সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
জঙ্গিপুর থেকে কী একটা কাজে দাদাঠাকুর মানে শরৎ পণ্ডিত এসেছেন কলকাতায়। উঠেছেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের পরিচিত একটি মেস বাড়িতে। একদিন সকালে এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে শিয়ালদার দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। হঠাৎই ছবিঘর সিনেমা হলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় থমকে দাঁড়ালেন। হলের সামনে থিকথিকে ভিড়। সেই হলে মুক্তি পেয়েছে সুধীর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ছবি ‘দাদাঠাকুর’। সেই ছবি দেখার জন্যই দর্শকদের প্রবল উৎসাহ। বাস্তবের দাদাঠাকুর স্বয়ং সেখানে উপস্থিত। অথচ তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখার ফুরসত বা ইচ্ছে কোনওটাই তাদের নেই। আজকের যুগে বাংলা বা হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে যেমন বায়োপিক তৈরির ধুম, সে যুগে তেমনটা ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। যদিও নিজের কর্মগুণে শরৎ পণ্ডিত জীবন্ত কিংবদন্তি ছিলেন, তবুও সে যুগে জীবদ্দশাতেই ‘বায়োপিক’ দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনাই বলা যায়।
হলের সামনে এহেন ঘটনা দেখে শরৎ পণ্ডিতকে তাঁর সঙ্গী বন্ধুটি বললেন, ‘দেখেছেন, আপনি বর্তমান থাকতেও আপনাকে না নিয়ে ছবি বিশ্বাসকে নিয়েছে আপনার রোলে।’ প্রসঙ্গত, পর্দায় দাদাঠাকুরের চরিত্রে রূপদান করেছিলেন ছবি বিশ্বাস। যদিও ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ‘দাদাঠাকুর’ ছবিটি যখন মুক্তি পায়, তখন ছবি বিশ্বাস আর ইহলোকে নেই। তার ঠিক পাঁচ মাস আগেই তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন। যাক সে কথা। আবার ফিরে আসি সেই ঘটনায়। বন্ধুর মুখে এই কথা শুনে তৎক্ষণাৎ দাদাঠাকুর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, ‘দুঃখ পেও না বন্ধু। ছবি দেখে লোকে বিশ্বাস করবে বলেই তো ছবি বিশ্বাসকে নেওয়া।’ পানিং মিশিয়ে কথাটা বললেও বাংলা ছায়াছাবির কিংবদন্তি অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের অভিনয় প্রতিভা ও জনপ্রিয়তার কথা শরৎ পণ্ডিতের এই লাইনটার মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
১৬০০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে মোগল সম্রাট আকবরের থেকে ‘বিশ্বাস’ উপাধি পেয়েছিলেন তিতুরাম দে। তাঁর উত্তরপুরুষ রামকান্তের পুত্র চণ্ডীচরণ দে বিশ্বাস পরবর্তীকালে বড় জাগুলিয়া থেকে উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের কাছে ছোট জাগুলিয়ায় এসে থাকতে শুরু করেন। বসতবাড়ির নাম রাখলেন ‘কালী নিকেতন’। আরও কিছুদিন পরে ব্যবসায়িক কাজকর্মের উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বাস পরিবার উঠে এল কলকাতার বিডন স্ট্রিটে। কালী নিকেতনের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে উঠে গেল না ঠিকই, তবে সেখানে যাওয়া-আসা আটকে গেল ওই পুজো-পার্বনেই। অর্থ-প্রতিপত্তি-দান-ধ্যান-ঐতিহ্য-বনেদিয়ানায় বিডন স্ট্রিটের বিশ্বাস পরিবারের নাম ক্রমে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। ৩৪ নম্বর বিডন স্ট্রিটের সেই বাড়ির কালীপ্রসন্ন বিশ্বাসের ছোট ছেলে ভূপতিনাথ পাট ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ নাম করেছিলেন। কালীপ্রসন্ন এই বিডন স্ট্রিটেরই বাসিন্দা প্রতাপচন্দ্র মিত্রের কন্যা কাত্যায়নীর সঙ্গে ভূপতির বিয়ে দিলেন। ১৯০২ সালের ১২ জুলাই ভূপতিনাথ ও কাত্যায়নীর ঘরে একটি ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জন্ম হল। খাতায়কলমে নাম শচীন্দ্রনাথ দে বিশ্বাস। ছোট থেকেই সুন্দর দেখতে বলে মা আদর করে ডাকতেন ‘ছবি’। এই ছবি নামটিই পরবর্তীকালে বাংলা সিনেমায় সুপরিচিত হয়ে উঠল। পদবি হিসেবে ‘বিশ্বাস’ই ব্যবহার করতেন তিনি।
কাত্যায়নী দেবী যখন মারা যান, তখন ছবি একেবারে দুধের শিশু। বয়স মাত্র ১০ মাস। স্বাভাবিকভাবেই মায়ের স্মৃতি তাঁর একেবারেই নেই। কিন্তু মায়ের দেওয়া ছবি নামের মধ্যেই তিনি মাকে অনুভব করেছেন সারাজীবন। অসময়ে মাতৃবিয়োগ হওয়াতে ছবির মেজ জ্যাঠাইমা তাঁকে মাতৃস্নেহে বড় করে তোলেন। নয়নচাঁদ স্ট্রিটের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু। পরে ক্ষুদিরাম লেনের সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তারপর ভর্তি হন হিন্দু স্কুলে। সেখান থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে, কিন্তু সেখানে পড়েননি। বন্ধুদের সঙ্গলাভের আশায় ভর্তি হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর কলেজে। অভিনয় প্রীতি ছিল ছোট বয়স থেকেই। বাড়ির প্রকাণ্ড হলঘরে ভাইবোনেরা সকলে মিলে প্রায়শই গান-বাজনা, আবৃত্তি-অভিনয়ের আসর বসাতেন। পাড়ার ক্লাবে নাটক করা শুরু করলেন। কাঁকুড়গাছি নাট্যসমাজ, হাওড়া নাট্যসমাজ, শিকদার বাগান স্ট্রিটের বান্ধবসমাজ প্রভৃতি জায়গায় নাটক ও যাত্রাপালায় অভিনয় করে খানিক নামডাকও হয়। মদন মিত্র লেনে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের বৈঠকখানায় ‘বারবেলা বৈঠক’ ক্লাবে মূলত তাঁর অভিনয় শিক্ষায় হাতেখড়ি। হাওড়া নাট্যসমাজের ‘নদীয়া বিনোদ’ যাত্রাপালায় নিমাই সন্ন্যাসীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অঞ্চলে সাড়া ফেলে দেন। কিন্তু শিক্ষিত ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলের এরকম থিয়েটার নিয়ে মাতামাতি বাড়ির একেবারেই পছন্দ ছিল না।