ব ঢংয়ে কাটছাঁট করে নেবার অপূর্ব ক্ষমতাটি বাঙালের একই আছে দেখে নিশ্চিন্ত হলাম।
বিশেষ করে ইংরেজি শব্দকে ঘুরিয়ে অন্যরকম করে দিতে খাঁটি বাঙালের বিশেষ সময় লাগে না। আমাদের বাড়িতে এক সুপ্রাচীন ঠাকুমা আসতেন। মা জেঠিমারা তখন মিটসেফকে মিসচেফ, কোলাপসিব্ল্ গেটকে কোলাপসুল গেট, টম্যাটোকে টমেটু বলেন। সেই ঠাকুমা একান্নবর্তী বাড়ির তরকারি কোটার আসরে একটা টম্যাটো হাতে তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আপন মনেই বললেন, ‘আগে কইত বাইগুন, তারপর কয় বিলাইতি বাইগুন। এখন কয় মন্টু।’
কোন শব্দ কার কানে কী যে বাঁশরি শোনায় বোঝা মুশকিল।
বাঙাল বাড়িতে প্রথম টিভি আসার দিন ছেলেপিলেরা বিদেশের অনুষ্ঠান দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলে পর মেকানিকটি অচেনা একটা ইংরেজি শব্দ বলে চলে গেল। অমনি বাড়িসুদ্ধ সবাই বায়না ধরল ‘বুচিস্টার’ চাই। বোঝা গেল মেকানিকের দেশও পদ্মাপারে। নয়তো এত অনায়াসে বুস্টারকে হজম করে নতুন শব্দ বানাতে পারত না।
ঢাকায় আমরা যেখানে উঠেছিলাম সেই অতিথিশালার সেবক একদা প্যারিসে ছিল। আমিও প্যারিসে গিয়েছি শুনে উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, সঞ্জলি বড় সুন্দর, না?
খুব আপসোস হল। প্যারিস গেলাম অথচ এমন জায়গাটা দেখা হল না। সে আমার দুঃখ দূর করার জন্য বর্ণনা শুরু করতেই বুঝতে পারলাম- সাঁজেলিজে।
স্টিমারে বরিশাল যাবার পথে খাদ্যতালিকায় ‘পিচ’ প্রতি কতরকম মাছের দাম দেখেছিলাম। ‘ফুস্কাও’ ছিল তার মুচমুচে ‘চ’ বর্ণটিকে হারিয়ে।
আমাদের সারথিটি ছিল অতি চমৎকার। সারা রাস্তা গানে গল্পে ভরিয়ে রেখেছিল। এর ‘ভাইডি’ আবার ভয়ানক বলিউড ভক্ত। তাদের অতীত বর্তমান সব নখদর্পণে। ‘শেফালি খানে’র আগের পক্ষের মেয়েকে চিনি নাকি জিজ্ঞেস করছিল।
—শাহরুখ খান?
—না না শেফালি খান।
—ছেলে না মেয়ে?
—কী যে কন-মাইয়া হইব কোন দুঃখে?
ছেলে হবার সুখটা জানি না বলে মাইয়া হওয়ার দুঃখটাও বুঝলাম না। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে জানি না বলায় সে আশ্চর্য হয়ে তার পরিচয় দিতেই চিনতে পারলাম— সইফ আলি খান।
বাঙাল বলবে, ফ্যানটা একটু ছেড়ে দেবে?
ঘটি বলবে, পাখাটা গোরু না ঘোড়া যে ছেড়ে দেব?
বাঙাল যেমন জীবনে বুঝবে না সে দরজা দেবে কেন? দরজা কি দেবার জিনিস?
স্বাধীনতার পরপর এ বঙ্গের একটু ঘাবড়ে থাকা বাঙালরা প্রাণপণে জিভের শত্রুতা চাপা দিতে পারলেও ভাষার খাঁজখোঁজে এভাবেই আটকে গিয়ে ধরা পড়ে যেত। তারপর এদেশের নরম হাওয়ায় বাঙাল জিভ অনেক মোলায়েম হয়ে এল। একেবারে খেলুম, গেলুম পার্টি না হলে তফাৎ করা মুশকিল।
সেই সময় ঘটি না বাঙাল বোঝার জন্য একটা সহজ পথ ছিল— জিজ্ঞেস করা হতো কোয়েশ্চেনের বাংলা কী?
উত্তরে ‘প্রশনো’ বললেই হয়ে গেল। ছোটবেলায় রাস্তায় বেরলে পাড়ার ছেলেরা নানাভাবে খ্যাপাত। একবার সঙ্গে ঠাকুমা ছিলেন। সংসারে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত তেজস্বিনী মহিলা। তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে এই ঘোরতর অন্যায় সংলাপের প্রতিবাদ জানালেন। আমরা সংকুচিত হয়ে হাত ধরে টানাটানি করতে তিনি সগর্জনে বললেন, ‘কা হেতিরা কইব চিঙ্গড়ি মাছের কাঙ্গাল? বাঙ্গালরা যত মাছ দেখছে, খাইছে হেতিরা তত চোখে দেখছেনি?’
এই যে নিঃসংকোচে আত্মপরিচয় দিয়ে বাঙাল সংলাপ লিখে ফেললাম তার কারণ হচ্ছে বাংলা ভাষার যতই দুরবস্থা ঘটুক না কেন বাঙাল ভাষা কিন্তু বেশ গ্ল্যামারাস হয়ে উঠেছে। বাঙাল পরিচয়েরও শাপমুক্তি ঘটেছে।
বাঙাল পরিচয়ের জয়ধ্বজা তুলে সিংহ বিক্রমে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম কৃতিত্ব অবশ্যই অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বাঙাল ভাষায় একটার পর একটা কমিক পেশ করে ঘটি-বাঙাল দু’দলকেই তিনি কাবু করে ফেলেছিলেন। বাঙালত্ব নিয়ে ঠাট্টা করা এক ঘটিকে তাঁর বিখ্যাত উক্তি— আমি তো বাঙাল আপনি কী?
—বাঙালি।
—তবেই দ্যাখেন, আমি বাঙাল, পুংলিঙ্গ। আপনি বাঙালি, স্ত্রীলিঙ্গ।
মনে করুন মুজিবর রহমানের সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতা— ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’। অতি বড় বাঙাল বিদ্বেষীও স্বীকার করবে এই ভাষার জোর।
ভাষার জোর বুঝতে গেলে অবশ্য অত দূর না গেলেও চলে। কারওকে বধ করতে হলে গুলির দরকার নেই বাঙাল ভাষার গালিই যথেষ্ট। ‘লাত্থি’র যা জোর তা ‘লাথি’ কল্পনাও করতে পারবে না। ‘থাবড়া’র কাছে চড় নেহাতই বালখিল্য।
এ ব্যাপারে সর্বোত্তম গল্পটি বলেছেন বরিশালের কৃতী সন্তান তপন রায়চৌধুরী। বরিশালে পর্তুগিজ পত্তনির কারণে সেখানকার বেশ কিছু নাম হতো পর্তুগিজ। যেমন গোমেজ আল্ভারেজ ইত্যাদি। সেই সময়ে যাঁরা রোমান ক্যাথলিক হয়েছিলেন তাঁদের বংশধর।
তোমরা কী জাত? এই প্রশ্নের উত্তরে তারা বলতেন ‘আইগ্গা মোরা রোমাই কাত্তিক।’ একদা কার্তিক সম্প্রদায় প্রচণ্ড উৎসাহে কালীপুজো করছে দেখে জিজ্ঞেস করা হল— ‘কালীপুজা করতে আছ? তরা না রোমাই কাত্তিক?’
আল্ভারেজ কোম্পানি ক্ষোভে ফেটে পড়লেন— ‘রোমাই কাত্তিক হইছি দেইখ্যা কি আমাগো জাত গ্যাছে?’
ধর্মের সঙ্গে জাতের যে সম্পর্ক নেই সেটা বীর বাঙাল প্রমাণ করে দিয়েছে।
আমাদের ঘটি বন্ধু প্রেম করে বিয়ে করেছে বাঙালকে। ক’দিন বাদে কোনও আত্মীয়া মধুর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করে নতুন বউ?’
বাঙাল শাশুড়ির চাঁচাছোলা উত্তর, ‘ঘুম মারতাসে।’
চল্লিশ বছর আগের বাঙালি সংসারের চালচিত্রে নতুন বউ এখনও উঠে কাজে লাগেনি, এই অনিয়মটা শুধু ঘুমচ্ছে বললে কি বোঝা যেত?
হ্যাঁ ভাই , না ভাই , নেবু, নুচি, নঙ্কার মতো মিঠে বুলি আজ আর শোনা যায় না। ডেড়টা, বারন্ডা, গেলাস বলা ঘটিও প্রায় অমাবস্যার চাঁদ। সে সব স্পেশাল বাঙালরাও কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে, যারা যে কোনও শব্দকে নিজের ইচ্ছেমতো চেহারা দিয়ে বাজারে ছেড়ে দেবার মতো বেপরোয়া ও স্মার্ট ছিল।