সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
ছোট থেকেই নাচ-গানে পারদর্শী ছিলেন ছায়া দেবী। পাশাপাশি অভিনয়ের জন্য সাঁতার কাটা আর ঘোড়ায় চড়াও শিখেছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি ছবিতে জলে ডোবার সিন ছিল। সেই দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়ে প্রায় জলে ডুবে মরতে বসেছিলেন তিনি। উপস্থিত সকলে চিৎকার করতে শুরু করলেন, ‘ধর,ধর ডুবে যাচ্ছে। ’সেবার জল থেকে উঠেই তিনি মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন যে, সাঁতার এবার তাঁকে শিখতেই হবে। ওঁর ছোটমামা ছিলেন খুব ভালো সাঁতারু। কলকাতার লেকে মামার কাছেই সাঁতার শিখতে শুরু করলেন তিনি। এই সাঁতার শেখা নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে ছায়া দেবী নিজেই বলে গিয়েছেন,‘আমি সাঁতার জানি কিনা এই প্রশ্ন কেউ আমাকে করলেই বলতে হতো, জানি না। তখন ভীষণ লজ্জা করত। তাই মামার কাছে কলকাতায় সাঁতার শিখতে শুরু করলাম। উত্তরপাড়ায় আমার মামার বাড়ি। বড়দিমণি সেখানে থাকতেন। ওখানে গিয়েও আমি সাঁতার শিখেছি। আমার সাঁতার শেখা দেখতে লোক জড়ো হয়ে যেত। প্রথম প্রথম তো কলাগাছ, টিউব যা দিচ্ছে সব নিয়েই ডুবে যেতাম।’
বাংলার পাশাপাশি ‘হিন্দি’ ছবিতেও সমান স্বচ্ছন্দ্য ছিলেন ছায়া দেবী। সঞ্জীবকুমারের অভিনয় খুবই পছন্দ করতেন তিনি। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘আলাপ’ ছবিতে সঞ্জীবকুমারের সঙ্গে কাজও করেছিলেন। নায়ক অবশ্য ছিলেন অমিতাভ বচ্চন। এই ছবি করার পর ছায়া দেবী খুব ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন অমিতাভের। রেখা, ওমপ্রকাশ, আসরানিরা থাকলেও অমিতাভের সঙ্গে একটা হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল তাঁর। এই ছবিতে সরযূ বাঈ বানারসওয়ালি চরিত্রে ছিলেন ছায়াদেবী। আর তাঁর ভাইঝি ঝুমুর গঙ্গোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন সরযূর ছোটবেলার চরিত্রে। তাঁর ভাই ললিতমোহনের মেয়ে এই ঝুমুর।
মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে মাকে নিয়ে থাকতেন ছায়া দেবী। বেরনোর সময় রোজ ‘মা আসছি’ বলে তবেই শ্যুটিংয়ে বেরতেন তিনি। মায়ের মৃত্যুর পর এই ঝুমুরই পিসি অর্থাৎ ছায়া দেবীর দেখাশোনা করতেন। দিল্লিতে ভাইয়ের বাড়ি গেলে অন্যান্য ভাইপো-ভাইঝিরা তাঁকে মাথায় করে রাখতেন।
তপন সিংহের মতো হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়কেও অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন ছায়া দেবী। বলতেন, ‘হৃষীকেশবাবু তো অভিনয়ের কিছু শেখান না। উনি টেকনিক্যালি যেমন সাউন্ড, তেমনই অসাধারণ এডিটর। ফলে ওঁর ছবিতে ওইসব দিকগুলো ছিল খুবই স্ট্রং। বেশির ভাগ হিট বাংলা ছবি হিন্দিতে করেই ওঁর বেশি নাম হয়েছে। বিশেষ করে তপনবাবুর হিট ছবিগুলো। হৃষীকেশবাবু মানুষ হিসেবেও খুবই ভালো ছিলেন।’
এত পরাক্রমশালী অভিনেত্রী হয়েও সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কোনও ছবি করা হয়ে ওঠেনি তাঁর। তবে বিশ্বখ্যাত এই পরিচালকের থেকে ডাক পেয়েছিলেন তিনি। ঘটনাটি বললেন সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধ্রুবময়ীর কাশীবাস’ গল্পটি নিয়ে এক ঘণ্টার একটি ছবি টিভির জন্য তৈরি করার কথা ছিল সত্যজিতের। ‘বাবা এই ছবিতে ছায়া দেবীর কথাই ভেবেছিলেন। কিন্তু যখন কাজ শুরু হবে, সেইসময় বাবা হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পরে ছায়া দেবীও বম্বে চলে গেলেন। শেষপর্যন্ত ছবিটি আর হলই না,’ এখনও আক্ষেপ রয়ে গিয়েছে সন্দীপের।
সিনেমায় দাপিয়ে অভিনয় করলেও কখনও নাটকে অভিনয় করতে দেখা যায়নি ছায়া দেবীকে। অথচ মানুষের চালচলন তাৎক্ষণিক নকল করে দেখাতে তাঁর জুরি ছিল না। তাহলে নাটকে কাজ করেননি কেন? এই কৌতূহলের নিরসনও নিজেই করে গিয়েছেন তিনি। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী খুব সম্ভবত কানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে তাঁর কাছে নাটকে অভিনয় করার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ছায়া দেবী পত্রপাঠ তাঁকে না করে দেন। ‘শিশিরবাবু সম্পর্কে শুনেছিলাম— উনি ভীষণ মদ খান। কী বলবেন, না বলবেন এইসব ভেবে আর কাজ করিনি। আসলে মদ্যপান ব্যাপারটা আমার একদমই ভালো লাগত না। পরবর্তীকালে অনুপকুমারও খুব করে ধরেছিল। প্রায় জোর করে থিয়েটারে টেনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমি রাজি হইনি। আসলে থিয়েটার করা আমার কোনওদিনই পছন্দ ছিল না। প্রম্পট করবে একজন, আর সেটা শুনে শুনে সংলাপ বলতে হবে! ভালো লাগত না আমার। তবে দুর্গাদাসবাবুর অভিনয় দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যেতাম,’ নিজের শেষজীবনে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ছায়া দেবী।
ভীষণ রেগে যেতেন আর একটি বিষয়ে। ‘ঠিক ১২টার সময় উনি লাঞ্চ করতেন। ৫-১০ মিনিট পেরিয়ে গেলেই পরিচালকের উপর রেগে যেতেন। আর খেতেনই না সেদিন,’ বলছিলেন ছায়া দেবীর স্নেহধন্যা অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়। মাধবীকে ডেকে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘শ্যুটিংয়ের মধ্যে একদিন তুমি আমার সঙ্গে খাবে?’ সাধারণত শ্যুটিংয়ের সময় বেশি কিছু কোনওদিনই খেতেন না মাধবী। কিন্তু ছায়া দেবী খেতে বলেছেন, না তো বলা যায় না। মাধবী সায় দিতেই তাঁর জন্য নিজে ডালের কচুরি তৈরি করে নিয়ে এসেছিলেন। অপূর্ব রাঁধতেন। দাদামণি অর্থাৎ অভিনেতা অশোককুমার কলকাতায় এলেও ছায়া দেবীর হাতে কচুরি খেতে চাইতেন। কিশোরকুমারের অসম্ভব প্রিয় ছিল চিংড়ি মাছ। মুম্বই গেলে কিশোরকুমারের জন্য চিংড়ির মালাইকারি তৈরি করে নিয়ে যেতেন ছায়া দেবী। কিশোর নিজে খেতেন, আর তাঁকেও খাওয়ার জন্য জোর করতেন।
(ক্রমশ)