সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
ছায়া দেবীর খাওয়া দাওয়া ছিল বড় অদ্ভুত রকমের। কেমন সে সব খাবার? হয়তো শুধুই মাংস খেলেন। তার সঙ্গে রুটি, ভাত বা পাউরুটি কিছুই না। কোনও কোনওদিন আবার মাংসের সঙ্গে কমলালেবু খেলেন। ব্যাস খাওয়া কমপ্লিট। ছায়া দেবীর খাদ্যাভ্যাসের এই মজার দিকটিও বললেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। ‘বিকেলবেলা কখনও হয়তো ছোলাভাজা খেতেন। সেটা ছায়াদির সঙ্গে আমিও মাঝে মাঝে খেয়েছি,’ বলছিলেন তিনি। তবে ভাগ্যবানরা ছায়া দেবীর রসিক রূপও দেখেছেন। বিকাশ রায়ের সামনে একবার শ্যুটিংয়ে তিনি ক্রেনের উপর উঁচু চেয়ারে উঠে বসে পড়েন। সকলে অবাক হতেই তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘বড় ইচ্ছে, উপর থেকে সকলকে কেমন লাগে একবার দেখি। তাই একটু বসেছি এখানে।’
‘সুবর্ণলতা’ ছবিতে মাধবীর শাশুড়ির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ছায়া দেবী। পর্দায় ওইরকম দজ্জাল রূপ, আর অন্যসময় যেন মাটির মানুষ। লাঞ্চব্রেকে নানা গল্প বলতেন। ছায়া দেবীর মুখে ওইরকম একদিনের লাঞ্চব্রেকেই ‘বিদ্যাপতি’ ছবির সেটের গল্প শুনেছিলেন মাধবী। তখন তো গ্লিসারিন দিয়ে চোখে জল আনার রেওয়াজ ছিল না। কানন দেবী বললেন, আমাকে পাঁচ মিনিট দিন। তারপর চোখে জল নিয়ে এলেন। এই দেখে ছায়া দেবীও কাঁদার জন্য পাঁচ মিনিট চাইলেন। কিন্তু কান্না তো আর আসে না। একসময় ভেবেছিলেন চোখে লঙ্কাবাটা ডলবেন, কিন্তু তাতে চোখে জল আসবে, কান্না নয়। ‘আসলে অভিনয় করতে গেলে চরিত্রটাকে অনুভব করতে হয়। পারিপার্শ্বিকতায় ডুব দিতে হয়। তখন আপনি আসে হাসি, কান্না, রাগ, দুঃখ,’ ছায়া দেবী বলেছিলেন মাধবীকে।
সুচিত্রা সেনের মতো ছায়া দেবীকেও কেউ কেউ ‘গ্রেটা গার্বো’ বলে ডাকতেন। আত্মপ্রচারে সায় নেই, ভিড়ভাট্টায় অনীহা। যেমন ব্যক্তিত্ব, তেমন মারাত্মক স্ক্রিন প্রেজেন্স। সুচিত্রা সেনের মতোই একসময় পাবলিক লাইফে অতিষ্ঠ হয়ে নিজেকে অন্তঃপুরে আটকে ফেলেছিলেন ছায়া দেবীও। শরীরের বয়সকে কোনওদিনই পাত্তা দিতেন না তিনি। কিন্তু শেষের দিকে মনের বয়সটা যেন তাঁকে বেজায় ঘায়েল করেছিল। নিজের চারপাশে একটা অদৃশ্য পাঁচিল তুলে দিয়েছিলেন। সাংবাদিক শুনলেই মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিতেন। বিভিন্ন সময় পাওয়া নানা পুরস্কার, মেডেল একদিন বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন। কোনওক্রমে ঘনিষ্ঠজনরা তাঁকে নিরস্ত করেন। ছায়া দেবী হতাশা ভরা গলায় নাকি বলেছিলেন, ‘কী হবে ওসব রেখে! পুরস্কার তো আজকাল কিনতে পাওয়া যায়।’ নিজের দুঃখের কথা যে তিনি বলে বেড়াতেন এমন নয়। কেউ বললেই বরং ফুঁসে উঠতেন। বলতেন, ‘যত আদিখ্যেতা! দুঃখ কার না আছে জীবনে।’
আত্মীয়স্বজন ছাড়াও ছায়া দেবীর ছিলেন দুই মানসকন্যা— তনুশ্রী রায় আর তাঁর বোন অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়। এই দুই বোন ঝুমকি-চুমকির কাছে ছায়া দেবী ছিলেন আদরের ‘কনক’। ভীষণ ভালোবাসতেন তাঁদের, একদম নিজের মেয়ের মতো। কোলেপিঠে করে দুই বোনকে বড় করেছিলেন তিনি। ছবি ছেড়ে দেওয়ার পরেও এই রায় পরিবারই আগলে রেখেছিল তাঁকে। দুই বোনই তাঁকে মায়ের থেকে আলাদা ভাবেননি। একেবারে ছোট্ট বয়স থেকে দেবশ্রী অভিনয় করেছেন ছায়া দেবীর সঙ্গে। পরিচালক হিরণ্ময় সেনের ‘পাগল ঠাকুর’ ছবিতে দেবশ্রী যখন অভিনয় করেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ১১ মাস। দেবশ্রীর মায়ের নাম আরতি। পরবর্তীকালে মায়ের মুখেই সেই শ্যুটিংয়ের গল্প শুনেছিলেন দেবশ্রী। শিশু দেবশ্রীর গাল টিপে ছায়া দেবী নাকি বলেছিলেন, ‘ভারী মিষ্টি মেয়ে তো তোমার আরতি। ওকে মাঝে মাঝে আমার কাছে নিয়ে এসো।’
এরপর দেবশ্রীর যখন বছর তিনেক বয়স, তখন তিনি আবার হিরণ্ময় সেনেরই ‘বালক গদাধর’ ছবিতে ছোট রামকৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ওই ছবিতে দেবশ্রীর মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ছায়া দেবী। তখন থেকেই দেবশ্রীর নিয়মিত যাতায়াত ১০ নম্বর মদন ঘোষ লেনে, ওঁর বাড়িতে। এরপর তরুণ মজুমদারের ‘কুহেলি’ ছবিতে দু’জনে একসঙ্গে কাজ করেন। চুমকির সব থেকে চর্চিত শিশুবেলার ছবি। দেবশ্রী ‘রাণু’, ছায়া দেবী ‘মানদাদি’। বিশ্বজিৎ-সন্ধ্যা রায়ের মেয়ের ভূমিকায় ছোট্ট দেবশ্রীর সেই নাচ আশা ভোঁসলের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’র সঙ্গে আজও আইকনিক শিশুনৃত্য। ‘কুহেলি’র বেশিরভাগ দৃশ্যেই ছায়া দেবীর কোলে চড়েই কেটেছে দেবশ্রীর। ‘মনে আছে কালিম্পঙে শ্যুটিং হয়েছিল। ওই সময় কনকই আমাকে অভিনয়, নাচ করা সব দেখিয়ে দিত। কী কী করতে হবে শিখিয়ে দিত। আবার শ্যুটিংয়ের ফাঁকে ঘুম পাড়িয়েও দিত,’ বলছিলেন দেবশ্রী।
দেবশ্রীর মা আরতির ফ্রেন্ড-ফিলোজফার-গাইডও ছিলেন ছায়া দেবী। মেয়েকে কীভাবে মানুষ করবেন বা যদি অভিনয়কে কেরিয়ার হিসেবে নেয় ছোট্ট চুমকি, তাহলেই বা কেমন করে এগবেন প্রায়ই সেসব নিয়ে নিজের সুচিন্তিত মতামত দিতেন তিনি। কনকের ইন্ডোর শ্যুটিং থাকলেও মেয়েকে নিয়ে সেই শ্যুটিং ফ্লোরে চলে যেতেন আরতি।
(ক্রমশ)